ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

এভাবে বিদায় নেবেন ভাবিনি

সাইফ বরকতুল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:৪৮, ১৫ মে ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
এভাবে বিদায় নেবেন ভাবিনি

রিশিত খান

সাইফ বরকতুল্লাহ : ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬। আমরা পিকনিকে গাজীপুর গিয়েছিলাম ওইদিন। সেখানে কত আনন্দ করেছি। আমরা মেতে উঠেছি কবিতা, কৌতুক, গান আর আড্ডায়। সবার হৃদয়ের গহিন থেকে নিসৃত আনন্দের ঝিলিক ছিল চোখেমুখে। চেয়ার দখল, পিলো পাসিং, প্রতিযোগিতা শেষে অনুষ্ঠিত হলো র‌্যাফেল ড্র। অনেকেই পুরস্কার পেলেন। রিশিত দাও পেলেন। সবার মুখেই ছিল আনন্দ আর হাসির ঝর্নাধারা।  আর রিশিত দা (রিশিত খান) তো ছ্যাকা খাওয়া প্রেমিকের চরিত্রে অভিনয় করে সবাইকে মাত করে দিয়েছিলেন। আহ! সেদিনের কথা মনে পড়লেই রিশিতদার কথা মনে পড়ে যায়।

২০১৫ সালের পয়লা নভেম্বর, আমি রাইজিংবিডিতে যোগদান করেছি।  শুরুতে আমাকে ন্যাশনাল ডেস্কে কাজ করতে বলা হলো। তখন এই ডেস্কের ইনচার্জ রিশিত ভাই। অবশ্য রাইজিংবিডিতে যোগদানের আগে থেকেই আমাদের সম্পর্ক। নিউজ নিয়ে প্রায়ই কথা হতো। দুই মাস এই ডেস্কে ছিলাম। এরপর সেন্ট্রাল ডেস্কে চলে আসলেও রিশিতদার সঙ্গে কথা হতো নিয়মিত। প্রায়ই কাছে এসে বলতেন, সাইফ দেখেন তো হেডলাইনটা ঠিক আছে না কি? আবার মাঝে মাঝে এসে বলতেন সাইফ একটা নিউজ উঠেছে একটু রিডিং দিয়েন। আমিও তার অনুজ হিসেবে আগ্রহ নিয়ে দেখতাম। উনি খুবই খুশি হতেন।

নিভৃতচারী সাংবাদিক ছিলেন রিশিত খান। লেখালেখি আর সাংবাদিকতার সূত্রে তার সঙ্গে একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। রাইজিংবিডিতে প্রায় দুই বছর আমার সহকর্মী। একসঙ্গে আমাদের কতো স্মৃতি। অত্যন্ত বিনয়ী, সজ্জন একজন মানুষ। মুখে সবসময় হাসি লেগেই থাকতো। প্রাণোচ্ছ্বল। কথা বলতেন নিচু স্বরে। রাগ বলতে কিছু ছিল না তার। সবাইকে আপন করে নিতেন খুব সহজেই। সুখে-দুঃখে খোঁজ খবর নিতেন সব সময়।

রাইজিংবিডিতে বিকেলে শিফটে অফিস থাকায় প্রায়ই আমাদের অফিসে ঢোকার আগ মুহূর্তে দৈনিক বাংলা মোড়ে কথা হতো। সাড়ে তিনটায় অফিসে ইন করার আগে আমরা চায়ের দোকানে উনি সিগারেট আর আমি চা খেয়ে তারপর অফিসে ঢুকতাম। দেখা হলেই বলতো, সাইফ কী খবর? ছেলে কেমন আছে?

 

রাইজিংবিডি ডটকমের অফিসে নিজ ডেস্কে বসে কাজ করছেন রিশিত খান


এইতো মাত্র কয়েকদিন আগের কথা। সেদিনও চায়ের দোকানে দেখা। হাতে ম্যাগাজিন। জিজ্ঞেস করলাম রিশিত দা কী ম্যাগাজিন কিনলেন? উনি বললেন, ছেলের জন্য বিজ্ঞান বিষয়ক একটা ম্যাগাজিন আর শিশুতোষ ম্যাগাজিন একটা। প্রতিমাসেই উনি এটা করতেন।

প্রায়ই আমার লেখা পড়ে আমাকে ডেকে বলতেন, সাইফ বই করেন। বইমেলা আসলেই খবর নিতেন আমার কী বই বের হচ্ছে। রিশিত দা গল্প লিখতেন। তার অনেক গল্প ছাপা হয়েছে। পাশাপাশি ফিচারও লিখতেন। রাইজিংবিডিতে তিনি নিয়মিত কলাম লিখেছেন। সমকালীন প্রসঙ্গ নিয়ে  স্বকাল স্বদেশ নামে তার কলাম বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। এই কলামে নতুন কোনো বিষয় নিয়ে লেখার আগে আমাকে বলতেন সাইফ এই বিষয় নিয়ে লিখতে চাই কী বলেন? আমিও উৎসাহ দিয়ে বলতাম, দ্রুত লিখে ফেলেন।

২০১৪ সালের মার্চ-এপ্রিলের কথা। আমি সাব এডিটর কাউন্সিলের কার্যনির্বাহী সদস্য পদে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছি। আমাদের প্যানেলে তখন সভাপতি পদে প্রার্থী ছিলেন এনায়েত ফেরদৌস ভাই, রাইজিংবিডির শাহ মতিন টিপু ভাইও ছিলেন কার্যনির্বাহী সদস্য পদে প্রার্থী। সে সময় আমার জন্য অনেকের কাছেই ভোট চেয়েছিলেন রিশিত দা। তার আন্তরিকতা আজও মনে পড়ে। অথচ চলে গেলেন নীরবে।

বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন তিনি। ১৯৮৬ সালের দিকে দেশনাটক গ্রুপ থিয়েটারে কাজ করতেন। এক সময় গল্প লিখেছেন। কলাম লিখতেন। নাটক লিখেছেন। তার বোধ ছিল বেশ গভীর। মানুষের প্রতি ছিল অপরিসীম মমত্ববোধ। কারো অসুখের কথা শুনলেই সাহায্য করার চেষ্টা করতেন। কোনো সাংবাদিক বেকার হলেই তার চাকরির জন্য ছোটাছুটি করতেন। কিন্তু প্রাণবন্ত সেই মানুষটিই হঠাৎ করে এভাবে বিদায় নেবেন ভাবিনি। মাত্র  ৫২ বছরেই চলে গেলেন না ফেরার দেশে।

ফুসফুসে ক্যানসার হয়ছিল রিশিত দার। আক্রান্ত হয়েছিল লিভারও। কিন্তু রোগটি ধরা পড়েছিল কদিন হলো মাত্র। হাসপাতালে ভর্তি হলেন। যতদূর জানি তার কোনো সঞ্চয় ছিল না। আমরা সহকর্মীরা ও আমাদের প্রতিষ্ঠান রাইজিংবিডি তার জন্য কিছু করার উদ্যোগ নিলাম। ওয়ালটন থেকেও চিকিৎসা সহায়তার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এছাড়া আমি সাব এডিটর কাউন্সিলের বর্তমান কমিটির কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছিলাম রিশিত দার জন্য কিছু করা যায় কিনা। তারা আশ্বাসও দিয়েছিলেন।

১৩ মে শনিবার। বিকেলে অফিসে আমাদের মিটিং চলছিল। মিটিং শেষ হতেই বার্তাকক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল থেকে টেলিফোন আসল, রিশিত দা আর নেই। সবার মনটা মুহূর্তেই বিষণ্ন হয়ে গেল। অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন। মৃত্যুর খবর শোনা মাত্র হাসপাতালে ছুটে গেলেন জাহিদ স্যার (রাইজিংবিডির প্রকাশক এস এম জাহিদ হাসান), সম্পাদক নওশের আলী ভাই, চিফ রিপোর্টার হাসান মাহামুদ, তাপস রায়, রাসেল পারভেজসহ আরো অনেকে।

রাত বারোটা দশ। অফিস থেকে বাসায় পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে ভাত খেতে বসেছি। আমার ছেলে জিজ্ঞেস করল, আব্বু তোমার মন খারাপ? তখন রিশিত ভাইয়ের একমাত্র ছেলে সুপ্তের (ক্লাস এইটে পড়ে) কথা মনে পড়তেই দুচোখে পানি এসে গেল।

লেখক : সাহিত্যিক সাংবাদিক

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ মে ২০১৭/সাইফ/এনএ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়