‘এখন মাথা উঁচু করেই পরিচয় দিতে পারি’

মোয়াজ্জেম হোসেন, লালমনিরহাট : ‘জায়গা-জমি, সবকিছুই নিজের নামে হয়েছে। এমন কি নিজের পরিচয়টাও হয়ে গেছে এখন বাংলাদেশি। কোন যুদ্ধ ছাড়াই শেখের বেটিই আমাদের নতুন পরিচয় করে দিয়েছে। এখন স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়েছি। ৬৭ বছরে যেসব চোখে দেখি নাই। এখন সেসব গত দুই বছরেই হাতের মুঠোয় পেয়েছি। যেন সবকিছুই স্বপ্নের মতো। এখন মাথা উঁচু করেই অন্যদের পরিচয় দিতে পারি- আমরা বাংলাদেশি,  খাঁটি বাঙালি।’

ছিটমহল বিনিময়ের দুই বছর পূর্তির দিনে সোমবার বিকালে বিলুপ্ত ১১৯ নম্বর বাঁশটাকা ( মোমিনপুর) ছিটমহলে কথা হয় ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির সাবেক নেতা নজরুল ইসলামের সাথে। তার পাশেই বসেছিলেন আব্দুল মজিদ, নুরুল ইসলামসহ অন্যান্যরা। বিলুপ্ত ছিটমহল সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা এসব কথা বলেন।

নজরুল ইসলাম জানান, রাস্তা-ঘাট, মসজিদ-মন্দির, তথ্যসেবা কেন্দ্র, স্কুল-কলেজ-মাদরাসা, কমিউনিটি ক্লিনিক, বিদ্যুৎ সংযোগ, কমিউনিটি সেন্টার, স্যানিটারি পায়খানা স্থাপন, টিউবওয়েল বসানো, ধরলা নদী ভাঙন রোধে বাঁধ নির্মাণ ও ধরলা নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে নদী খননসহ বিভিন্ন নির্মাণে একাধিক প্রকল্পের মাধ্যমে নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে।

 

এছাড়াও চিকিৎসা সেবা, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতাসহ বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে সরকার। তবে সরকারি চাকরিতে বিশেষ নিয়োগের মাধ্যমে বিলুপ্ত ছিটমহলের শিক্ষিত বেকার যুবক-যুবতীদের নিয়োগের দাবী জানান তিনি।

আজ ১ আগষ্ট বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোতে দ্বিতীয় বর্ষপূতির জন্য ব্যাপক কর্মসূচী হাতে নিয়েছে স্থানীয় সাধারণ লোকজন। এ কর্মসূচীতে অংশ নেবেন লালমনিরহাট-১ আসনের সংসদ সদস্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির সভাপতি মোতাহার হোসেনসহ স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ।

পাটগ্রাম উপজেলা এলজিইডির প্রকৌশলী আবু তৈয়ব মোঃ শামসুজ্জামান জানান, পাটগ্রামের বিলুপ্ত ছিটমহলে ২ কোটি ৫৯ লাখ ২১ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ২৯ কোটি ৪০ লাখ ৮৬ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪৬ কিলোমিটার পাকা রাস্তা, ৩৬ লাখ ৩২ হাজার ৩২২ টাকা ব্যয়ে দুইটি মসজিদ, ২০ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি রাধা গোবিন্দ মন্দির ও ৬৪ লাখ ৩২ হাজার টাকা ব্যয়ে একটি আধুনিক কালচারাল কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। এসব কাজ বাস্তবায়ন হলে এ অঞ্চলগুলোর আর্থ-সামাজিক পটপরিবর্তন ঘটবে।

 

লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী কৃষ্ণ কমল সরকার বলেন, ‘পাটগ্রামে বিলুপ্ত ছিটমহল ভাঙন থেকে রক্ষার জন্য ধরলা নদী শাসনে ১৫ কোটি ৭৭ লাখ টাকা ব্যয়ে ১৭শ ২০ মিটার দৈর্ঘ্য’র ৫টি বাঁধ নির্মাণ প্যাকেজ ওয়ার্ক অর্ডার দেওয়া হয়েছে। শীঘ্রই আরো ৮ কোটি ১৯ লাখ ব্যয়ে ধরলা নদীর নাব্যতা ফেরাতে খনন কাজের ঠিকাদার নিয়োগ করতে দরপত্র আহবান করা হবে।’

লালমনিরহাট পুলিশ সুপার এসএম রশিদুল হকের কাছে আইন-শৃঙ্খলা বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, বিলুপ্ত ছিটমহলের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। কোথাও অপ্রীতিকর ঘটনা নেই।  শ্রীরামপুর ইউনিয়নের অভ্যন্তরে বিলুপ্ত ভোটবাড়ি ছিটমহলে একটি পুলিশ তদন্ত কেন্দ্র স্থাপনের জন্য ৭৫ ভাগ কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। ভবন নির্মাণে শীঘ্রই দরপত্র আহবান করা হবে।  

লালমনিরহাট জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, লালমনিরহাটের সদর উপজেলায় ২টি, হাতীবান্ধা উপজেলায় ২টি ও পাটগ্রাম উপজেলায় ৫৫টি ভারতীয় ছিটমহল ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্যরাতে বাংলাদেশি ভূ-খন্ডের সাথে যুক্ত হয়। এসব ভূ-খন্ডে বসবাসকারী নাগরিকরা নতুন বাংলাদেশি নাগরিকত্বও পান। পরে তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়া হয়। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে তারা কিছুদিন আগে অনুষ্ঠিত স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে ভোটও প্রদান করেছেন।

সর্বাধিক বিলুপ্ত ছিটমহলের উপজেলা পাটগ্রামের ইউএনও নূর কুতুবুল আলম জানান, বিলুপ্ত ছিটবাসীদের জন্য সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের মাধ্যমে ব্যাপক উন্নয়ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এসব উন্নয়ন কার্যক্রমের মধ্যে এলজিইডি, জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর, পানি উন্নয়ন বোর্ড, শিক্ষা, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ও স্বাস্থ্য বিভাগের মাধ্যমে কয়েকটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এছাড়া ৩২০ জন দরিদ্র মায়ের জন্য মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রদান কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। ভিজিডি কর্মসূচীর আওতায় ১১০০টি কার্ড প্রদান করা হয়েছে। পুরাতন ছিটমহলের অধিবাসী শুমারী-২০১৭ গণনা করা হয়েছে। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের উদ্যোগে বিলুপ্ত ছিটমহলে উত্তরবঙ্গ প্রকল্পের আওতায় ১৩ পুরুষ ও ৬২ জন নারীকে গাভী পালনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। সমাজ সেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী ভাতা এবং মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের মাধ্যমে বিধবা ভাতা প্রদান কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। এসব কার্যক্রম চলমান রয়েছে বলেও জানান তিনি ।

 

বিলুপ্ত ছিটমহলের বাসিন্দা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জামেরুল ইসলামের স্ত্রী নবীজন বেগম বলেন, ‘আগে নিজের পরিচয় দিতে পারতাম না । শুধু নাগরিক সুবিধাই না, বিশ্বটাকেও আমরা হাতের মুঠোয় পেয়েছি। কোন কিছু হলে সাথে সাথে মোবাইল ফোনেই স্বামীকে সবকিছু জানাতে পারছি। ছিটমহল বিনিময় হওয়ার কারণে আমাদের অনেক সুবিধা হয়েছে।’

উপজেলার জোংড়া ইউনিয়নের বিলুপ্ত ১১৯ বাঁশকাটা ছিটমহলে স্থাপিত  মোমিনপুর বাঁশকাটা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রাকিবুল হাসান জানালেন, স্থানীয়ভাবে গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ বিদ্যালয়টি স্থাপন করেছেন। ১৩০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। এ অঞ্চলে কোন কলেজ না থাকায় নবম-দশম ও একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদানের কার্যক্রম চলছে। বিলুপ্ত ছিটমহলবাসীর স্বপ্ন পূরণে এবং আগামী প্রজন্মকে শিক্ষিত হিসেবে গড়ে তুলতে বিদ্যালয়টি জাতীয়করণ করার দাবী জানান তিনি।’

জোংড়া ইউনিয়নের সাবেক বাঁশকাটা ছিটমহলের শিক্ষার্থী ঈশিতা পারভীন তিথি বলেন, ‘আগে আমাদের পরিচয় গোপন রেখে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হয়েছিল। এখন ছিটমহল বিনিময় হওয়ার কারণে আগের মতো তথ্য গোপন রেখে পড়াশুনা করতে হয় না। এ ছিল আমাদের জীবনে এক অভিশাপ। আজ আমরা শুধু বাঙালিই নই, বাংলাদেশিও।’

পাটগ্রাম উপজেলার একই ইউনিয়নের পাশের মোমিনপুর বাঁশকাটা এলাকার কাঠ ব্যবসায়ী মন্টু ইসলামের তিন সন্তান। স্ত্রী মোছাঃ তুলি গৃহিনী। তাদের বড় মেয়ে মারুফা ইয়াছমিন মনিশা মির্জারকোর্ট হাজী মহিম উদ্দিন বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছে। সে পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষায় জিপিএ গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে। ভবিষ্যতে কী হতে চায় জানতে চাইলে সে জানায়, ‘আগে মানুষ আমাদের যেন কেমন চোখে দেখত। এখন ছিটমহল বিনিময় হওয়ার পর আমাদের সবকিছুই বদলে গেছে। আমি উচ্চ শিক্ষা অর্জন করে একজন আদর্শ শিক্ষক হবো। নারী শিক্ষায় সচেতনতা সৃষ্টিতে নিজেকে নিয়োজিত করবো।’

লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক আবুল ফয়েজ মোঃ আলাউদ্দিন খান বলেন, ‘সব বিভাগের নিবিড় তত্বাবধানে বিলুপ্ত ছিটমহলবাসীর ভাগ্য পরিবর্তনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ বরাদ্দে উন্নয়ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এসব উন্নয়ন কাজ চলতি অর্থবছরে শেষ করা হবে। এছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় হতদরিদ্রদের উপকার ভোগী হিসেবে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করা হচ্ছে।’ 

 

 

রাইজিংবিডি/লালমনিরহাট/১ আগস্ট  ২০১৭/মোয়াজ্জেম হোসেন/টিপু