ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

কান্না লুকিয়ে ওরা আনন্দ দেয়

আমিনুর রহমান হৃদয় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১১, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কান্না লুকিয়ে ওরা আনন্দ দেয়

আমিনুর রহমান হৃদয়: জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কঠিন সব শারীরিক কসরত দেখিয়ে তারা দর্শককে আনন্দ দেন। কিন্তু আনন্দময় জীবনের সন্ধান নিজেরা পান না। এ সময় দুর্ঘটনার সম্মুখীনও হন অনেকে। তারপরও জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে, কিছুটা পেশার প্রতি ভালোবাসার কারণে সার্কাসে খেলা দেখিয়েই জীবনের কঠিন পথ পাড়ি দেন তারা। 

কেউ সাইকেল নিয়ে, কেউ ঝুলন্ত দড়ির ওপর শরীর নিয়ন্ত্রণ করে হেঁটে নানা খেলা দেখান। শুধু তাই নয়, আরো বিভিন্ন ধরনের খেলা তাদের দেখাতে হয়। নইলে যে দর্শকের হাততালি জোটে না, তারা বিনোদিত হন না পুরোপুরি। তখন সার্কাসও জমে না। খেলায় যত টানটান উত্তেজনা থাকবে দর্শক ততো আনন্দিত হবেন। জমে উঠবে সার্কাস। যে কারণে জীবনের পরোয়া না করে দক্ষ বাজিকরের মতো একজন চোখ বেঁধে ছুড়ে মারেন চাকু। সেই চাকুর সামনে অন্যজনকে দাঁড়াতে হয় হাসি মুখে। একজন আরেকজনের ওপর ভর দিয়ে তৈরি করেন নানা ধরনের মানবদৃশ্য। হাত দিয়ে না ধরে একটি বাঁশ কপালের ওপর রেখে নিয়ন্ত্রণ করেন একজন, সেই বাঁশের ওপর দাঁড়িয়ে খেলা দেখায় শিশু। এমন অনেক খেলা তারা জানে।
 


বলছিলাম সার্কাসের এই শিল্পীদের কথা। যদিও সমাজ তাদের ‘শিল্পী’ হিসেবে মূল্যায়ন করে না। নেই সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। এমনকি স্থানীয় জটিল রাজনীতিও তাদের চলার পথে মস্ত বাধা। ডিসেম্বর পরীক্ষার মাস। সুতরাং এ সময় তারা খেলা দেখানোর অনুমতি পান না। অথচ এ সময় দিব্যি এলাকার সিনেমা হলগুলো চলে। ঘরে ঘরে ডিশ তো চলেই। সেগুলো বন্ধ হয় না। অথচ তাদের অনুমতি মেলে না। ফলে নিদারুণ অর্থকষ্টে দিনযাপন করতে হয় তাদের। সম্প্রতি ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল উপজেলার নেকমরদ ওরস মেলায় দ্য গ্রেট রওশন সার্কাসের শিল্পীদের সঙ্গে কথা হয় রাইজিংবিডির এই প্রতিবেদকের। 

রওশন সার্কাসের ম্যানেজার ফয়জুল আহমেদ বলেন, ‘আগের মতো এখন সার্কাস প্রদর্শনের অনুমতি পাওয়া যায় না। বছরে ২-৩ মাস মাত্র সার্কাস প্রদর্শন করতে পারি। পরীক্ষা, স্থানীয় রাজনীতির বিভিন্ন ঝামেলায় সার্কাস চালানোর অনুমতি মেলে না। তখন আমাদের কষ্ট দেখার কেউ নেই। বাধ্য হয়ে তখন কেউ ভ্যান চালায়, কেউ অন্যের বাড়িতে কাজ করে। অনেকে দিনমুজুরের কাজ করে সংসার চালায়। সরকার একবারও আমাদের কথা ভাবে না। সার্কাস না চললে যে এই শিল্পীদের পেটে খাবার জোটে না একথা ভাবার লোক দেশে নেই। আমাদের দাবি, বছরে ৭-৮ মাস যেন আমরা কোনো ঝামেলা ছাড়াই সার্কাস চালানোর অনুমতি পাই। তবেই সার্কাস শিল্পীরা ভালো থাকবে।’
 


সার্কাসে খেলা দেখান রূপালি আকতার (৩০)। তিনি জানান, ১০ বছর বয়সে সার্কাসের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন দারিদ্র্যের কারণে। এরপর দলের একজনের সঙ্গে বিয়ে হয়। বিয়ের পর দুই মেয়ে সন্তান কোলে আসে। তার দুই মেয়ে শিলা (১০) ও পুতুল (১২) এখন এই দলেই খেলা দেখায়। সার্কাস শিল্পীদের ভবিষ্যত নেই জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যতদিন সার্কাস খেলা দেখাইতে পারুম ততদিন দাম আছে। বয়স হইলে কী হবে বলতে পারি না। সরকার যদি উদ্যোগ নিয়ে আমাদের জন্য কিছু করে তাইলে আর ভয় নাই।’

৭ বছর বয়স থেকে সার্কাসে খেলা দেখান মোহাম্মদ কাশেম। তিনি বলেন, ‘সার্কাস না চললে শিল্পীদের খুব কষ্টে থাকতে হয়। সংসার ঠিকমতো চলে না। বর্তমান সময়ে সার্কাস ১ মাস চলে ৩ মাস বন্ধ থাকে। প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা বেতন পাই। বন্ধ থাকলে বেতন পাই না। তখন অন্য পেশায় যেতে হয় পেটের দায়ে। সার্কাস বাংলাদেশের সম্পদ। সরকারের কাছে দাবি জানাই, ১১ মাস যেন সার্কাস প্রদর্শনের অনুমতি দেয়।’
 


সার্কাসের কমেডিয়ান আব্দুল মজিদ বলেন, ‘খাটো মানুষ বলে কেউ কাজে নেয়নি। তখন এই সার্কাসে যুক্ত হই। ২৭ বছর ধরে আছি। মজার মজার অভিনয় ও কথা বলে দর্শকদের হাসিয়ে থাকি। সার্কাস না চললে আমার মতো খাটো মানুষদের খুব সমস্যায় পড়তে হয়। সংসার চালাতে তখন অনেকে ভিক্ষাও করে।’

শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলে আরো জানা যায়, সার্কাসে যারা খেলা দেখিয়ে থাকেন এদের অনেকেই স্কুলে পড়াশোনার সুযোগ পাননি। নিজের নাম অনেকেই লিখতে পারেন না। ৬ বা ৭ বছর বয়স থেকেই তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। বড় হলে যেহেতু আর খেলা শেখার সুযোগ থাকে না তাই ছোট থাকতেই খেলাগুলো ভালোভাবে তারা আয়ত্ব করে নেয়। তারা ধরেই নেয়, এখানেই তাদের ভবিষ্যত। মামা কাশেমের কাছে গত ৪ মাস ধরে খেলা শিখছে মোহাম্মদ জীবন (৭)। ৫ থেকে ৬টি খেলার কৌশল সে আয়ত্ব করেছে। তার বক্তব্য হলো, ‘আমার ভালো লাগে। ৪-৫টা খেলা দেখাতে পারি। প্রথম প্রথম ভয় লাগতো, এখন লাগে না। দর্শক হাততালি দিলে বেশি ভালো লাগে। অনেক সময় দর্শক খুশি হয়ে টাকাও দেয় আমাকে।’




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ ডিসেম্বর ২০১৭/ফিরোজ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়