ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

উপকূলের পথে

‘ওই গাঙ আমাগো সব লইয়া গ্যাছে’

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৩১, ২৩ জানুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘ওই গাঙ আমাগো সব লইয়া গ্যাছে’

রফিকুল ইসলাম মন্টু, ভোলার চরফ্যাসনের ঢালচর ঘুরে : অলস শীতের সকাল। পুব আকাশে সূর্যের তেজ ক্রমে বাড়ছে। ভদ্র পাড়ায় মানুষের তেমন কোনো ব্যস্ততা নেই। শিশুরা খেলছে; বড়দের কেউ রোদে পিঠ এলিয়ে কিছুটা সময় পার করছেন; কেউ কেউ আবার জাল মেরামত কিংবা ঘরের অন্যান্য কাজে ব্যস্ত। ভোলার চরফ্যাসনের সর্বদক্ষিণে দ্বীপ ইউনিয়ন ঢালচরের প্রাণকেন্দ্র আবদুস সালাম হাওলাদার বাজার থেকে দক্ষিণে এই ভদ্র পাড়ার মানুষের মনেও শান্তি নেই। এমনটাই বোঝা গেল এখানকার বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে।

‘ওই গাঙ আমাগো সব লইয়া গ্যাছে’- আক্ষেপের সঙ্গে কথাগুলো বলছিলেন রিনা বেগম। বয়স কতই বা ৪৫-৪৬ ছুঁয়েছে হয়তো। স্বামী জালাল ফরাজীকে হারিয়েছেন আরও দশ বছর আগে। তিন ছেলে সোহাগ, সালাহউদ্দিন আর সাদ্দামকে ঘিরেই তার জীবন। এরা সবাই অন্যের নৌকায় মাছ ধরে। তিন ছেলেই ছোটবেলা থেকেই ভাঙনের চিত্র দেখতে দেখতে বড় হয়েছে। রিনা জানালেন, ভাঙন তাদের নিঃস্ব করে দিয়েছে।

ভোলার বোরহানউদ্দিনের হাকিমুদ্দিন উদয়পুর রাস্তার মাথায় ছিল জালাল ফরাজীর (রিনা বেগমের স্বামী) বাড়ি। প্রায় ৩৫ বছর আগে রিনা বেগমকে নিয়ে ঢালচরের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের মোহাম্মদপুরে ঘর বাঁধেন জালাল ফরাজী। প্রথম গড়া সেই বসতবাড়ি অনেক আগেই নদীর গর্ভে হারিয়ে গেছে। তারপর আরও দু’বার বাড়ি বদল করতে হয়েছে। একদিকে ছেলেরা মাছধরা পেশায়; অন্যদিকে আর্থিক স্বচ্ছলতা নেই। দুই কারণে এই পরিবারটি এই ঢালচরের ভাঙন তীরে মাটি আঁকড়ে আছে। তিনবার ভাঙনে ঠাঁই হয়েছে ভদ্র পাড়ায়; এর পরের বার কোথায় যাবেন জানেন না।

সেইসব পুরনো স্মৃতি মনে করে রিনা বেগম বলছিলেন, সে সময় নদীতেও মাছ ছিল, আবার জমিতে চাষাবাদ করেও বেশ আয়-রোজগার হয়েছে। ধান থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের ফসলের আবাদ হতো জমিতে। কিন্তু সেসব এখন অতীত। এখন বছরজুড়েই সংসারের টানাটানি। ধারদেনা করে চালাতে হয় সংসার। একদিকে নদী ভাঙন; অন্যদিকে অকালে স্বামীর প্রয়ান রিনা বেগমকে কঠিন সমস্যায় ফেলে। মহাজনদের কাছে দেনা আছে প্রায় লাখ টাকা।

শীতের সকালের তেতে ওঠা রোদে পিঠ এলিয়ে বাড়ির সমানে জাল মেরামত করছিলেন ভদ্র পাড়ার বেলাল হোসেন। বয়স চল্লিশের কোঠায়। নিজের কাজে মনযোগ রেখেই বেলাল বলছিলেন, এক সময় গৃহস্থালির কাজ করলেও এখন তাকে জীবিকার তাগিদে নদীতে নামতে হয়েছে। বড় ভাই নীরব আর ছোট ভাই জাহাঙ্গীরও একই পেশায়। দুই ভাই এক ট্রলারে মাছ ধরেন; আরেক ভাই বরফের ব্যবসা করেন। অথচ এরা সকলেই এক সময় নিজেদের জমিতেই চাষাবাদ করতেন। জমি ছিল প্রায় ১৫ একর। আর এই চাষাবাদে নেতৃত্ব দিতেন বাবা সালাহউদ্দিন রত্তন। সেসব এখন অতীত স্মৃতি।



বেলাল হোসেন বলছিলেন, পুরনো দিনের কথা মনে করে লাভ কী? ভাগ্যে নাই। তাই সব নিয়া গেছে গাঙ। চাইলে গাঙই আবার দিতে পারে। আগে জমিতে চাষাবাদ করতাম; আর এখন হারিয়ে যাওয়া সেই নদীর স্থানে বয়ে যাওয়া নদীতে মাছ ধরি। জমিতে ভালো ফসল পাওয়ার আশায় আল্লাহকে ডাকতাম, এখন নদীতে বেশি মাছের আশায় আল্লাহকে ডাকি।

ভাঙনের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় গাছ বেচাকেনা ভালো পেশায় পরিণত হয়েছে বলেই মনে হলো ভদ্র পাড়ার কালু মাঝির সাথে কথা বলে। ঢালচরের ভাঙন কবলিত মানুষগুলো বাড়ি বদলের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির গাছপালাও কেটে ফেলছেন। এই গাছ বিক্রির আবার একটি বাজার তৈরি হয়েছে। অনেকেই কম দামে গাছ বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। সেই গাছের ব্যবসায় জীবিকা চলে কালু মাঝির পরিবারের।

কালু মাঝি জানালেন, প্রায় ৩০ বছর আগে ঢালচরে এসেছিলেন। ১২ শতাংশ জমি কিনে ভদ্র পাড়ায় এই বাড়িটি কিনেছিলেন। তখন এ বাড়ি থেকে নদী ছিল অনেক দূরে। কিন্তু নদী ক্রমেই নিকটে চলে আসছে। নিজের দেখা সেকালের ঢালচরের বিবরণ তুলে ধরে তিনি বলছিলেন, তখন চরে ভাঙন ছিল না। চারদিক থেকে এ চর প্রাকৃতিকভাবেই ঢালু ছিল। ফলে ভাঙন আঘাত করতে পারেনি। কিন্তু গত কয়েক বছরে ভাঙনের তীব্রতা অস্বাভাবিক বেড়েছে। আমরা শঙ্কিত, এই বাড়ি ভেঙে গেলে কোথায় যাবো?

ভদ্র পাড়ার আরেক বাসিন্দা হাসনা বিবি। বয়স ত্রিশের কোঠায়। স্বামী মনির হোসেন এবং সন্তানসহ হাসনা বিবির ঠাঁই হয়েছে বাবা ছোমেদ মোল্লার ঘরে। স্বামী মনির হোসেন চা-দোকানে কাজ করে। অথচ আগে বাবার জমিতে চাষাবাদ করেই মনিরের সংসার চলতো। এখন চাষাবাদের জমি তো নেই-ই; থাকার ভিটেও নেই। হাসনা জানাচ্ছিলেন, শেষ সম্বল বাড়ির ভিটেটুকু নদীতে ভেঙে যাওয়ার পর বাবার ঘরে ঠাঁই নিয়েছেন। এক সময় অনেক জমির মালিক তার শ্বশুড় শাহজাহান মিয়া ঢালচর ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন।

আজ কোনো কাজ নেই। কী করবেন জানেন না ভদ্র পাড়ার বাসিন্দা মাছুম খান। বয়স ত্রিশ পেরিয়েছে। মূল বাড়ি ছিল চরফ্যাসনের মূল ভূ-খণ্ডে। প্রথম ঘর বাঁধের ঢালচরের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের মোহাম্মদপুরে। দু’বার বাড়ি বদল করেছেন। অবশেষে ঠাঁই হয়েছে এখানে। তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে এখন ঢালচরের এই পাড়ায় থাকেন। হাতে তেমন কাজ না থাকায় বেশ কয়েকদিন ধরে অলস সময় কাটছে তার।



ভদ্র পাড়াটি ঢালচর ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের আওতায়। এই পাড়ার প্রায় সাড়ে তিনশ ঘরে প্রায় ২ হাজার মানুষের বাস। এদের অধিকাংশই নদী ভাঙনের শিকার। কেউ দু’বার, কেউ তিন বার বাড়ি বদল করেছেন। ভাঙনের কারণে সর্বস্ব হারিয়েছেন অনেকেই। এক সময়ের সচ্ছল পরিবারগুলো পথে বসেছে। কাজ নেই। তিনবেলা পেটভরে খাবার যোগাড় করা অনেকের পক্ষেই কষ্টকর। এক সময় এইসব পরিবারের সেই উচ্ছ্বলতা এখন আর নেই। দ্বীপের বয়সী ব্যক্তিরা সেদিনের কথা মনে করে চোখের পানি ফেলেন।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ জানুয়ারি ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়