ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

‘কার্যকর গণতন্ত্র’ ফেরাতে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের ডাক

এসকে রেজা পারভেজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:২০, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘কার্যকর গণতন্ত্র’ ফেরাতে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের ডাক

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক : ‘কার্যকর গণতন্ত্র’ ফেরাতে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ার লক্ষ্যে পাঁচ দাবি এবং নয় লক্ষ্য ঘোষণা করে প্রকাশ্যে আসলো বহুল আলোচিত ‘জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া’।

জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে বর্তমান সংসদ ভেঙে দিয়ে  আলোচনার মাধ্যমে একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের দাবি রেখে দল, মত ও সংগঠন নির্বিশেষে সবাইকে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ায় যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন সংগঠনটির নেতারা।

শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের কনফারেন্স রুমে ঐক্য প্রক্রিয়ার লিখিত ঘোষণাপত্র পাঠ করেন যুক্তফ্রন্টের নেতা ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না। পরে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে বক্তব্য রাখেন এর আহ্বায়ক  ও গণফোরামের সভাপতি প্রবীণ আইনজীবী সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেন।

লিখিত বক্তব্যে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, আগামী নির্বাচনে যেকোনোভাবে জয়লাভের জন্য সরকার ইভিএম পদ্ধতি প্রবর্তন, ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন অনুষ্ঠানসহ একের পর এক কূটকৌশল অবলম্বন করছে। গুম-খুন-জেল-জুলুম নির্যাতনের মাধ্যমে জনগণের মৌলিক, মানবাধিকার ও সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নিয়েছে।’

‘এই পরিস্থিতি থেকে দেশ, জাতি ও জনগণকে মুক্ত করা, রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বত্র কার্যকর গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও আইনের নিরপেক্ষ প্রয়োগ সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গঠনের বিকল্প নেই। তাই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষাভাবে সকল স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিদের বাদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল, সামাজিক শক্তি ও নাগরিক সমাজসহ জনগণকে অহিংস গণআন্দোলন গড়ে তুলতে আহ্বান জানাই,’ বলেন মাহমুদুর রহমান মান্না।

জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার পাঁচ দফা দাবির কথা জানান মাহমুদুর রহমান মান্না। এর মধ্যে রয়েছে :

১. জাতীয় একাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই বর্তমান সংসদ ভেঙে দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন করতে হবে। নির্বাচনকালীন সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না।

২. অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাক্, ব্যক্তি, সংবাদপত্র, টেলিভিশন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও সব রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে এবং আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে।

৩. কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রছাত্রীসহ সব রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে আনা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের মুক্তি দিতে হবে। এখন থেকে নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা যাবে না।

৪. নির্বাচনের এক মাস আগে থেকে নির্বাচনের পর ১০ দিন পর্যন্ত মোট ৪০ দিন প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় বিচারিক ক্ষমতাসহ সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে হবে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়োগ ও নিয়ন্ত্রণের পূর্ণ ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনকে দিতে হবে।

৫. নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের চিন্তা ও পরিকল্পনা বাদ দিতে হবে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এর যুগোপযোগী সংশোধনের মাধ্যমে গণমুখী করতে হবে।

জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ায় পাঁচ দাবির সঙ্গে তাদের ভবিষ্যত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যর কথাও জানানো হয়েছে। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলো হচ্ছে :

১. এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক নির্বাহী ক্ষমতা অবসানের জন্য সংসদ, সরকার, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা এবং প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ, ন্যায়পাল নিয়োগ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কার্যকর করা। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন, সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ ও সৎ যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগের জন্য সাংবিধানিক কমিশন গঠন করা।

২. দুর্নীতি দমন কমিশনকে যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কার নিশ্চিত করা। দুর্নীতিমুক্ত, দক্ষ ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসন গড়ে তুলে সুশাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে দুর্নীতি কঠোর হাতে দমন ও দুর্নীতির দায়ে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা।

৩. দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির পরিবেশ সৃষ্টি, বেকারত্বের অবসান ও শিক্ষিত যুবসমাজের সৃজনশীলতা ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধাকে একমাত্র যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা।

৪. কৃষক-শ্রমিক ও দরিদ্র মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সরকারি অর্থায়নে সুনিশ্চিত করা।

৫. জনপ্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, স্থানীয় সরকারসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে দুর্নীতি ও দলীয়করণ থেকে মুক্ত করা। এসব প্রতিষ্ঠানের সার্বিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন ও কাঠামো সংস্কার করা।

৬. বাংলাদেশ ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানে শৃঙ্খলা আনা, সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার, সুষম বণ্টন ও জনকল্যাণমুখী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা।

৭. জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জাতীয় ঐকমত্য গঠন এবং প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা ও নেতিবাচক রাজনীতির বিপরীতে ইতিবাচক সৃজনশীল এবং কার্যকর ভারসাম্যের রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করা।

৮. সকল দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়- এই নীতির আলোকে  জনস্বার্থ ও জাতীয় নিরাপত্তাকে সমুন্নত রেখে পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করা।

৯. রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে ফেরাতে কূটনৈতিক তৎপড়তা জোরদার, দেশের স্বার্বভৌমত্ব এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সুরক্ষার লক্ষ্যে প্রতিরক্ষা বাহিনীকে আধুনিক প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি ও সমরসম্ভারে সুসজ্জিত, সুসংগঠিত ও যুগোপযোগী করা।

জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া ঘোষণার পর এর আহ্বাক ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘কার্যকর গণতন্ত্র’ ফেরাতে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ার লক্ষ্যে এই প্রক্রিয়া আমরা শুরু করেছি।

তিনি বলেন, ‘আমি আশাবাদী, স্বাধীনতার ৫০ বছরকে সামনে রেখে কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে। জনগণের সত্যিকারের প্রতিনিধি নিয়ে সংসদ গঠিত হবে। যারা সংসদে জনগণের সংকট-সমস্যা নিয়ে কথা বলবেন।’

ঘরে-ঘরে, পাড়ায়-পাড়ায় ঐক্য গড়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রগতিশীল সবাইকে এই বৃহত্তর ঐক্য প্রক্রিয়ায় যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানাই।’

এদিকে, শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়ে ‘জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া’ শুরু করা কথা থাকলেও সেখানে যেতে পারেননি এর সঙ্গে যুক্ত নেতাকর্মীরা। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে প্রেসক্লাব থেকে শহীদ মিনারের উদ্দেশ্যে রওনা হলেও পরে তা স্থগিত করা হয়।

তাৎক্ষণিকভারে রাস্তায় দাঁড়িয়ে যুক্তফ্রন্টের নেতা জাসদের সভাপতি আ স ম আবদুর রব অভিযোগ করেন, সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে দিয়ে সেখানে পুলিশ দিয়ে ঘিরে রেখেছে। সেখানে যাওয়া যাবে না। শহীদ মিনারে যেতে না পেরে এর নিন্দা জানান তিনি। 

এদিকে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার অনুষ্ঠানে যোগ দেননি যুক্তফ্রন্টের চেয়ারম্যান ও বিকল্পধারার সভাপতি এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী। অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসার পথে তিনি অসুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে গেছেন বলে জানান মাহমুদুর রহমান মান্না।

এ সময় জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহসহ গণফোরাম, বিকল্পধারা, নাগরিক ঐক্যের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। 



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮/রেজা/রফিক  

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়