ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

‘ইউ আর গ্রেট সিংগার ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’

আরিফ সাওন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৫৪, ২৬ জুন ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘ইউ আর গ্রেট সিংগার ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’

আরিফ সাওন : ‘গান গাইতে গিয়ে অনেক দুঃখের স্মৃতি যেমন আছে, তেমনি আছে মজারও। একটি ঘটনা আমাকে খুবই অনুপ্রাণিত করে। এক বিদেশি নারী গান শোনার পর আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, ‘ইউ আর গ্রেট সিংগার ইন দ্য ওয়ার্ল্ড।’

রাইজিংবিডির সঙ্গে একান্ত আলাপে নিজের সংগীত জীবনের এই স্মরণীয় ঘটনা তুলে ধরেন জনপ্রিয় ভাওয়াইয়া শিল্পী সফিউল আলম রাজা। যাকে কেউ চেনেন ‘ভাওয়াইয়া রাজা’ কেউবা ‘ভাওয়াইয়ার রাজকুমার’ আবার কেউ চেনেন ‘ভাওয়াইয়ার ফেরিওয়ালা’ হিসেবে। গত ২৪ জুন রাজধানীর মীরপুর সাড়ে এগারোয় তার প্রতিষ্ঠিত কলতান সংস্কৃতিক একাডেমিতে বসে তিনি কথা বলেন।

তিনি বলেন, ‘আমি একমাত্র ব্যক্তি যে ঢাকায় আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে ভাওয়াইয়া গান নিয়ে একক অনুষ্ঠান করেছি। ২০১০ সালের দিকে আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে আয়োজিত ওই অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার সময় দেখি বিদেশি এক ভদ্রমহিলা সামনে বসে মুগ্ধ হয়ে গান শুনছেন। কয়েকটা গানের পরে বিরতি দিয়ে আমি একটু বাইরে গেলাম। ওই মহিলা আমাকে দেখেই দৌঁড়ে এসে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, ‘ইউ আর গ্রেট সিংগার ইন দ্য ওয়ার্ল্ড।’

আমি বললাম, ‘হোয়াই? কেন আমি গ্রেট সিংগার?’

তিনি বললেন, ‘তুমি ভাওয়াইয়া গানটা যেভাবে প্রেজেন্ট করো, যেভাবে বুঝিয়ে দাও, রিয়েলি এর ফিউচার অনেক বড়।’

তিনি বলেন, ‘আমার ভাওয়াইয়া গানের উপস্থাপন কৌশল তাকে খুব মুগ্ধ করে। এছাড়া আমি যে একটা দেশীয় সম্পদ নিয়ে কাজ করছি, এটা তাকে আরো বেশি মুগ্ধ করে।’



সফিউল আলম রাজা বলেন, ‘ওনারে চিনি না, জানি না, তার নামটাও আমার জানা হয় নি। তবে তাকে খুব ফিল করি।’

এই ঈদে কোন প্রোগ্রাম আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঈদে টেলিভিশন বা স্টেজে কোন শো নেই। ঈদের পর ২৮ জুন কুড়িগামে বিসিএস ক্যাডারদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তারা আমাকেও সংবর্ধনা দেবেন। তবে বিসিএস ক্যাডার হিসেবে নয়; ভাওয়াইয়া গানে জাতীয় পর্যায়ে একটা অবস্থান থাকায়। ওই অনুষ্ঠানে আমি ভাওয়াইয়া গান গাইবো। কুড়িগ্রামে আগেও স্টেজ শো করে এসেছি। সেখানে আমার জনপ্রিয়তা রয়েছে।’

এই ভাওয়াইয়া শিল্পীর জন্ম কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলায়। পিতা নাজমুল হক ও মাতা শামসুন্নাহার বেগমের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় কৈশোরে তার গান শেখা শুরু হয়। তিনি সংগীতে প্রাতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষা গ্রহণ করেননি।

তিনি জানান, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ না করলেও তিনি ভাওয়াইয়ার কিংবদন্তী-গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী নুরুল ইসলাম জাহিদের কাছে সংগীতের তাত্ত্বিক বিষয়ে তালিম নিয়েছেন।

সফিউল আলম রাজা বাংলাদেশ বেতারের বিশেষ শ্রেণি ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রথম শ্রেণির শিল্পী। এছাড়াও তিনি দেশের সবকটি টিভি চ্যানেলে নিয়মিত সংগীত পরিবেশন করে আসছেন। সংগীত পরিবেশন করেছেন বিভিন্ন বিদেশী মিডিয়াতে ও বিদেশে মঞ্চে। লোকসংগীতের অন্যতম ধারা ভাওয়াইয়া গানের প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন।



তিনি বলেন, ‘ভাওয়াইয়ার প্রসারের জন্য ২০০৮ সালে ভাওয়াইয়া গানের দল প্রতিষ্ঠা করেছি। ২০১১ সালে রাজধানীতে প্রতিষ্ঠা করেছি ভাওয়াইয়া গানের স্কুল। যেখানে ভাওয়াইয়ার ওপর এক বছরের ফ্রি সার্টিফিকেট কোর্স করানো হয়। চলতি বছর পহেলা জানুয়ারি এই অঙ্গনের সকল শাখা নিয়ে রাজধানীতে প্রতিষ্ঠা করেছি ‘কলতান সাংস্কৃতিক একাডেমি।’

তিনি ‘উত্তরের সুর’ নামের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রে চারটি মৌলিক ভাওয়াইয়া গান গেয়েছেন। শিল্পীজীবনে স্বীকৃতি হিসেবে সফিউল আলম রাজা বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আয়োজিত বেঙ্গল বিকাশ প্রতিভা অন্বষণে লোকসঙ্গীত বিভাগে (ভাওয়াইয়া নিয়ে) ২০০৬ সালে সারাদেশে শ্রেষ্ঠমান শিল্পী হিসেবে বিজয়ী হন।

বর্ণাঢ্য সংগীত জীবনের বর্ণনায় রাজা জানান, রাজধানীতে এ পর্যন্ত তার ছয়টি একক সঙ্গীতানুষ্ঠান হয়েছে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে দুটি, আঁড়িয়াল সেন্টারের উদ্যোগে একটি, আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের উদ্যোগে একটি, গুরু নুরুল ইসলাম জাহিদের  চিকিৎসার সহায়তায় ভাওয়াইয়া গানের দলের আয়োজনে একটি ও ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারের আয়োজনে একটি একক সঙ্গীতানুষ্ঠান হয়েছে। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন থেকে তার মিক্সড অ্যালবাম এবং ভায়োলিন মিডিয়া থেকে ২০১১ সালে প্রকাশিত হয়েছে একটি ভাওয়াইয়া অ্যালবাম ‘কবর দেখিয়ে যান’। সংগীত নিয়ে সফর করেছেন অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও বিভিন্ন দেশ। সরকারি ও বেসরকারিভাবে আয়োজিত বিভিন্ন রিয়েলিটি শো-তে বিচারকের দায়িত্ব পালন করেছেন।

এই ভাওয়াইয়ার রাজা কেবলি কণ্ঠশিল্পী নন। তার আরেকটি পরিচয় আছে। তিনি পেশায় একজন সাংবাদিক। দীর্ঘ ২৪ বছরের সাংবাদিকতা জীবনে ১৪ বছরের বেশি সময় দৈনিক যুগান্তরে কাজ করেছেন। দুই বছর আগে তিনি দৈনিক যুগান্তর ছেড়ে ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক হিসেবে কাজ করছেন। পেশাগত জীবনেও তিনি সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছেন। সাংবাদিকতায় তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় পুরস্কার, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার, ডেমোক্রেসি ওয়াচ হিউম্যান রাইটস অ্যাওয়ার্ড, ইউনেস্কো ক্লাব অ্যাসোসিয়েশন অ্যাওয়ার্ড, ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশেন বাংলাদেশ (ক্র্যাব) অ্যাওয়ার্ডসহ অনেক পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।

তবে গত ছয় মাসে লেখালেখি কমিয়ে দিয়েছেন। এখন তার সময় কাটে ৫/৬ পল্লবী, তৃতীয় তলা, মিরপুর সাড়ে এগারো, ঢাকা, ঠিকানায় কলতান সাংস্কৃতিক একাডেমিতে। এই একাডেমি হচ্ছে কণ্ঠসংগীত, নৃত্য, চিত্রাংকন, অভিনয় ও যন্ত্রসংগীত শিক্ষালয়। রাজার ভাষ্যমতে এটি হচ্ছে সংস্কৃতির আঁতুর ঘর।

নিজের স্বপ্ন সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘চিলমারীর বন্দরে ঠিক শান্তি নিকেতনের মতো একটি ভাওয়াইয়া ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা যেখানে নিয়মিত ভাওয়াইয়া চর্চা ও গবেষণা হবে। থাকবে ভাওয়াইয়া মিউজিয়াম। এজন্য দরকার সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা।

তিনি জানান, ভাওয়াইয়ার সুর বিকৃতির কারণে তিনি শঙ্কায় আছেন, তার রয়েছে ক্ষোভও। নিজের এই শঙ্কা-ক্ষোভ নিয়ে কথকতা এবং সুর বিকৃতির সমাধানে তার পরামর্শ থাকছে দ্বিতীয় পর্বে।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ জুন ২০১৭/সাওন/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়