ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

ইউ আর দ্য রিজন গড মেড ওকলাহমা

শান্তা মারিয়া || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৫৭, ২২ এপ্রিল ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ইউ আর দ্য রিজন গড মেড ওকলাহমা

দ্য ওকলাহামান পত্রিকার অফিসে

(লক্ষ্মণরেখার বাইরে-১২)

শান্তা মারিয়া : ঝকঝকে তকতকে বিশাল ওকলাহমা সিটি আর নরম্যান নামের ছোট্ট শহর। যেখানেই যাচ্ছি ঝাঁ চকচকে অফিস, ঠাঁটবাট দেখে চোখ ট্যারা হয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো ওকলাহমার বিখ্যাত পত্রিকা দ্য ওকলাহামানস এর অফিসে। এটাও খুব চকচকে অফিস। কিন্তু প্রবেশপথের কাছেই বড় বড় কাগজের রোল। হাজার হোক পত্রিকা অফিস। একটু এলোমেলো না হলে কি চলে?

সাংবাদিকদের টেবিলেও দেখলাম চিরপরিচিত বক্সফাইল, লেখার স্তূপ। কয়েকজন সাংবাদিকের টেবিল একটু এলোমেলোও। পত্রিকা অফিস মানেই নতুন ছাপা পত্রিকার সুবাস, কম্পিউটারে পেজ মেকআপ। কথা হলো ওদের ফিচার এডিটর, লাইফস্টাইল পেজের এডিটর, নিউজ এডিটর ও চিফ রিপোর্টারের সঙ্গে। মনেই হলো না অজানা, অপরিচিত মানুষ। সাংবাদিকতা পেশাটাই এমন। একই ধরনের আলাপ, চিন্তাচেতনা।

তখন বুশ প্রশাসনের আমল। কিন্তু যে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপ হলো তারা মোটেই বুশের সমর্থক নন। খোলামেলাভাবেই সরকারবিরোধী কথাবার্তা বললেন। নিউজ রুমটিও ঘুরে দেখালেন। ডেস্কে সেই একই রকম ব্যস্ততা আর ফিচারে কিছুটা রিল্যাক্স আমেজ। সন্ধ্যায় আমাদের দেশের মতোই ওদেরও পত্রিকা অফিসে ব্যস্ততার শুরু। তবে আলাপ করে মনে হলো, আমাদের দেশের সাংবাদিকদের মতো ওদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয় না। আর আমাদের পত্রিকাগুলোর মাসের পর মাস অনিয়মিত বেতন ওদের কাছে অকল্পনীয়।

দ্য ওকলাহামানস বড় পত্রিকা। ওই অফিসের ঠাঁটবাট তাই অনেক বেশি। কিন্তু দ্য নরম্যান ডেইলির অফিস একটু ছোট।  সেইসূত্রে আরও বেশি আপন। দ্য নরম্যান ডেইলি মফস্বল পত্রিকা। ছোট অফিসে ওয়ার্কস্টেশন রিপোর্টারদের জন্য। ডেস্কে কাজ করছেন কয়েকজন। ফিচার এডিটরের ঘরটা ছোট্ট। ভদ্রমহিলার সঙ্গে ভালো আলাপ জমলো। তখন সামনে হ্যালুইন। ওরাও পাতা পরিকল্পনা করছেন হ্যালুইন নিয়ে। খাবার দাবার, সাজপোশাক, ঘর সাজানো, লাইফস্টাইল পেজের যা কাজ আরকি। আইডিয়া শেয়ার করতে করতে ভাবছিলাম, পত্রিকার জগতটা চলে মোটামুটি একই চিন্তাভাবনায়। তবে হ্যাঁ, এই ছোট্ট মফস্বল পত্রিকারও সাংবাদিকরা হাইলি পেইড। ওদের পত্রিকাগুলো অবশ্য অনেক বেশি পাতার। প্রচুর পাতা, প্রচুর বিজ্ঞাপন।

চ্যানেল ফোর নামে একটি টিভি চ্যানেলেও গেলাম আমরা। এটি পুরোপুরি ঝাঁ চকচকে মিডিয়া হাউজ। বিশাল সব স্টুডিও। নিউজ প্রচার হয় যে স্টুডিও থেকে সেটির ঠাঁটবাট দুর্দান্ত। এই চ্যানেলের নিজস্ব হেলিকপ্টারও আছে। সেসময় আমাদের মধ্যে একমাত্র শাহনাজ মুন্নি টিভি-সাংবাদিক ছিলেন। তাই তিনি আলাদাভাবে টিভি রিপোর্টিং বিষয়ে একটি পৃথক কর্মশালায় অংশ নেন। একটি টিভি রিপোর্টও তৈরি করেন তিনি। আমরা অংশ নেই সংবাদপত্র বিষয়ক আলাদা সেশনে।

সংবাদপত্র ও মিডিয়া জগতে আমাদের অভিজ্ঞতা আর ওদের অভিজ্ঞতার বিনিময় হয়। ডিজাস্টার বা দুর্যোগ সাংবাদিকতা নিয়ে সেশনের পর আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় একটি জাদুঘরে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা মানবসৃষ্ট দুর্যোগ কীভাবে কাভার করতে হয় সেটা হাতে-কলমে দেখানো হয় এখানে। বহু বছর পর আমাদের সিডর এবং রানা প্লাজার ঘটনার কাভারেজ দেখে বারে বারে মনে পড়ছিল ওকলাহমায় শেখা বিষয়গুলো। দুর্যোগ সাংবাদিকতার মূল বিষয়ই হলো জনগণকে সঠিক তথ্য দিতে হবে কিন্তু প্যানিক সৃষ্টি করা যাবে না। আমাদের দেশে প্রায়শই এর উল্টোটা ঘটে।

ওকলাহমায় সাংবাদিকতা ক্লাসে একবার চমৎকার একটি বিষয় শেখানো হলো। সেটা হলো কমিউনিকেশন বিষয়ক। দুটি টিম করা হলো। একটিতে শুধু আমি এবং রোজিনা। আরো দুটি টিমে ৪ জন করে। আমাদের দুজনকে বলা হলো আমরা কোনো কথা বলতে পারবো না। অন্যরা কথা বলতে পারবে। আমাদের তিনটি দলকে বলা হলো কাগজ, কাঠ ইত্যাদি দিয়ে একটি ব্রিজের মডেল বানাতে। দেখা গেল সবচেয়ে আগে বানাতে পেরেছি আমরা দুজন। এটা প্রমাণ করে যে কখনও কখনও বেশি মতামত, বেশি কথা কাজকে বাধাগ্রস্ত করে। নানা মুনির নানা মত যে সত্যিই কাজ নষ্ট করে তার প্রমাণ পেলাম হাতে-কলমে।

আমাদের দেশে কর্মজীবী নারীদের একটি প্রধান সমস্যার নাম ডে কেয়ার সেন্টারের অভাব। শিশু সন্তান কোথায় রেখে যাব সেটি বাংলাদেশের কর্মজীবী মায়েদের প্রধান সমস্যা। এই কারণে অনেক মেয়ে চাকরিও ছেড়ে দেয়। এই সমস্যার সমাধান ওকলাহমায় কীভাবে করা হয়েছে সেটি দেখতে আমরা গেলাম একটি ডে কেয়ার সেন্টারে।

এখানে একেবারে ছোট্ট শিশু থেকে শুরু করে একটু বড় শিশুদের সারাদিনের বা অল্প সময়ের জন্য রাখা হয়। কি যে চমৎকার পরিবেশ এই ডে কেয়ার সেন্টারটির। বেশ বড় জায়গা নিয়ে খোলামেলা একটি ভবন। কাঠের বাড়ি। সামনের লনে সবুজ ঘাসে খেলা করতে পারে শিশুরা। নানা রকম রাইড রয়েছে, রয়েছে ছোট্ট সুইমিং পুল। সুইমিং পুলের একপাশে বালি। সেখানে বসে ছোট্ট দুটি শিশু বালি দিয়ে একটা বাড়ি বানাচ্ছে। দোলনায় দুলছে কয়েকজন। সবই একেবারে ছোট্ট। ‘টডলার’ যাকে বলে। আরও ছোট বাচ্চাদের রাখা হয়েছে একটি ঘরে। ওরা কয়েক মাসের। ওদের দোলনায় রাখা হয়েছে।

এত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন আর স্বাস্থ্য সম্মতভাবে শিশুদের যত্ন নেওয়া হচ্ছে যে দেখে ভীষণ ভালো লাগে। একটু বড় শিশুও ছিল। যারা স্কুলের শিশুশ্রেণিতে পড়ে। ওরা এখানেই কিছু কিছু লেখাপড়া করছে। সন্ধ্যায় বাবা-মা নিয়ে যাবে ওদের। প্রতিটি শিশুই সুন্দর, ফুটফুটে আর স্বাস্থ্যবান। কৃষ্ণাঙ্গ, শ্বেতাঙ্গ, রেডইন্ডিয়ান, এশীয় বংশোদ্ভুত সব রকম শিশুই রয়েছে। ওরা বেশ মিলে মিশে আছে এখানে। ওদের মধ্যে কোনো বিভেদ নেই। ওরা বর্ণবাদ বোঝে না। এই শিশুদের দেখে মনে পড়লো অনেক আগে শোনা একটি গানের কথা- ‘ইউ আর দ্য রিজন গড মেড ওকলাহমা’। গানটি শুনেছিলাম সেই আশির দশকে স্কুলে পড়ার সময়। এতদিনে ওকলাহমায় এসে মনে হলো এই নিষ্পাপ শিশুদের কলহাস্যে মুখরিত ওকলাহমা সত্যিই বড় সুন্দর।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২২ এপ্রিল ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়