এক বর্ষায় বৃষ্টিতে ভিজে
সাইফ বরকতুল্লাহ : শ্রাবণ মাস। শ্রাবণের এই বৃষ্টিতে স্নিগ্ধ সজল লাবণ্যময় মায়াঞ্জনে হৃদয় আমার উদ্বেলিত-উচ্ছ্বসিত। চির সৌন্দর্যের অলকাপুরীতে মন চলে যায় শান্তির ভুবনে। বৃষ্টি এলেই চারদিকে তার অপরূপ সৌন্দর্য ছড়িয়ে দেয়। আর প্রকৃতির বৈচিত্র্যের সাথে মানবজীবনেও নতুনত্বের ছোঁয়া লাগে।
বৃষ্টির আবেদন চতুর্মুখী। বৃষ্টির অপরূপ দৃশ্য আমাদের মনে কুহক জাগায়। মায়াবি রূপ আমাদের মোহিত করে, আন্দোলিত করে শিহরিত করে। ঋতু পরিবর্তিত চিরায়ত ধারায় আষাঢ়-শ্রাবণ এ দুই মাসকে ঘিরে আমাদের বর্ষাকাল। বর্ষাকালে আকাশ থাকে গুরুগম্ভীর কালো মেঘের ভারে নিরন্তর অবনত। সগর্জন, মেঘবর্ষণের বিপুল দাপট চলে এ দুই মাসে। বাংলা সাহিত্যে ষড়ঋতুর প্রভাব ও প্রতিপত্তি বহুদূর-সঞ্চারী। বলা বাহুল্য, বাংলা কবিতায় বর্ষা ঋতুর প্রভাব সবচেয়ে বেশি। বর্ষার চরিত্র বা সৌন্দর্যের যে বহুগামী বৈচিত্র্য তা অন্য পাঁচটি ঋতু থেকে স্বতন্ত্র। এ স্বতন্ত্র বর্ষা ঋতুকে নিয়ে কবিদের কবিতায় বর্ষার রূপ বা সৌন্দর্য ধরা দিয়েছে নানান অভিপ্রায়ে।
বাংলা সাহিত্যের প্রথম নারী ঔপন্যাসিক স্বর্ণকুমারী দেবী বর্ষার চরিত্র বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন :
‘সখি, নব শ্রাবণ মাস
জলদ-ঘনঘটা, দিবসে সাঁঝছটা
ঝুপ ঝুপ ঝরিছে আকাশ!
ঝিমকি ঝম ঝম, নিনাদ মনোরম,
মুহুর্মুহু দামিনী-আভাস! পবনে বহে মাতি, তুহিন-কণাভাতি
দিকে দিকে রজত উচ্ছ্বাস।’
কিংবা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বর্ষার দিনে’ কবিতায় বলেছেন :
‘এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায়
এমন মেঘস্বরে বাদল-ঝরঝরে
তপনহীন ঘন তমসায়।’
এ ছাড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার কবিতার মাঝেই তুলে ধরেছেন বর্ষার প্রতি মুগ্ধতার কথা। অজস্র কবিতা ও গানে প্রিয় ঋতু বর্ষাকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীত বিতানেই শুধু বর্ষা নিয়ে গানের সংখ্যা ১২০টি। বর্ষা আসে চিরায়ত সৌন্দর্য্যের পসরা নিয়ে। তাইতো তিনি যথার্থই বলেছেন :
‘আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদর দিনে
জানি নে, জানি নে কিছুতে কেন যে মন লাগে না
মেঘমল্লারে সারাদিনমান
বাজে ঝরনার গান
মন হারাবার আজি বেলা
পথ ভুলিবার খেলা।’
বর্ষা নিয়ে কালিদাস রচনা করেছেন মহাকাব্য ‘মেঘদূত’। মেঘকে সেখানে বন্ধু বলা হয়েছিল। অথচ একজন ফরাসি কবি যাকে আধুনিক কবিতার জনক বলে কেউ কেউ অভিহিত করেছেন। তিনি লিখেছেন :
‘বিরক্ত বর্ষার মাস অবিরল সমস্ত শহর
অফুরন্ত পাত্র থেকে ঢালে তার ঠাণ্ডা অন্ধকার।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত ‘বর্ষাকাল’ কবিতায় লিখেছেন :
‘গভীর গর্জন করে সদা জলধর
উথলিল নদ-নদী ধরনীর উপর
রমণী রমন লয়ে
সুখে কেলি করে
দানবাদি দেব যক্ষ সুখিত অন্দরে।’
বর্ষা আর বৃষ্টি এলেই তাড়িত করে অন্য এক আবেগ। বৃষ্টির নির্ঝরণীতে অধিক যেন ব্যাকুল হয়ে ওঠে আবেগতাড়িত মন। অঝোর ধারার বৃষ্টি আর বর্ষার নির্ঝরণীতে ধুয়ে মুছে দিতে চান যাবতীয় দুঃখ, যাতনা, বিষাদময় ক্লেদাক্ততা। এ জন্যই হয়তো জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন: ‘আজি বাদল ঝরে মোর একেলা ঘরে।’ কবি শামসুর রাহমান বলেছেন: ‘বর্ষাকে আমি ভালবাসি আমার প্রিয়জনের মত করে।’
বাংলা কবিতায় বর্ষার বন্দনা হয়েছে সেই মধ্যযুগ থেকে আজ পর্যন্ত। বর্ষা আর বৃষ্টি এখন কবিতার একটি অংশ। এমন কোনো কবি নেই বর্ষাকে কেন্দ্র করে দুএকটি পঙ্ক্তি রচনা করেননি।
বর্ষাকে নিয়ে মহাদেব সাহা লিখেছেন :
‘বর্ষা, তোমাকে না হয় আরো একটু টেনে বলি বরষা
পদাবলির ঢংয়ে
বর্ষা শুনে নাকি কারো মন খারাপ হয়ে যায়
বিরহ জাগে; আমার কিন্তু বৃষ্টি খুব ভালো লাগে, বৃষ্টি
আমার শৈশবের মতো
মেয়েরা ভিজতে চায় বৃষ্টিতে
ভিজুক না
মেয়েরা জলে না নামলে পদ্মফুল ফুটবে কেন?’
পল্লীকবি জসীমউদদীন ‘পল্লীবর্ষা’ কবিতায় লিখেছেন :
‘বউদের আজ কোনো কাজ নাই
বেড়ায় বাঁধিয়া রসি
সমুদ্র কলি শিকা বুনাইয়া নীরবে দেখিছে বসি।
কেউবা রঙিন কাঁথায় মেলিয়া বুকের স্বপনখানি
তারে ভাষা দেয় দীঘল সুতোয় মায়াবী নকশা টানি
বৈদেশী কোন বন্ধুর লাগি মন তাঁর কেঁদে ফেরে
মিঠে সুরে গান কাঁপিয়ে রঙিন ঠোঁটের বাঁধন ছেড়ে
আজিকে বাহিরে শুধু ক্রন্দন ছলছল জলধারে
বেণু বনে বায়ু নাড়ে এলোকেশ, মন যেন চায় কারে?’
কবি মুহাম্মদ নূরুল হুদা বর্ষা নিয়ে লিখেছেন :
‘বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি পড়ে
মনে মনে বৃষ্টি পড়ে
বৃষ্টি পড়ে বৃষ্টি পড়ে
বনে বনে বৃষ্টি পড়ে
মনের ঘরে চরের বনে
নিখিল নিঝুম গাও গেরামে
বৃষ্টি পড়ে বৃষ্টি পড়ে
বৃষ্টি পড়ে বৃষ্টি পড়ে।’
কবি হাসান হাফিজ ‘বর্ষাভেজা পদাবলিতে’ বলেছেন :
‘শ্রাবণে বিরহ শুধু নয়, আগুনও রয়েছে
সেই তাপে শুদ্ধ হবে অসবর্ণ মিল পিপাষা।’
বাংলা সাহিত্যে একমাত্র বর্ষারই বিচিত্র ও সার্থক ব্যবহার হয়েছে বাংলা কবিতায়। বর্ষা কখনো নিটোল প্রেমের অনুঘটক, কখনো বা কামনা-বাসনার। আবার কখনো প্রকৃতির রূপ বর্ণনায়। কখনো শৈশব বা কৈশোরের সোনালি স্মৃতির দর্পণ। আবার বর্ষা কখনো বা স্বয়ং নারী। কোথাও বা প্রেমকে ফুটিয়ে তোলে এই বর্ষাই।
পরিশেষে বলব, বর্ষা আবার ফিরে এসেছে। আবার বৃষ্টি হবে, আবার মন বৃষ্টির শব্দে হারিয়ে যাবে- ভাবতেই হারিয়ে যাই প্রকৃতির রাজ্যে। কেননা কবি আল মাহমুদ বলেছেন তার প্রকৃতি কবিতায় :
‘আমি ঘোর লাগা বর্ষণের মাঝে
আজও উবু হয়ে আছি
ক্ষীরের মতন গাঢ় মাটির নরমে
কোমল ধানের চারা রুয়ে দিতে গিয়ে
ভাবলাম, এ মৃত্তিকা প্রিয়তম কিষাণী আমার
বর্ষণে ভিজছে মাঠ
যেন কার ভেজা হাতখানি
রয়েছে আমার পিঠে
আর আমি
ইন্দ্রিয়ের সর্বানুভূতির চিহ্ন ক্ষয় করে ফেলে
দয়াপরবশ হয়ে রেখেছি আমার কালো দৃষ্টিকে সজাগ।’
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সাম্প্রতিক সময়ে বেড়েছে বৃষ্টি। বিশেষ করে ঢাকাতেই এখন নিয়মিত বৃষ্টি হচ্ছে। তাই এখন নিলুফার ইয়াসমিনের গাওয়া গানটি যেন অজান্তেই কণ্ঠে চলে আসে-
‘এক বরষায় বৃষ্টিতে ভিজে
দুটি মন কাছে আসলো
এক সমুদ্র কল্পনা বেয়ে
দুটি মন ভালবাসলো
এক বরষায় বৃষ্টিতে ভিজে।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ জুলাই ২০১৭/তারা
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন