ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

আলোচিত সেই জল্লাদখানা

ছাইফুল ইসলাম মাছুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:৫৫, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আলোচিত সেই জল্লাদখানা

ছাইফুল ইসলাম মাছুম : ‘এই জল্লাদখানা হল ইতিহাসের গহব্বর। মানুষের রক্ত-ঘাম-আর্তনাদ, জমাট বাঁধা হাজারো বেদনা। এর প্রতি ইঞ্চি জুড়েই ব্যাখা রয়েছে। এখানে ছড়িয়ে থাকা ইট-ধুলো-বালি কথা বলবে।’- কথাগুলো বলেছিলেন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও মিরপুর জল্লাদখানা বধ্যভূমির ইনচার্জ কে এম নাসির উদ্দিন।

 

কি ঘটতো এখানে?

আমাকে পা ধরে টেনে তারা জল্লাদখানায় (তৎকালীন মিরপুর পাম্প হাউজ) নিয়ে আসল। দেখি ভেতরে রক্তে ভরা। দেখলাম ছেলেদের শার্ট, ছেলেদের প্যান্ট, জুতা, মেয়েদের শাড়ি, ওড়না, সালোয়ার কামিজ, ছোট ছোট বাচ্চাদের জুতা। এখন যেই ঘরটাতে কুপগুলো উচু করে দেয়া আছে, আগে সেটা ছিল না। আগে সেখানে ছিল ম্যানহোলের ঢাকনা। তারা কি করল, আমাকে লম্বা করে শুইয়ে দিল। মাথাটা গর্তের মধ্যে, শরীরটা বাইরে। ওরা কি করত, গলাটা কেটে দিত, তা ম্যানহোলে পরে যেত, আর শরীরটা তারা ঠেলে ফেলে দিত।

 

আমার গলায় একটা পোঁচ দিল। মানে ছুরিটা সামনের দিকে চালালো, সামনে একটা পোঁচ দেয়ার পরে গলাটা আমার জ্বলে উঠল। আমি তো দেখতে পারছিনা, কিন্তু গলাটা জ্বলে উঠল। মানে বুঝতে পারছি ওপরের চামড়াটা কেটে গেছে। সামনে একটা পোঁচ দেয়ার পরে পিছে আর টানতে পারছে না। সামনে কিন্তু কেটেছে, যতটা কাটার কাটছে, পিছে টানলে আমার গলার রগ কেটে যায় আমি মরে যাই। কিন্তু পিছে টান দিতে পারছে না। তারা একদম স্তব্ধ হয়ে যায়। একদম চুপ হয়ে যায়।

 

তিন চার মিনিট পর আরেকটা বিহারী ছেলে আসল। সে বাবলুউউ বলে চিৎকার দিয়ে আমার হাত ধরে টেনে আমাকে বের করে দিল। তখন আমি মনে হয় আমার সমস্ত শক্তি ফিরে পেলাম। তখন বাকি তিনজন চমকে উঠল। চমকে উঠে মনে হয় তারা হুশ ফিরে পেল। ওরা তাকে বলল, ‘ওই বেটা, তুই বিহারী হয়ে কেন বাঙালি বাঁচাইলি?’ ওরা মারামারি শুরু করে দিয়েছে। ও বলল, ‘আমরা বন্ধু, একসঙ্গে খেলাধুলা করছি, ওকে কেন মারবি?’ ওর নাম ছিল নাসির। আমার শরীর থেকে ননস্টপ রক্ত পড়ছে, ঠোট কেটে ঝুলে গেছে, সারা শরীর কাটা, গলা কাটা, গলা দিয়ে রক্ত পড়ছে। একেবারে বিভৎস অবস্থা। ওখান থেকে অনেক কষ্টে পালিয়ে বেঁচেছি। গলায় পোঁচ দিছে সেই দাগটা আমার অনেকদিন ছিল। এমনকি আমার এলাকায় আমার নাম দিয়েছিল গলা কাটা বাবলু। এভাবেই বর্ননা দিয়েছিলেন মিরপুর জল্লাদখানার মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে ফেরা একমাত্র বাঙালি শরিকুল ইসলাম বাবলু। তবে দুঃখের ব্যাপার দুই বছর আগে ১৮ আগস্ট ২০১৪ সালে শরিকুল ইসলাম বাবলু পৃথিবী থেকে চির বিদায় নিয়েছেন।

 

কান পেতে শুনি

১৯৭১ সালে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরেরা বাঙালির ওপর নির্বিচারে গণহত্যা পরিচালনা করেন। বাঙালিদের ধরে এনে বিভিন্ন নিষ্ঠুর কায়দায় গুলি করে, জবাই করে হত্যা করা হতো। নারীদের ধর্ষণের পর হত্যা করা হতো। পাকিস্তানিরা ও তাদের এ দেশীয় দোসরেরা সারা দেশে গড়ে তোলে অসংখ্য টর্চার সেল ও জল্লাদ খানা। গবেষকদের মতে, বাংলাদেশে জল্লাদ খানার সংখ্যা প্রায় ১৫০০টি। ইতিমধ্যে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর তথ্য সম্বলিত ৪৭৭টি জল্লাদখানা বধ্যভূমির তালিকা প্রকাশ করেছে।

 

মিরপুর জল্লাদখানার কসাই ও ইতিহাস উম্মোচন

জল্লাদখানা বধ্যভূমি ঢাকার মিরপুর-১০ নম্বরে ঝুট পট্রি এলাকায় অবস্থিত বাংলাদেশের অন্যতম একটি বধ্যভূমি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক নিরীহ ২৫ হাজার বাঙালিকে নির্যাতনের পর জবাই করে এখানেই গণকবর দেওয়া হয়েছিল। এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বধ্যভূমিগুলোর একটি। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মিরপুরের বিহারী অধ্যুষিত এলাকাগুলো সাধারণত বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছিল।

 

১৯৯৮ সালে তৎকালীন সরকার দেশের বধ্যভূমিগুলো চিহ্নিতকরণ ও সংস্কারের প্রকল্প গ্রহণ করে এবং ১৯৯৯ সালের ১৫ নভেম্বর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী-এর ৪৬ স্বতন্ত্র পদাতিক ব্রিগেড এর সহযোগিতায় মিরপুরের দুটি জায়গায় খননকাজ চালায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও দুটি বধ্যভূমি আবিষ্কার করে। এরপর এ দুটিসহ পুরো মিরপুরে মোট চারটি বধ্যভূমি চিহ্নিত করা হয়। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় স্বাধীনতাপ্রিয় বাঙালিদেরকে পাকিস্থানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর বিহারি, রাজাকার, আলবদর, আল-শামস, তাদের ট্রেনিং প্রাপ্ত জল্লাদ দিয়ে নিষ্ঠুরভাবে জবাই করে বড় বড় সেফটি ট্যাঙ্কির ভেতরে ফেলে রাখত। সেফটি ট্যাঙ্কির সঙ্গে তুরাগ নদীর সংযোগ ছিল। দেহ তুরাগ নদীতে গিয়ে পড়তো।

 

এ বধ্যভূমি থেকে ৭০টি মাথার খুলি, ৫৩৯২টি অস্থিখণ্ড, মেয়েদের শাড়ি, ফ্রক, ওড়না, অলংকার, টুপি, জুতা, তসবিসহ শহীদদের ব্যবহার্য নানা জিনিসপত্র উদ্ধার করা হয়েছিল। ২০০৮ সালে তৎকালীন সরকার পুণরায় জল্লাদখানা কর্মসূচি শুরু করে। স্থপতি ও কবি রবিউল হুসাইন এর সার্বিক পরিকল্পনায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এর প্রচেষ্টায় তৈরি করা হয় জল্লাদখানা বধ্যভূমি স্মৃতিপীঠ।

 

জল্লাদখানার প্রবেশদ্বারেই বর্ণনা সহ কিছু শহীদদের নামের তালিকা প্রদর্শন করা হয়েছে। প্রদর্শন করা হয়েছে রাজশাহীর বাবলা বন বধ্যভূমির মাটি, কিশোরগঞ্জের বড়ইতলা বধ্যভূমির মাটি, চট্রগ্রাম ফয়’স লেক বধ্যভূমির মাটি। খুলনা চুকনগর বধ্যভূমির মাটি, সিলেট আদ্যিতপুর বধ্যভূমির মাটিসহ ৪৭৭টি বধ্যভূমির তালিকা। এর পূর্বপাশে রয়েছে টেরাকোটা ইট ও লোহার সমন্বয়ে তৈরি শিল্পী রফিকুন নবী ও মুনিরুজ্জামান এর যুগ্মভাবে করা একটি ভাস্কর্য ‘জীবন অবিনশ্বর’। ২০০৭ সালের ২১ জুন জল্লাদখানার শহীদ পরিবারের সন্তানেরা এই স্থাপনাটির দ্বার উম্মোচন করা করেন।

 

জল্লাদখানা বধ্যভূমির তথ্যসূত্র থেকে জানা যায়, জল্লাদখানার আয়তন ছিল এক একর জায়গা জুড়ে। দেশ স্বাধীনের পরে বিভিন্ন সময় ক্ষমতাবানদের হাতে দখল হতে হতে বর্তমানে জল্লাদখানার আয়তন চার কাঠায় ঠেকেছে। বধ্যভূমির দুপাশ ঘেষেই রয়েছে দুটি গার্মেন্টস। আশেপাশে অসংখ্য ঝুটপট্টি আগত দর্শনার্থীদের অস্বস্থিতে ফেলছে। নষ্ট করছে বধ্যভূমির পবিত্রতা।

 

প্রিয়জনের স্মৃতির খোঁজে

এই জল্লাদখানায় হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিলেন মিরপুর সেনপাড়া পর্বতা এলাকার শহীদ আব্দুল হাকিম। তার সন্তান শামসুল আলম বলেন, বাবার কথা মনে পড়লেই জল্লাদ খানায় চলে আসি। এই জল্লাদখানা বহন করছে আমার বাবার হাজারো স্মৃতি। শুধু শামসুল আলম নয়, প্রিয়জনের স্মৃতির খোঁজে প্রতিদিনই জল্লাদখানা গণকবরে আসেন নিহত শহীদ পরিবারের সন্তানেরা। জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাজিয়া বেগম ও তার বোন গৃহবধু তাহমিদা বেগম দেখতে এসেছেন জল্লাদখানা বধ্যভূমি। নাজিয়া বেগম বলেন, বাংলাদেশের শিকড় খুঁজতেই জল্লাদখানা গণকবরে এসেছি। মিরপুর বাঙলা স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী মনিরুল ইসলাম মাসুম বলেন, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে চাই, তাই মাঝে মাঝেই জল্লাদখানায় আসি।

 

মিরপুর জল্লাদখানায় মানুষরুপী কসাইদের হাতে নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডে শিকার হয়েছিলেন বাঙালী মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ বিভিন্ন ধর্মালম্বী মানুষ। শহীদ সন্তানেরা জল্লাদখানা বধ্যভূমিতে এসে নিভৃতে কাঁদেন, কেউ কেউ নিজেদের ধর্ম অনুসারে প্রার্থনা করেন।

 

জহির রায়হানের শেষ ঠিকানা

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যখন স্বাধীনতার ডাক দেন তখন থেকে ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারী পর্যন্ত মিরপুর জল্লাদখানায় বাঙালিদের নির্বিচারে জবাই করে হত্যা করা হতো।

পুরো বাংলাদেশ ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন হলেও খোদ রাজধানী ঢাকার মিরপুর মুক্তির স্বাদ পায় ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারি। মিরপুর মুক্ত করতে দিতে হয় চড়া মুল্য, ৩০ জানুয়ারি মিরপুর যুদ্ধে শহীদ হন সেনাবাহিনীর ৪২ সেনা, পুলিশ ও মুক্তিযোদ্ধা সহ দেড় শতাধিক মানুষ। লুকিয়ে থাকা পাকিস্তান সেনা ও বিহারীদের হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন তারা। বড় ভাই শহীদুল্লাহসহ নিখোঁজ বুদ্ধিজীবীদের খুঁজতে এসে শহীদ হন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা জহির রায়হানও। ধারণা করা হয়, জহির রায়হানের শেষ ঠিকানা এই জল্লাদখানা গণকবর।

 

মুক্তিযুদ্ধ থাকুক তরুণ প্রজন্মের মননে

মিরপুর জল্লাদখানার ইতিহাস তরুণ প্রজন্মের মাঝে তুলে ধরতে ২০০৭ সাল থেকে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বছর জুড়েই করে নানা আয়োজন। স্বাধীনতা দিবসে তিন দিন, বিজয় দিবসে তিন দিন, ৩১ জানুয়ারি মিরপুর মুক্ত দিবসে একদিন স্মৃতিচারণসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। প্রতি শনিবার বিকাল চারটায় স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে আয়োজন করা হয় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে পাঠচক্র ও জল্লাদখানায় নিহত শহীদ সন্তানদের স্মৃতিচারণ। শহীদ সন্তান শামসুল আলম বলেন, একদিন পুরো দেশটাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিনির্মাণ হবে, রাজাকার বলে কোনো শব্দ থাকবে না।

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ ডিসেম্বর ২০১৬/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়