ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

একাত্তরের তির-ধনুকের যোদ্ধাদের স্মৃতিস্তম্ভ

মো. মামুন চৌধুরী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৩৫, ৫ ডিসেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
একাত্তরের তির-ধনুকের যোদ্ধাদের স্মৃতিস্তম্ভ

১৭ আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধার নামে গড়ে তোলা স্মৃতিস্তম্ভ

মো. মামুন চৌধুরী, হবিগঞ্জ : জেলার বাহুবলের মধুপুর চা-বাগানের পাশেই পুটিজুরী বনবিট। এখানে চারদিকে পাহাড়ি টিলা সবুজ ছায়াঘেরা। এর মধ্যে কারিগজিয়া ত্রিপুরা পল্লী। এ পল্লীতে শত শত বছর ধরে আদিবাসীরা বসবাস করছেন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় বীরমুক্তিযোদ্ধা কমান্ডেন্ট মানিক চৌধুরীর নেতৃত্বে এখানে গড়ে ওঠে ‘মুক্তি ক্যাম্প’। যুদ্ধ চলাকালে প্রায়ই তিনি এখানে অবস্থান করে ক্যাম্পের আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধাদেরকে নানা পরামর্শ দিতেন।

এ ক্যাম্পে রাখা হতো অস্ত্র। এখান থেকে অস্ত্রগুলো বিভিন্নস্থানে সরবরাহ করা হতো। শুধু তাই নয়, আদিবাসীসহ স্থানীয়রা এ ক্যাম্প থেকে তির-ধনুক ও অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে পাকিস্তানি হানাদারদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তেন।

মানিক চৌধুরীর নেতৃত্বে আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধারা পায়ে হেঁটে শেরপুর-সাদীপুরে তির-ধনুক নিয়ে হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। এসব আদিবাসীরা তির-ধনুকে পারদর্শী ছিলেন। তারা তির-ধনুক নিয়েই পাক সেনাদের বিরুদ্ধে তুমুল লড়াই করেন। এ লড়াইয়ে বিরাট সফলতাও আসে। বিশেষ করে সে সময় এ ক্যাম্পটি বিরাট ভূমিকা পালন করে। শুধু তাই নয় মুক্তিযোদ্ধাদের খাবারের ব্যবস্থাও করে দিতেন আদিবাসী নারীরা। এখানের ১৭ জন বীরযোদ্ধার নামে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের দাবী দীর্ঘদিনের।   

২০১৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসার পর মানিক চৌধুরীর কন্যা কেয়া চৌধুরী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ২০১৫ সালের ১১ ডিসেম্বর কালিগজিয়ার ত্রিপুরা পল্লীতে পরিদর্শনে যান সে সময় স্থানীয় আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে এমপি কেয়া চৌধুরী কথা বলেন। তাদের দাবী অনুযায়ী ১৭ জন মুক্তিযোদ্ধার স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণে বরাদ্দ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।

পরে তিনি স্থান নির্বাচন করে ৬০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেন। আজ সেখানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। এই বিজয়ের মাসেই ২ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে স্মৃতিস্তম্ভ উদ্বোধন করেন এমপি কেয়া চৌধুরী। এ সময় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা, আওয়ামী পরিবারের নেতৃবৃন্দ, আদিবাসী পরিবারের লোকজন উপস্থিত ছিলেন। এ সময় যুদ্ধে ব্যবহৃত তির-ধনুক, রান্নার পাতিল, কাপড়সহ নানা স্মৃতিবাহী জিনিসপত্র আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধারা কেয়া চৌধুরীর হাতে তুলে দেন। এগুলো হবিগঞ্জে নির্মিতব্য জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হবে।

কেয়া চৌধুরী বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিকে গণমানসে ধরে রাখতেই এখানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ হয়েছে। এ স্তম্ভ দেখে নতুন প্রজন্মরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে পারবে।’

আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে এখনও জীবিত রয়েছেন সঞ্জয় দেববর্মা, মহেন্দ্র দেববর্মা, সোনা মনি দেববর্মা, গোবিন্দ দেববর্মা, দেবেন্দ্র দেববর্মা, ব্রজেন্দ দেববর্মা, দীনেশ দেববর্মা, রাজপদ্ম দেববর্মা,  ভদ্রমনি দেববর্মা, যতিন্দ্র দেববর্মা, বিনয় দেববর্মা ও  সচিন্দ্র দেববর্মা। মারা গেছেন ইন্দ্র মনি দেববর্মা, হরেন্দ্র দেববর্মা, বিধু দেববর্মা, গুণমনি দেববর্মা, গোপাল নদ্র দেববর্মা।  জীবিত থাকা মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ জীবনের কাহিনী কেয়া চৌধুরীকে শুনিয়েছেন।

মুক্তিযোদ্ধারা জানান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানে আহবানে সাড়া দিয়ে মানিক চৌধুরীর নেতৃত্বে আমরা পাক সেনাদের উপর তির-ধনুক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। এখান থেকে নানাস্থানে অস্ত্র সরবরাহ করেছি। একদিন দেশ স্বাধীন হল। আমরা পেলাম মুক্ত দেশ।  মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত  মানিক চৌধুরী আমাদের খবর নিয়েছেন। এরপর কেউ আমাদের খবর নেয়নি। আমরা আর কতদিন বাঁচব। যাই হোক মৃত্যুর পূর্বে নিজ থেকে এমপি কেয়া চৌধুরী আামাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। এটাই আমাদের বড় পাওয়া। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি ধরে রাখার সবুজ পাহাড়ে লাল রঙ মাখা নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভটি দেখে আজ খুব আনন্দ লাগছে।
 

 

 


রাইজিংবিডি/হবিগঞ্জ/৫ ডিসেম্বর ২০১৬/মামুন/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়