ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

এতো ভালো লেখা ছিলো ভাগ্যে!

|| রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:০৯, ২৬ জুন ২০১৩   আপডেট: ০৮:৪৫, ১১ আগস্ট ২০২০
এতো ভালো লেখা ছিলো ভাগ্যে!

উদয় হাকিম
কক্সবাজার থেকে, ২৭ জুন:
উত্তাল সমুদ্র। বিশাল বিশাল ঢেউ। আছড়ে পড়ছে তীরে। ঢেউয়ের পেছনে ঢেউ। দোতলা সমান একেকটা। সাপের মতো ফণা। মাথায় সফেদ মুকুট। যেনো রূপোর জলে তৈরি।

নিম্নচাপ চলছে। চলছে তার প্রভাব। চলছে আবহাওয়া বিভাগের তিন নম্বর সতর্ক সঙ্কেত। এর মধ্যে কক্সবাজার এসেছি। অনেক দিনের ইচ্ছে- বর্ষাকালে, নিম্নচাপের প্রভাব বলয়ে সমুদ্রকে দেখব। সেটা অন্য কোথাও নয়; কক্সবাজারে এসে। ইচ্ছেটা এভাবে কাকতালে পূর্ন হয়ে যাবে ভাবিনি। কারণ এই যাত্রার তারিখ ঠিক করা সপ্তাহ খানেক আগে। এসময় যে নিম্নচাপ থাকবে জানতাম না। আবহাওয়ার বিষয়েও খোঁজ নিইনি।

যাকগে। এতো ভালো লেখা ছিলো ভাগ্যে!

কক্সবাজার পৌছলাম, ঘড়িতে বিকেল তিনটে। চট্টগ্রাম থেকে মাইক্রোবাসে এসেছি। চালককে বললাম, হোটেলে নয়। আগে চলো কলাতলী। দেরি হলে হবে। উত্তাল যৌবনা সমুদ্রকে আগে দেখে নিই। সূর্য ডোবার আগে আরেকবার দেখব। বৃষ্টি হলে ভিজে এসে দেখব।

কলাতলী মোড় থেকে সোজা চলে গেলাম সমুদ্রের কাছে। ভীষণ শব্দ। একটার পর একটা ঢেউ আছড়ে পড়ছে। দ্রাম দ্রাম করে শব্দ হচ্ছে। ভয় নয়, সে শব্দে এক ধরনের মুগ্ধতা। কারণ যত গর্জনই করুক; আমি সমুদ্রের পাড়ে দাঁড়ালেই আমার পায়ের কাছে ওদের আছড়ে পড়তে হবে।  

যে জায়গাটা লোকে লোকারণ্য থাকে, সেখানটা জনশূন্য। একটা কুকুর একাকী তাকিয়ে আছে ঢেউয়ের দিকে। হতে পারে কুকুরেরা ঢেউয়ের পাঠ নিয়ে নিকট ভবিষ্যত আঁচ করছে। কিম্বা ভাবছে- সবটুকু পানি যদি এক চুমুকে খেয়ে ফেলতে পারতাম!

পুরো আকাশ মেঘে ঢাকা। দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ থেকে দল বেঁধে মেঘ ছুটছে। এসময়ে সূর্য ওদের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারবে না। বৃষ্টি হচ্ছে থেমে থেমে। এই ধুম বৃষ্টি। এই নেই। মুরব্বীরা এ ধরনের মেঘকে বলেন আষাঢ়ে মেঘ। সময়টাও আষাঢ় কিনা!

আধ মিনিট চোখ বন্ধ রাখলাম। কান খোলা। শুনছি ঢেউয়ের ড্রাম। যেন আমায় অভিবাদন জানাচ্ছে। একটার পর একটা ঢেউয়ের ল্যাপ অপ অনার। চোখ খুললাম। এক চিলতে ‘হাওলাতে’ আলো পড়েছে পানির উপর। তাতে সৈকতের কয়েক কিলোমিটার জুড়ে যেন রজত জয়ন্তীর প্রস্তুতি। অদ্ভূত! এতো সুন্দর! সমুদ্র আর তার জল যেন সৃষ্টির অপার লীলা! নিরন্তর খেলা!

মনে পড়লো নেপালের কথা। ভোর বেলা ঘুম ভেঙ্গে দেখি বিশাল অন্নপূর্না চোখের সামনে! কি যে অবাক হয়েছিলাম। কক্সবাজারের সমুদ্র আগেও দেখেছি। কিন্তু এতো বড় ঢেউ! দেখিনি। এমনকি সমুদ্রের দেশ মালদ্বীপেও এত উঁচু ঢেউ দেখিনি।  

মুষলধারে বৃষ্টি। ভাবছি। আজ আর বেরোনো হবে না। কিন্তু খানিক বাদেই বৃষ্টি থামলো। আবার বোরোলাম। এবার লাবনী পয়েন্ট। এমনিতেই বর্ষাকাল। ট্যুরিস্ট কম। তার উপর নিম্নচাপ। বৃষ্টি। লোকজন কম। তারপরও যারা এসেছে তারা দেখছে ঢেউ সর্বস্ব সমুদ্রের রুদ্ররূপ।

ভাটা চলছিলো। এসময় সমুদ্রে নামা বিপজ্জনক। কেউ নামেনি অবশ্য। বড় জোর পা ভেজাচ্ছে। জাল নিয়ে ব্যস্ত সাহসী জেলেরা। বিকেলের খেলা শেষে ফিরছে খেলুড়ে ছেলেরা। সূর্য ডুববে। যদিও তার মুখ দেখার নাম নেই। সন্ধ্যার আগেই সন্ধ্যে নামাচ্ছে দাপুটে মেঘ আর প্রবল বাতাস। ঝড়ো বাতাসে ফাত ফাত করছে শক্ত ছাতাগুলো। দুএকটায় দেখা যাচ্ছে শরীর এলানো মাথাগুলো।

হাঁটু পানিতে দাঁড়ালাম। জল নেমে গেলে শুকনো। কোন লেখক যেনো বলেছেন, সমুদ্রের ঢেউগুলো যখন তার পায়ে এসে আছড়ে পড়ে; তখন মানুষ হিসেবে তার গৌরব জানান দেয়। কথাটা মনে পড়ে গেলো। প্রমত্ত ঢেউ আমার মতো নগন্য একজন মানুষের পায়ে মিনতি করছে। তার বিশালত্ব বিসর্জন দিচ্ছে। আসলে মানুষের চেয়ে বড় কিছুই নয়।
কিন্তু সমুদ্রের সৌন্দর্য! তার তুলনা নেই। মনে পড়লো নজরুলের কথা-‘হেরিতে তোমার রূপ মনোহর/ পেয়েছি এ আঁখি ওগো সুন্দর/ মিটিতে দাও হে প্রিয়তম মোর/ নয়নের সেই সাধ’! সমুদ্র দেখে সাধ মিটেছে, এ কথা বোধহয় কেউই বলতে পারবে না।

ছাতার নিচে মাথা দিয়ে বসে পড়লাম। ঘন্টায় ৩০ টাকা। মাথায় এলো- শুধু বৃষ্টিতে সমুদ্র দেখার জন্য একটা ট্যুরিস্ট প্যাকেজ হলে কেমন হতো? এই এক ঘন্টায় অনেক ভাবনার খোরাক জোগালো। ঘুরে আসলাম শৈশবে। কৈশোর পেরিয়ে যৌবন। জীবনের অনেক সুন্দর মুহুর্ত ঘুরে ফিরলাম বর্তমানে। প্রশ্ন করি নিজেকে। আমি কি সুখী? উত্তর আসে- আর কখনো না হলেও এই মুহুর্তে সুখী। সুখতো আপেক্ষিক। সুখ কেনা যায় না। কেবল ভাবতে হয়- হ্যা আমি সুখী। বলা সহজ। যদিও ভাবাটা সত্যিই কঠিন!

ফিরছি হোটেলে। কত কী ভাবনা মনে। অনেক ইচ্ছে ছিলো সমুদ্রের পাড়ে বৃষ্টিতে ভিজব। হলো না। আমি আসব বলে কি বৃষ্টি এলো না? আমিতো চেয়েছিলাম তাকে। সে আমার অন্যমুখী কোনো প্রেমিকা। বৃষ্টি তুমি ভুলে গেছো আমায়?
বৃষ্টি না এলেও এসেছিলো আরেকজন। সে আমার প্রেমিকা। যার সঙ্গে প্রথম এসেছিলাম কক্সবাজারে। সে-ও বছর দশেক আগের কথা। এবার সে এসেছে দুই কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে। ওই কন্যাদুটি অবশ্য আমাকেই বাবা বলে।  

চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার আসার পথে উপভোগ করেছি কর্ণফুলী ব্রিজ। খুব সুন্দর একটা স্থাপনা। উপভোগ্য এর দুপাশের দৃশ্যপট। পশ্চিমে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর। তাতে অসংখ্য জাহাজ ভিড়ে আছে। কোনোটা যাচ্ছে, কোনোটা আসছে। পূর্ব পাশে অসংখ্য ছোট-বড় জাহাজ। থেমে আছে মাঝ নদীতেই। বাংলাদেশের ব্যস্ততম নদী এই কর্ণফুলী।

চন্দনাইশ পর্যন্ত রাস্তা কিছুটা খারাপ থাকলেও একেবারে মন্দ না। মনে পেড়ে গেলো ব্যাংকক থেকে পাতায়া যাওয়ার রাস্তা। আট লেনের পথ। এক কথায় চমৎকার। শ্রীলঙ্কায় দেখেছিলাম কলম্বো থেকে গল যাওয়ার রাস্তা। এটি অবশ্য চার লেনের। ওরা এতো সন্দুর রাস্তা তৈরি করতে পারলে আমরা কেন পারব না। সামর্থ আছে। উদ্যোগ নেই। ঢাকা থেকে সরাসরি কক্সবাজার পর্যন্ত আট লেনের একটা সোজা রাস্তা করতে পারলে এই রাস্তা দেখার জন্যই মানুষ কক্সবাজার আসতেন।

চকোরিয়াতে দেখলাম গর্জন বাগান। সাইনবোর্ডে লেখা ‘১৯৬২ সালের গর্জন বাগান’। ভালো। কিন্তু আরো ভালো হতো এই বাগানটিকে ঘিরে একটি ট্যুরিস্ট স্পট করলে। দু’পাশে ছোট বড় অসংখ্য পাহাড়। প্রকৃতি আমাদেরও অনেক দিয়েছে। শুধু দেয়নি বুদ্ধি আর বিবেক। কারণ এখানে প্রকল্প শুরু হওয়ার আগেই দূর্নীতি, টাকার ভাগ বাটোয়ারা হয়ে যায়।

আজ নেগেটিভ কিছু বলব না। আমাদের দেশটা অনেক সুন্দর। প্রকৃতি আমাদের উজার করে দিয়েছে। আসুন দেশকে দেখি। দেশকে নিয়ে ভাবি। দেশটাতো মায়ের মতোই। মা কি আরেকটু ভালো থাকার দাবি রাখতে পারে না?

 

রাইজিংবিডি / আপলোড- কেএস

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়