ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ইদ্রিস আলীর ১২৫ স্বপ্ন

ছাইফুল ইসলাম মাছুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:১৮, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ইদ্রিস আলীর ১২৫ স্বপ্ন

ছাইফুল ইসলাম মাছুম : ‘আজকে আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েট করছি। কিন্তু আজকে আমার হওয়ার কথা কথা ছিল একজন ভিক্ষুক। আজকে আমি সেমিনারে হাজার হাজার তরুণ-তরুণীর সামনে কথা বলছি। কিন্তু আজকে আমার হওয়ার কথা ছিল মুদি দোকানি। কারণ আমাদের সমাজ প্রতিবন্ধী মানুষ সম্পর্কে খুব নিচু ধারণা পোষণ করে।’- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা সংসদ আয়োজিত জীবনের মূল্য শীর্ষক সেমিনারে এভাবে কথা শুরু করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইদ্রিস আলী।

তিনি সেমিনারে অংশগ্রহণকারীদের কাছে প্রশ্ন ছুড়ে দেন। ‘আমাকে দেখতে পাচ্ছেন। আমাকে শুনতে পাচ্ছেন। যারা দেখছেন হাত উঁচু করুন তো। আপনি যখন আমাকে দেখতে পাচ্ছেন, সেই সময় বাংলাদেশের প্রায় ৩০ লাখ মানুষ দেখতে পায় না। আপনি যখন আমাকে শুনতে পাচ্ছেন, তখন বাংলাদেশের পাঁচ লাখ মানুষ শুনতে পায় না।’

ইদ্রিসের এক পা খোড়া বলে প্রতিবেশীরা বলতো পড়ালেখা করে লাভ কি, প্রতিবন্ধী মানুষের তো চাকরি হয় না। পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলতেন ইদ্রিস। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কোনো ম্যাচ হলে তাকে খেলায় নিতো না। ইদ্রিস বলেন, ‘আমাকে নিতো না, কারণ আমাকে নিলে হয়তো তাদের টিম হেরে যাবে বলে।’

তখন খুব জিদ চাপে তার। দীর্ঘ দিন চর্চা করে ক্রিকেটে আরো বেশি নিজেকে দক্ষ করে তোলেন ইদ্রিস। জাতীয় পর্যায়ে গড়ে তোলেন প্রতিবন্ধী ক্রিকেট টিম। সেখানে অধিনায়কও নির্বাচিত হন ইদ্রিস। ইদ্রিস বলেন, ‘আমাদের খেলা যখন টিভিতে সম্প্রচার করে, গ্রামে চা দোকানে বসে তারা খেলা দেখে হাততালি দেয়, যারা ছোটবেলায় আমাকে খেলায় নিতো না খোড়া বলে। যারা আমার মা-বাবাকে বলতো খোড়া ছেলেকে পড়িয়ে লাভ কি, এখন তাদের ছেলেমেয়ের চাকরির জন্য আমার কাছে সুপারিশ করা হয়।’



ইদ্রিস বড় হয়েছেন মাগুরা জেলাতে। আর এইচএসসি পাশ করেছেন ক্যান্টনমেন্ট কলেজ, যশোর থেকে। এরপর তিনি ভর্তি হন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও বিচার বিভাগে। বর্তমানে এই বিভাগেই অধ্যয়নরত তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময়ে তিনি প্রতিবন্ধী কোটা নন বরং মেধায় ২৪তম স্থান অর্জন করেছিলেন আইন অনুষদে।

ইদ্রিস প্রথম প্রতিবন্ধী ব্যক্তি হিসেবে আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-১৯ (সাভার, আশুলিয়া) আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। ‘অ্যাবিলিটি ডিজঅ্যাবিলিটি ডিপেন্ডস অন মেন্টালিটি’ এই স্লোগানে তিনি নির্বাচনে লড়বেন।

তিনি জানান, ‘দেশের প্রথম কোনো প্রতিবন্ধী ব্যক্তি হিসেবে সংসদ সদস্য (এমপি) হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করব, যা বাংলাদেশ প্রথম দেখবে ২৫ বছরেই প্রথম প্রতিবন্ধী ব্যক্তি হিসেবে। এবার ভিন্ন কিছু দেখবে দেশ আমরা প্রতিবন্ধীরাও পারি।’

তিনি আরো বলেন, ‘নির্বাচনী প্রচারণাতে প্রতিবন্ধী কর্মী থাকবে। পৃথিবীর কোনো বাধা আর আমাদের বাধা নয়, বাংলাদেশের ইতিহাসে কনিষ্ঠ তরুণ সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী আমি। আমি হারলে আমি নিজে হারবো, আমি জিতলে তরুণরাই জিতবে।’



ইদ্রিস আলী অনেক মানবিক কাজের সঙ্গেও যুক্ত। তিনি নিজের বাইক দিয়ে দরিদ্র গার্মেন্টস কর্মীদের হাসপাতালে পৌঁছে দেন। সাভার এলাকায় তার বাইকটি ‘বাইক অ্যাম্বুলেন্স’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। একজন উদ্যোক্তা হিসেবে নিজে খাবার তৈরি করে সরবরাহ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে। চায়ের দোকানে তিনি ‘টি স্কুল’ গড়ে তুলছেন। চা দোকানে গল্পের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রয়োজনী জিনিস শেখানো হয়।

ইদ্রিস আলী বলেন, ‘আমার ১২৫টি স্বপ্ন আছে। তার মধ্যে ১৪টি পূরণ করে ফেলেছি। আমার অনেকগুলো স্বপ্নের মধ্যে রয়েছে সাত মহাদেশের সাতটি সর্বোচ্চ পর্বত আরোহণ করার। পৃথিবী ঘুরে দেখার।’

প্রতিবন্ধী মানুষদের সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কাজের জন্য তিনি এ বছর শ্রীলঙ্কায় ‘এশিয়া ইন্সপিরেশন পুরস্কার-২০১৮’ পেয়েছেন। বাজারে এসেছে ইদ্রিস আলীর লড়াকু জীবনের গল্প নিয়ে বই ‘আমিই চ্যাম্পিয়ান’।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ ডিসেম্বর ২০১৮/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়