কবির সচেতন মন ও ভাবনায় স্বাতন্ত্র্যের ছাপ
সাইফ বরকতুল্লাহ : কাব্যগ্রন্থটি হাতে পেয়ে মনে হলো কবিতাগুলো মনে হয় কিছু একটা বার্তা দিয়ে যায়। যা সাধারণ মানুষের মনকে এড়িয়ে যায়।
বর্তমান প্রযুক্তির এ বিশ্বে মানুষ ছুটছে রকেটের গতিতে। কোথাও থামবার সময় কোথায়। কিংবা অন্য ভাবনারও সময় নেই। আমাদের চারপাশ, সমাজ, সংগ্রাম, জীবনচিত্র বিপর্যস্ত। এর মধ্যেও অন্য একটি চিন্তা কিংবা উপাদান নিয়ে এসেছেন কাজী জহিরুল ইসলাম।
তার ‘উটপাখিদের গ্রামে উড়ালসভা’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোতে এ স্বাতন্ত্র্যের ছাপ স্পষ্ট। বিশ্লেষণ ও ভাবনা কবিতাগুলোকে সজাগ রেখেছে। বিচক্ষণ দৃষ্টি ধরা পড়েছে। কবিতার ভাবনার স্তরকে ছোঁয়া যায়। যেখানে মিশেছে সম্পর্কের প্রস্তাব ও আকাঙ্ক্ষা।
কাজী জহিরুল ইসলাম লিখেছেন,
‘প্লিজ, আমার ঘাড়ে!
আমি তো বলিনি কখনো, ওকে আচ্ছা করে ঝাড়ুন।
সে আপনার ইচ্ছে,
যা করার করে নিন, একা একা নিজ দায়িত্বে সারুন।
ধ্যাত কাপুরুষ!
গোঁফে তা দিন। আর ঘরে বসে ওই যে ওটা, ডিম, পারুন।’
[উটপাখিদের গ্রামে উড়ালসভা, পরকীয়া, পৃষ্ঠা ৯]।
কবিতার জগতে কাজী জহিরুল ইসলাম একটি স্বতন্ত্র নাম। তার কবিতা লেখার মুনশিয়ানা নিয়ে প্রশ্ন উঠাই বাতুলতা। এক আশ্চর্য উপযুক্ত ভাষা তার করায়ত্ত। মনের ভাবনাকে রং তুলির আচঁড়ে নিবিড়ভাবে চিত্রায়িত করে যান কবিতার শরীর।
তিনি লিখেছেন,
‘এখন ডানা গোটানো দিন চায়ের কাপে বর্ষা নেই
দিন-রাত্রি একই রকম ঝাপসা দেখি ফর্সাতেই।’
[উটপাখিদের গ্রামে উড়ালসভা, এখন দিন-রাত্রি, পৃষ্ঠা ৩৭]।
কিংবা,
‘বুকের ভেতর গোমতির জল, ইচ্চেমতো ডুবাও
গাঙের জলে তিয়াস বাড়ে,
পেছন থেকে ডাকছে তারে কোন রূপসী উবাও?’
[উটপাখিদের গ্রামে উড়ালসভা, উবাও, পৃষ্ঠা ৫৬]।
উবাও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আঞ্চলিক শব্দ। এর অর্থ দাঁড়াও।
কবিতা যেন সময়চিত্রের কথা বলে যায়। উটপাখিদের গ্রামে উড়ালসভা গ্রন্থে কবি অনুভব করেছেন জীবনের সদর্থক ও সময়। কবিতাগুলোতে এক ধরনের দেয়াল গড়ে তুলেছেন শব্দ দিয়ে। কবিতাগুলো পড়লে মনে হয় কবির ঝোঁক অভিনবত্বের দিকে। তিনি লিখেছেন,
‘শন শন বাতাস, কাচে, শার্শিতে মাতাল দুঃশাসন
মরা ডালে মর্মর প্রহর, ভেঙে পড়ে মার্চের উঠোনে
ইলেকট্রিক পোল থেকে আকাশে লাফ দেয় কাঠবেড়ালি
ছায়া মানুষেরা আলো পোহায় আর রোদের কনসার্ট শোনে।’
[উটপাখিদের গ্রামে উড়ালসভা, ছায়ামানুষের রোদের কনসার্ট শোনে, পৃষ্ঠা ২৫]।
কবিতা কী নিছক কবিতা, নাকি চমকপ্রদ শব্দের বুনন? নাকি চেতনা নিংড়ে শিল্পের এক মঞ্চায়ন? কবিতা মানেই আধুনিকতা। যার সঙ্গে মনের বিমূর্তকে জাগিয় তোলে। কবি পৌঁছে যান পাঠকের হৃদয়ে। কাজী জহিরুল ইসলামের কবিতা তেমনি। তার কবিতা রোমান্টিক, বিষণ্ণ। যেমন, ‘তোর গায়ে কেন লাগলো কালি, পথের ধুলি?, আজ রাতে চোখ ছুঁড়ছি, ওপারে ভিসা নেই, দেখো ওই দুটো নীল’।
উটপাখিদের গ্রামে উড়ালসভা কবির ১৫তম কাব্যগ্রন্থ। এই গ্রন্থে কবিতাগুলো নতুন আঙ্গিকে চিত্রায়িত করেছেন। ভাঙতে চেয়েছেন কবিতার অবয়ব। পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভেতর কবিতাকে নতুন রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। যেমন,
‘মেয়েদেরই বুঝি ট্রেন ছেড়ে যায়? চেচিয়ে ডেকেছিলাম, দাঁড়া না।
পেছন ফিরে তাকিয়েছিলাম বটে, কিন্তু থামে নি, তারানা।’
[উটপাখিদের গ্রামে উড়ালসভা, তারানা, পৃষ্টা ৩০]।
কিংবা,
‘মাথায় বারুদ নিয়ে দেশলাইয়ের কাঠিগুলো হেঁটে বেড়ায় কী বিপজ্জনক,
সারি সারি দেশলাইয়ের কাঠি, আমি হাঁটি আর দেখি, দেখি আর হাঁটি।’
[উটপাখিদের গ্রামে উড়ালসভা, দেশলাইয়ের কাঠি, পৃষ্ঠা ৩৯]।
কবিতার পাশাপাশি বইটি সবার মনোজগৎকে নাড়া দিয়েছে প্রচ্ছদ। চমৎকার প্রচ্ছদ করেছেন রাগীব আহসান। উটপাখিদের গ্রামে উড়ালসভা নাম যেমন স্বাতন্ত্র্যের ছাপ বুঝা যায় তেমনি উট আর গাছের সংমিশ্রণে অসাধারণ চিত্র এঁকেছেন প্রচ্ছদে।
৫৬ পৃষ্ঠার বইটির বাঁধাই, ইলাস্ট্রেশন এবং প্রোডাকশন চমৎকার হয়েছে। তবে আমার মনে হয় মনে বানানের ক্ষেত্রে সচেতন পাঠককে আহত করেছে। বেশ কিছু বানান ভুল রয়েছে। যেমন, বিপদজনক (বিপজ্জনক), দূর্ঘটনা (দুর্ঘটনা), ফর্শা (ফর্সা), দু:শাসন (দুঃশাসন)- এ রকম কিছু বানানে আরো যত্মবান হওয়া দরকার ছিল। আশা করি প্রকাশক বিষয়টি দেখবেন।
পরিশেষে বলবো, কাব্যগ্রন্থটি পাঠককে নতুন ভাবনায় নিয়ে যাবে।
উঠপাখিদের গ্রামে উড়ালসভা
প্রকাশ : এপ্রিল ২০১৭
প্রকাশন : তিউড়ি
প্রচ্ছদ : রাগীব আহসান
দাম : ১৫০ টাকা
রাইজিংবিডি/ঢাকা/৯ জুন ২০১৭/সাইফ/সাইফুল
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন