ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

ঐতিহ্যের খাবার ‘পাতক্ষির’

শেখ মো. রতন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৪৫, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ঐতিহ্যের খাবার ‘পাতক্ষির’

মুন্সীগঞ্জ সংবাদদাতা : নাম তার পাতক্ষির। একমাত্র মুন্সীগঞ্জ জেলার সিরাজদিখান উপজেলার সন্তোষপুর গ্রামেই তৈরি হয় বিশেষ এই মুখরোচক খাবার।

বলা হয়, মুন্সীগঞ্জে ঐতিহ্যবাহী কোন আয়োজনে এ ক্ষিরের উপস্থিতি না থাকলে যেন অসম্পূর্ণ থাকে সে উৎসব। সব মৌসুমেই এর চাহিদা রয়েছে। বাঙালী ঐতিহ্যের পাটিসাপটা পিঠা তৈরিতেও প্রয়োজন হয় এ পাতক্ষিরের।

শুধু গাভীর দুধ থেকে তৈরি সুস্বাদু এই ‘পাতক্ষির’। এর চাহিদা এখন দেশের বাইরেও। যদিও ঘরে ঘরে সখে অনেকেই পাতক্ষির তৈরি করেন। সিরাজদিখান উপজেলার সন্তোষ গ্রামের মাত্র সাতটি পরিবার এখন পেশাদার হিসেবে এই ক্ষির তৈরির সাথে জড়িত।

তবে প্রথম পুলিনবিহারী দেবই তার স্ত্রীকে নিয়ে এ ক্ষির তৈরি করে বিক্রি করতেন বলে তার উত্তরসূরিরা জানান। সেও শতাধিক বছর আগের কথা। এ ছাড়া ইন্দ্র মোহন ঘোষ, লক্ষী রানী ঘোষও তৈরি করতেন এই ক্ষির। তারা সকলেই বর্তমানে প্রয়াত। এখন তাদের বংশধররাই এই পেশা ধরে রেখেছেন।

বর্তমানে এ পেশায় রয়েছেন,-কার্তিক চন্দ্র ঘোষ, ভারতী ঘোষ, সুনীল চন্দ্র ঘোষ, রমেশ শ্যাম ঘোষ, বিনয় ঘোষ, মদুসূদন ঘোষ, সমির ঘোষ ও ধনা ঘোষ। তবে সুনীল ঘোষের পরিবারের ৫ ভাই এ পেশায়।

পাতক্ষির তৈরিতে বেশি পারদর্শী পারুল ঘোষ জানান, প্রতিটি পাতক্ষির তৈরিতে ৩ কেজি দুধ প্রয়োজন হয়। আধা ঘন্টার বেশি সময় ধরে জ্বাল দিতে হয় এ দুধ। এ ক্ষির তৈরিতে দুধের সঙ্গে সামান্য (৫০ গ্রাম) চিনি ব্যবহার করা ছাড়া আর কিছুই ব্যবহার হয় না। তবে ডায়াবেটিক রোগীর জন্য বিশেষ অর্ডার থাকলে চিনিও দেওয়া হয়না। তারপর যখন দুধ ঘন হয়, সামান্য হলুদ ও চিনি মিশিয়ে চুলা থেকে নামানো হয়।  এরপর মাটির তৈরি পাতিলের মতো বিশেষ পাতিলে রাখা হয় এ ক্ষির। প্রায় ১ ঘন্টা পর ঠান্ডা হলে তা কলা পাতায় পেচিয়ে বিক্রয়যোগ্য করা হয়।

তবে হাতের যশ ও কৌশল ক্ষির তৈরিতে কাজে লাগাতে হয়। ঘন করতে গেলে চুলোয় দুধে পোড়া লেগে যায়। তাই কাঠের বিশেষ লাঠি দিয়ে নাড়তে হয় দুধ অনবরত।আর ‘পাতা’ নিয়েই এর নামকরণ। হ্যাঁ, ক্ষির তৈরি সম্পন্ন হওয়ার পর এ ক্ষির কলা পাতায় জড়িয়ে থাকে বলেই এ ক্ষিরের নাম হয়েছে পাতক্ষির।

কেবল সুনীল ঘোষের বাড়িতেই প্রতিদিন এ ক্ষির তৈরি হয় ৫০ টিরও বেশি। প্রতিটি ক্ষিরের ওজন প্রায় আধা কেজি। প্রতি পাতক্ষিরের দাম ২৫০ টাকা। বাজারে দুধের দাম বেড়ে গেলে বেড়ে যায় ক্ষিরের দামও।

ঘরের বউরা এ ক্ষির তৈরিতে কষ্ট করেন সবচাইতে বেশি। অনেক পরিশ্রমের পর তৈরি হয় এ ক্ষির। তবে প্রতিটিতে ১০ থেকে ২০ টাকার বেশি লাভ হয়না। দোকানে নিয়ে বিক্রি ছাড়াও মুন্সীগঞ্জসহ রাজধানী ঢাকার বাসিন্দারা বাড়িতে এসেও অর্ডার দিয়ে পাতক্ষির কিনে নিয়ে যান।

পাতক্ষির কারিগর নয়নতারা ঘোষ জানান, আমেরিকা, ইতালি, জার্মান, ফ্রান্স ও জাপান থেকেও এ ক্ষিরের অর্ডার আসে।

পারুল ঘোষ বলেন, ‘আমরা কষ্ট করে এ ক্ষির তৈরি করলেও আমাদের মেয়েদের তা শিখাইনা। কারণ তারা বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, কলেজে পড়ে। তবে এ বাড়ির বৌ হিসাবে যারা আসেন তাদেরই এ কাজ করতে হয়।’

পাতক্ষির মুন্সিগঞ্জের জনপ্রিয় একটি নাম। স্থানীয় সংসদ সদস্য সুকুমার রঞ্জন ঘোষ বলেন, ‘এই জনপদে ঐতিহ্যের খাবারের নাম এলেই পাতক্ষিরের নাম আসে সবার আগে। তাই এই কাজের সঙ্গে জড়িতদের পৃষ্ঠপোষকতা করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।’



রাইজিংবিডি/মুন্সীগঞ্জ/২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/শেখ মোহাম্মদ রতন/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়