ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

কাঠমান্ডুর কাণ্ড

শান্তা মারিয়া || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:০১, ২২ মে ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কাঠমান্ডুর কাণ্ড

(লক্ষ্মণ রেখার বাইরে-১৬)

শান্তা মারিয়া : সেই কোন ছোটবেলায় ফেলুদার অ্যাডভেঞ্চার পড়েছিলাম ‘যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে’। তারপর থেকেই নেপালে যাবার ইচ্ছা ছিল প্রবল। আমি সত্যজিৎ রায়ের এবং তাঁর অমর সৃষ্টি ফেলুদা ও প্রফেসর শঙ্কুর দারুণ ভক্ত। প্রফেসর শঙ্কু তো চষে বেরিয়েছেন বিশ্ব। ফেলুদা সেই তুলনায় শুধু ভারতের বিভিন্ন শহর আর নেপাল, হংকং, ইংল্যান্ডে তার গোয়েন্দাগিরি করেছেন। ফেলুদাকে অনুসরণ করা তাই তুলনামূলক সহজ। বাড়ির পাশে নেপাল আর ঘরের পাশে কাঠমান্ডু।

সেখানে প্রথম যাওয়া হলো ২০০৮ সালের অক্টোবর-নভেম্বরে। পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোট উইক্যানের একটি সম্মেলন হচ্ছিল নেপালে। সেখানে দক্ষিণ এশিয়ার ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলংকা থেকে প্রতিনিধি দল অংশ নিচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে আমাদের চারজনের একটি দল পাঠানো হলো। সেই দলে আমি, মাহমুদ সেলিম ভাই, জয়পুরহাটের শাহীনভাই এবং ঢাকার খুজিস্তা বেগম জোনাকি অংশ নেই। আমি টিম লিডার। তাই দায়িত্ব প্রচুর। সেইসঙ্গে পারিবারিক নির্যাতনের উপর একটি পেপারও প্রেজেন্ট করতে হবে।



নেপালে পুনরায় যাওয়া হয় ২০১৬ সালের অগাস্ট-সেপ্টেম্বরে। এবার নেটজ বাংলাদেশের একটি কর্মশালায় অংশ নেই আমরা কয়েকজন। দুইবারের নেপাল ভ্রমণের অভিজ্ঞতা খুব সুন্দর। প্রথম দেখাতেই কাঠমান্ডুর প্রেমে পড়ে যাই। নভেম্বরে যখন গেলাম তখন বৃষ্টির মৌসুম শেষে শীত আসি আসি করছে। হেমন্তে তখন কাঠমান্ডুর উপত্যকা জুড়ে আগুন রঙের ছড়াছড়ি।পাহাড়ি পত্রপতনশীল গাছের পাতায় পাতায় হলুদ, কমলা, লাল রঙের বাহার। সেই সঙ্গে রয়েছে হিমালয়ের শোভা। সেবার আমরা ছিলাম হোটেল এভারেস্ট-এ। ঘরের জানালা দিয়ে দেখা যায় মাউন্ট এভারেস্ট। দেখলে গা ছম ছম করে। পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু শৃঙ্গ যেন একক নিঃসঙ্গতায় দাঁড়িয়ে আছে। কাঠমান্ডুর প্রায় সব জায়গা থেকেই অবশ্য ওই সময় এভারেস্ট দেখেছি। কিন্তু পরের বার যখন গেলাম বাদলার দিন তখনও কাটেনি। আকাশে মেঘের ঘনঘটা। তাই এভারেস্ট দেখতে পাইনি একদিনের জন্যও। অবশ্য ঢাকা থেকে প্লেনে কাঠমান্ডু যাওয়ার পথেই দেখেছি এভারেস্ট, অন্নপূর্ণা, কাঞ্চনজঙ্ঘা, মাকালুর বিখ্যাত শৃঙ্গ।

একদিকে প্রকৃতি অন্যদিকে বিখ্যাত সব ঐতিহাসিক স্থাপনা। কাঠমান্ডুর প্রেমে না পড়ে আমার উপায় ছিল না। দু’বারই সঙ্গে ছিল ‘যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে’। তাই ফেলুদা, জটায়ু আর তোপসের দেখা জায়গাগুলো খুঁজে বের করতে সমস্যা হয়নি মোটেই। নেপালে পোর্ট এন্ট্রি। ভিসার বালাই নেই। অবশ্য কেউ চাইলে ঢাকার নেপাল দূতাবাস থেকে ভিসা নিয়ে যেতে পারেন। প্রথমবার দেখেছিলাম গোছানো কাঠমান্ডু। পরের বার ভূমিকম্প বিধ্বস্ত। তবে তখনও মোটামুটি ভূমিকম্পের ক্ষয়-ক্ষতি কাটিয়ে নতুনভাবে ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো গড়ে তোলার কাজ চলছে ভালোভাবেই।

দুই হাজার বছরের প্রাচীন শহর কাঠমান্ডু।‘কাষ্ঠ-মণ্ডপ’ মন্দিরের নাম অনুসারে এর নাম। মন্দিরটি শহরের প্রাণকেন্দ্র দরবার স্কোয়ারে অবস্থিত। প্রথমবার সেটি অক্ষত দেখলেও পরের বার দেখেছি ভেঙে পড়েছে অনেক অংশ। পুরো মন্দির কাঠের তৈরি। একটি বড় গাছ থেকে নাকি পুরো মন্দিরটি কেটে বের করা হয়। ভূমিকম্পের ধ্বংসলীলার পরও কাঠের কারুকার্য যা দেখলাম তাতে চোখ ফেরানো মুশকিল।



২০১৬ সালে ছিলাম থামেল এলাকায় হোটেল মারশিয়াংদিতে। এভারেস্ট হোটেলের মতো বড় নয় এটি। তবে মোটামুটি ভালোই। সবচেয়ে বড় কথা হলো এটি থামেলে। থামেল একেবারে হার্ট অব দ্য সিটিতে। এখান থেকে পায়ে হেঁটে দরবার স্কোয়ারসহ অনেক জায়গাতেই যাওয়া যায়। যারা বেড়ানোর জন্য নেপাল যাবেন তাদের প্রতি আমার পরামর্শ হলো, অবশ্যই থামেলের কোনো হোটেলে থাকবেন। তাহলে ট্যাক্সিসহ সব রকম যানবাহন সহজে পাবেন।

কাঠমান্ডুতে দেখার জায়গার অভাব নেই। পশুপতিনাথের মন্দির, স্বয়ম্ভূনাথের স্তূপ, বুদ্ধনাথ, বুদ্ধনীলকণ্ঠ, রাজপ্রাসাদ, কালভৈরব, শ্বেতভৈরবের মন্দির তো আছেই। আর শহরের কাছাকাছিও রয়েছে অনেক দেখার মতো জায়গা। পুরো শহরে ফাইভ স্টার, থ্রি স্টার ও সাধারণ মানের হোটেলের ছড়াছড়ি। রেস্টুরেন্ট, পানশালা, রেস্ট হাউজেরও কমতি নেই।

ঝামেল হলো শহরের আরেকটি প্রাণচঞ্চল এলাকা। থামেলের সঙ্গে মিল রেখে এর নাম হয়েছে ঝামেল। এর আসল নাম ঝচেনটল বা ফ্রিক স্ট্রিট। এখানেও নানা মানের হোটেল, রেস্টুরেন্ট, রেস্ট হাউজ, দোকানপাট আছে। আসানবাজার নামের এলাকাও কেনাকাটার জন্য ভালো। ২০০৮-এ আমার কাঠমান্ডু সফর শুরু হলো পশুপতিনাথের মন্দির দিয়ে। হোটেল এভারেস্ট থেকে শাটল বাসে সরাসরি গেলাম মন্দিরে। শহরের যে কোনো প্রান্ত থেকেই অবশ্য পশুপতিনাথের মন্দিরে যাওয়ার জন্য রয়েছে ট্যাক্সি আর বাস। রেন্ট-এ কারের ব্যবস্থাও আছে। আর আছে রিকশা। আমি পশুপতিনাথের মন্দিরে একবারই গেছি। পরের বার যখন নেপাল গেলাম তখন আর মন্দিরে যাবার সময় হয়নি।



পশুপতিনাথের মন্দির বিশাল এলাকাজুড়ে। পশুপতিনাথ হলেন শিব বা মহাদেব। তাই মন্দিরে নন্দী মূর্তি থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। পঞ্চম শতাব্দীতে এই মন্দির তৈরি হয়। হাতের ব্যাগ কাউন্টারে জমা দিয়ে, জুতো খুলে মন্দির চত্বরে ঢুকতে হয়। মূল চত্বরে ঢুকে প্রথমেই চোখে পড়লো বিশাল নন্দী মূর্তি। এটি সোনায় মোড়ানো। মন্দিরের বিশাল ছাদও সোনায় মোড়া। ফলে দূর থেকেই ঝলমল করে পুরো মন্দির। নন্দী মূর্তির বিশালত্ব দেখে তো চোখ ট্যারা হয়ে যাবার উপক্রম! মূল মন্দিরের ভিতরে রয়েছে গর্ভগৃহ। সেখানে শিবলিঙ্গ। সেখানে হিন্দু ধর্মালম্বী ছাড়া প্রবেশ করা যায় না। আমার কপালে বড় লাল টিপ দেখে প্রহরী কোনো প্রশ্ন করেনি। আমিও দিব্যি অন্য সবার মতো চৌকাঠে প্রণাম ঠুকে ঢুকে পড়লাম ভিতরে। কারণ আমি তো আর কোনো ক্ষতি করতে যাচ্ছি না। দেখাটাই প্রধান উদ্দেশ্য। আমার সহযাত্রীরা অবশ্য গর্ভগৃহে ঢুকতে পারেননি। বিশাল এলাকাজুড়ে প্রতিষ্ঠিত এই মন্দিরের তিন তলায় রয়েছে একটি মূল মন্দির। একই চত্বরে রয়েছে আরও বেশ কয়েকটি মন্দির। ভারত, বাংলাদেশ ও নেপালের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে পরম পবিত্র এই স্থান। তাই তীর্থযাত্রীদের ভিড় লেগেই আছে।

মন্দিরের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে বাগমতী নদী। শীর্ণতোয়া। এই নদীর তীরে মন্দিরের সঙ্গেই রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শ্মশান। শ্মশানে চিতায় মৃতদেহ দাহ করা হচ্ছে। দূর থেকেই চোখে পড়ে সেই আগুন। মনটা বিষণ্ন হয়ে যায়। তখন সন্ধ্যা নামছে ধীরে ধীরে। মন্দিরে আরতির ঘণ্টা বাজছে। সেই শব্দে মনটা চলে যায় সুদূর অতীতে। প্রাচীন ভারতবর্ষ যেন ভেসে ওঠে চোখের পাতায়। বৈশালী, লিচ্ছবি, শ্রাবস্তি কত শত নাম। সেলিমভাই মনে করিয়ে দেন হোটেলে ফিরতে হবে আমাদের। প্রাচীন যুগ ছেড়ে যেন ফিরে আসতে বাধ্য হলাম বর্তমানে। সেলিমভাইও তাঁর চমৎকার কণ্ঠে গুনগুন করে ধরলেন, ‘আমার সকল দুখের প্রদীপ’।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২২ মে ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়