ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

‘এহন তো আমি জিন্দা লাশরে বাবা’

রুমন চক্রবর্তী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:০২, ২৬ এপ্রিল ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘এহন তো আমি জিন্দা লাশরে বাবা’

কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি : অভাবের সংসারে বছরে একটা ফসলের দিকেই চাইয়া থাকি। ভালা ফলন হইলে বছরের বাকি দিনডি কোনরকমে যায়। অল্প জমাইন্যা টেহা আর এনজিও থেইক্যা ঋণ নিয়া জমি চাষ করছি। এহন তো আমি জিন্দা লাশরে বাবা। কেরা দেখব আমরারে!  - কথাগুলো বলছিলেন অষ্টগ্রাম উপজেলার আব্দুল্লাহপুর ইউনিয়নের আরেক কৃষক রমজান আলী।

একের পর এক বাঁধ ভাঙ্গা স্রোতে আর অব্যাহত বৃষ্টির তোড়ে থমকে গেছে হাওরবাসীর জীবনযাত্রা। কঠিন জীবন যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে অসহায় কৃষক ও তাদের পরিবার।

বিস্তৃত দিগন্তজুড়ে শুধু অথৈ পানির প্রবাহ। নিচে তার তলিয়ে আছে কৃষকের  সোনালী ফসল। বুক ভরা কষ্ট আর চোখে কান্না নিয়ে ভবিষ্যতের পানে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কোন পথই খোলা নেই তাদের কাছে। চলছে পরিবার পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকার লড়াই। খাদ্য সংকটের পাশাপাশি মহাজন ও এনজিওদের ঋণ নিয়ে হাওরের ধান চাষিরা এখন দুচোখে অন্ধকার দেখছে।

এদিকে বাঁচা মরার লড়াইয়ে সঙ্গে যোগ হয়েছে গবাদি পশু। প্রথমে নষ্ট হওয়া ধানের অংশবিশেষ গো খাদ্য হিসেবে ব্যবহার হলেও এখন তারও উপায় নেই। চলমান বৃষ্টির তোড়ে একের পর এক ডুবে গেছে বেঁচে যাওয়া ধান। এবার রোদের অভাবে পঁচতে শুরু করেছে পানি থেকে তুলে আনা আধা পাকা ধান।

বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো. আজিমুদ্দিন বিশ্বাস সংবাদ সম্মেলনে  জানান, জেলার হাওর বেষ্টিত  ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, করিমগঞ্জ, নিকলী, তাড়াইল, হোসেনপুর, কটিয়াদী, বাজিতপুর ও ভৈরবে অকাল বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সার্বিক সহযোগিতায় তারা বিভিন্ন টিম গঠন করেছেন। হাওরের প্রতিটি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে জরুরী মেডিক্যাল টিম কাজ করছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সঠিক তালিকা তৈরি করে সময় মতো ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রতিটি উপজেলা প্রশাসনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।

 


তিনি আরো জানান, হাওরের পানিতে কোন প্রকার ক্ষতিকারক ভাইরাসের প্রভাব রয়েছে কিনা তা পরীক্ষা করা হয়েছে। এদিক থেকে কিশোরগঞ্জের হাওরের পানি এখনও বিপদমুক্ত। এমন কোন  উপাদান পাওয়া যায়নি যার ফলে হাওরের মাছ বা গবাদি পশুর ক্ষতি হতে পারে।

কৃষি বিভাগের সূত্র মতে, জেলার হাওর বেষ্টিত অঞ্চল ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, করিমগঞ্জ, নিকলী, তাড়াইল, হোসেনপুর, কটিয়াদী, বাজিতপুর ও ভৈরবে এ বছর ১ লক্ষ ৩৮ হাজার ৯২ জন কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ দুর্যোগে কৃষকের আবাদকৃত ধানের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৬০ হেক্টর। টাকার হিসেবে যা প্রায় ৯০০ কোটি টাকা। তার মধ্যে অষ্টগ্রাম, ইটনা, মিঠামইন ও নিকলীতে ক্ষতির পরিমাণ অধিক।

জেলা প্রশাসনের সূত্রে জানা যায়, এ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক পরিবারকে  ৫৩৫ মেট্রিকটন চাল ও নগদ আটাশ লক্ষ ষাট হাজার টাকা বিতরণ করা হয়েছে। দুর্যোগকালীন সময়ে তিনমাস নিয়মিত পঞ্চাশ হাজার ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারকে ৩০ কেজি চাল ও নগদ ৫০০ টাকা করে দেওয়া হবে। এছাড়া আরো এক লাখ কৃষক পরিবারকে ওএমএস এর আওতায় এনে সহযোগিতা করার জন্য ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে আবেদন প্রেরণ করেছে জেলা প্রশাসন।

ইটনা উপজেলার জয়সিদ্ধি ইউনিয়নের ষাটোর্ধ্ব কৃষক রইছ আলী কাঁদতে কাঁদতে  বলেন, ‘দশ কানি জমিতে বোরো আবাদ করছিলাম, এখন সবডাই আমার পানির নিচে। কেমনে বাঁচমু, কি খায়া বাঁচমু, আর কেমনেই বা মহাজনের ধার দেনা দিমু। এখন তো পরিবার নিয়া মরণ ছাড়া উপায় নাই।’

মিঠামইন উপজেলার গোপদিঘী ইউনিয়নের সর্বহারা এক কৃষকের স্ত্রী জামিলা খাতুন বার বার মুর্ছা যাচ্ছেন আর যখনি তার জ্ঞান ফিরছে কান্নায় একাকার হচ্ছেন। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমরার অহন কিতা অইব। অত দেনা লইয়্যা জমিজামা কইরা এহন তো মরার পথে। অভাবের সংসারে কেমনে চলব, আর কেমনে দেনা দিয়াম।’

তবে ঋণের ব্যাপারে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, হাওর অঞ্চলে যে সকল এনজিও বা মহাজনরা কৃষকদের ঋণ দিয়েছে তাদেরকে আপাতত কৃষি ঋণ আদায় বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দুর্যোগকালীন সময়ে সকল প্রকার সহযোগিতার আহবান জানানো হয়েছে।

 

 

রাইজিংবিডি/কিশোরগঞ্জ/২৬ এপ্রিল ২০১৭/রুমন চক্রবর্তী/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়