ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

উপকূলের পথে

উড়িরচরের ‘অবরুদ্ধ’ জীবন!

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৩০, ২১ মার্চ ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
উড়িরচরের ‘অবরুদ্ধ’ জীবন!

রফিকুল ইসলাম মন্টু, সন্দ্বীপের উড়িরচর ঘুরে : ছোট্ট দ্বীপ উড়িরচর। চট্টগ্রামের দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপের বিভিন্ন এলাকা ভেঙে গড়েছে এই চর। এখানকার প্রায় ৪০ হাজার মানুষের জীবনে রয়েছে হাজারো সংকট। আর সব  সংকটের কেন্দ্রে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা। রাতে এক অন্ধকারপুরীতে পরিণত হয় এ দ্বীপ। সন্ধ্যা থেকে জেনারেটরের আলোতে দ্বীপের হাটগুলোতে মানুষের সমাগম ঘটলেও তা মিলিয়ে যায় রাতে ১০টা না বাজতেই।

দক্ষিণপ্রান্তে উড়িরচরের প্রধান ঘাট। সন্দ্বীপের কালাপানিয়া, লক্ষ্মীপুরের চরলক্ষ্মী কিংবা সীতাকুণ্ডের কুমিরা ঘাট থেকে আসা যাত্রীবাহী ট্রলারগুলো এখানেই ভিড়ে। পশ্চিমে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে যোগাযোগের জন্য রয়েছে আরেকটি ঘাট। সেখান থেকে চর এলাহীর ক্লোজারঘাটে পার হওয়া যায়। নদীপথে দ্বীপে যাতায়াতের পথ এগুলোই। সময়ের সঙ্গে, জোয়ারভাটার সঙ্গে মিল রেখে এখানকার মানুষকে যাতায়াত করতে হয়। জরুরি প্রয়োজনে মানুষগুলো তাই একেবারেই অসহায় হয়ে পড়ে।

প্রধান ট্রলার ঘাট থেকে খানিক দূরে কলোনী বাজার। বাংলা বাজার, জনতা বাজার, হাজারী বাজার মিয়া বাজার, সাহেব বাজার, সমিতি বাজারসহ আরো অনেক বাজার রয়েছে। এসব বাজারে হাট বসে প্রতিদিনই। দৈনন্দিন কেনাকাটা ছাড়াও স্বজনদের খোঁজখবর নেওয়া, বিভিন্ন এলাকার খবরাখবর জানাসহ নানান কাজে সন্ধ্যা হলেই মানুষগুলো ছুটেন হাটের দিকে। চায়ের দোকানে টিভিতে চলে সিনেমা কিংবা খবর, টেবিলে চলে চায়ের আড্ডা। এসব বাজারগুলোতে চায়ের আড্ডায় আলাপ হলো এলাকাবাসীর সঙ্গে।

‘আমরা তো আছি বন্দি জীবনে। চাইলেই আমরা দ্বীপের বাইরে যেতে পারি না। মুমুর্ষূ অবস্থায় রোগী নিয়ে যথা সময়ে ডাক্তারের কাছে যেতে পারি না।’-হাজারী বাজারে আলাপকালে কথাগুলো বলছিলেন কৃষক কামাল পাশা (৭০)। তার এই কথার সঙ্গে আরেকটু যোগ করে একই এলাকার কৃষক আবুল কাসেম (৬০) বলেন, ‘শুকনোয় আমরা পানির অভাবে জমি আবাদ করতে পারি না। বর্ষায় আবার পানিতে ডুবে থাকে বাড়িঘর। এখানে জীবনযাপন অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। তবুও আমরা বাধ্য হয়ে এখানে থাকি।’

উত্তর উড়িরচরের এই হাজারী বাজারে দেখা মেলে দ্বীপের অপেক্ষাকৃত অবহেলিত এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে। এখানকার ১ নম্বর ও ৩ নম্বর ওয়ার্ডে প্রায় ৪ হাজার পরিবারের বসবাস। খাসজমির বিস্তৃত প্রান্তরে ছড়ানো ছিটানো বাড়িঘর। বৃহৎ বিলের মাঝখানে মাথাতুলে দাঁড়িয়ে আছে ছোট ছোট ঘরগুলো। ঝড়-ঝাপটা থেকে বাঁচতে কোনো বাড়ির চারপাশে বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। কোনো কোনো বাড়ি আবার একেবারেই ফাঁকা। কিন্তু এই বাড়িগুলোতে যাতায়াতের নেই কোনো রাস্তা। বর্ষাকালে কোমর কাদাপানি ভেঙে অথবা নৌকায় করে চলাচল করতে হয়। নিজস্ব উদ্যোগে কোনো কোনো বাড়িতে চলাচলের পথ তৈরি করা হলেও সে সংখ্যা একেবারেই হাতেগোনা।



খানিক দূরে জনতা বাজারে আলাপ আরো কিছু মানুষের সঙ্গে। এদের একজন রবিউল আলম (৬৩)। ১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা। প্রায় ৪০ বছর আগে সন্দ্বীপের সন্তোষপুর থেকে এই দ্বীপে এসেছেন। তিনি জানান, নদী ভাঙনের ফলে সন্তোষপুরে বাপদাদার ভিটেমাটি হারিয়ে ঠাঁই নিয়েছেন উড়িরচরে। কিন্তু বিগত ৪০ বছরে এই দ্বীপও ভেঙে ছোট হয়েছে। একদিকে ভাঙছে; আরেক দিকে গড়ছে, জানালেন রবিউল।

কলোনী বাজারের আকলিমা হোটেলেও সান্ধ্যকালীন ভিড়। ৫ নম্বর ওয়ার্ডের নূর জামাল (৫৫), ৬ নম্বর ওয়ার্ডের আকবর হোসেন (৩২), ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ফরহাদ হোসেন (৩৫)- এরা জানালেন নানান তথ্য। প্রাকৃতিক বিপদ এখানকার মানুষের জীবন বারবার বদলে দেয়। অধিক কষ্টে ফলানো ফসল আদৌ ঘরে তুলতে পারবেন কি-না, তা নিয়ে শঙ্কা থেকেই যায়। গত আমনের শেষ সময়ে এই দ্বীপের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝড়ে বহু মানুষ ফসল হারিয়েছে, বাড়িঘর হারিয়েছে। বেড়িবাঁধ না থাকায় বর্ষাকালে জোয়ারের পানিতেও ডুবে যায় ফসলি মাঠ।

উড়িরচরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, প্রধান দুটি সড়ক বাদে আর কোনো সড়ক নেই। বলা যায়, পায়ে হাঁটার কিছু পথ আছে। প্রয়োজনে স্থানীয় মানুষেরা তা তৈরি করে নিয়েছেন। কিন্তু বর্ষায় এ পথ দিয়ে চলচল কষ্টসাধ্য। স্থানীয়ভাবে তৈরি করা নিচু রাস্তাগুলো বর্ষাকালে পানিতে ডুবে থাকে। শুধু যোগাযোগ নয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষিসহ জীবনযাপনের সব ক্ষেত্রেই এখানকার মানুষেরা প্রতিনিয়ত বহুমূখী সংকটের মুখোমুখি।

চৌদ্দ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য আর দশ কিলোমিটার প্রস্থের এই দ্বীপের অভ্যন্তরীণ চলাচলে প্রধান বাহন হিসাবে ব্যবহৃত হয় মোটরবাইক। রয়েছে কয়েকটি জিপ গাড়ি; যা যাত্রী বহনে চলাচল করে। ভ্যান, ট্রলি, সাইকেল, রিকশার প্রচলনও আছে। ৩০ কিলোমিটার রাস্তার মধ্যে মাত্র ৪ কিলোমিটার পাকা আর ১৩ কিলোমিটার ইট বিছানো। জেলা সদর চট্টগ্রাম থেকে এই দ্বীপের দূরত্ব প্রায় ১০০ কিলোমিটার আর উপজেলা সদর থেকে দূরত্ব প্রায় ৩৫ কিলোমিটার।

দ্বীপের চারিদিকে নদীবেস্টিত হলেও এখানে জেলের সংখ্যা খুবই কম। শতকরা ৯৯ শতাংশ মানুষের জীবিকা কৃষিকাজের ওপরই নির্ভরশীল। মোট ভূমির বেশিরভাগ আবাদী। মাত্র ৫০০ একর জমিতে বনভূমি থাকলেও তা দিন দিন কমছে। একটি নিম্ন  মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ২টি এবতেদায়ি মাদ্রাসা ও ৪টি হাফেজিয়া মাদ্রাসায় উড়িরচরের শিক্ষা ব্যবস্থা আবদ্ধ হয়ে আছে। স্বাস্থ্য বিভাগের কার্যক্রম থাকলেও তা খুবই সীমিত আকারে। রয়েছে একটি ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও একটি কমিউনিটি ক্লিনিক।  



কথিত আছে, প্রচুর পরিমাণে ‘উড়ি’ ঘাস জন্মাতো বলে এই দ্বীপের নাম হয়েছে উড়িরচর। বয়সী বাসিন্দাদের মতে, সন্দ্বীপের ৬০ মৌজা ভেঙে উড়িরচরের জন্ম হয়েছে। সন্দ্বীপের পূর্বে হরিদ্রা খালীর চর, পশ্চিমে নোয়াখালীর খাসেরহাট সন্দ্বীপ চ্যানেল, উত্তরে সোনাগাজীর চর কচ্ছপিয়া এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের মেঘনার মোহনা উড়িরচরের সীমানা ছিল এক সময়। সন্দ্বীপের হুদ্রাখালী, ন্যায়মস্তি, আজিমপুর, শাকনগর, মেহেরপুর, তারাপুর, সুলতানপুর, দরিরচর, চর হরিণা, চর রুনি, কৈয়াডুগি, পায়াডুগি, সামসুরাবাদ, চর পীরবক্স, চর দরজি, চর বধূ, চর রহিম, চর সিদ্ধি, বাধাজোড়া, কাঠগড়, চর বাউয়া, চর ধুবলাপাড়সহ বিভিন্ন এলাকা ভেঙে উড়িরচরে পলি জমেছে। প্রথম দিকের সেই দ্বীপ বহুবার ভেঙে বর্তমান রূপ ধারণ করেছে।

উড়িরচরের যেখানেই আলাপ, সেখানেই দীর্ঘ দাবির তালিকা। ভূমি বন্দোবস্ত দ্বীপবাসীর অন্যতম প্রধান দাবি। দুর্যোগ মোকাবিলায় তারা চান দ্বীপের চারিদিকে বেড়িবাঁধ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ানো, খাল খনন, পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল নির্মাণ, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, অভ্যন্তরীণ রাস্তাঘাটের উন্নয়নের দাবি উত্থাপন করেন বাসিন্দারা।

নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের সঙ্গে সীমানা বিরোধ মিটিয়ে এখানে অবিলম্বে ইউপি নির্বাচনের দাবিও রয়েছে দ্বীপবাসীর। তারা মনে করেন, নির্বাচন হলে এখানকার অনেক সমস্যার সমাধান হবে। সীমানা বিরোধের কারণে প্রায় ১৭ বছর ধরে উড়িরচর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হচ্ছে না।

উড়িরচর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) আবদুর রহিম বলেন, বিভিন্ন কারণে এই দ্বীপ ইউনিয়নটি পিছিয়ে আছে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা এর অন্যতম কারণ। এখানে রাস্তাঘাটের উন্নয়ন প্রয়োজন। চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রয়োজন। আরো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন। ইউনিয়ন পরিষদের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে একটি পরিত্যক্ত ভবনে। এ বিষয়েও সরকারের নজর দেওয়া  প্রয়োজন। এখানকার সমস্যার বিষয়গুলো আমরা যতটা সম্ভব সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে জানাচ্ছি। কিন্তু সে অনুযায়ী বরাদ্দ হচ্ছে না। 

আরো পড়ুন :




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২১ মার্চ ২০১৮/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়