ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

অগ্নিঝরা মার্চ

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রাক্তন সৈনিকদের রক্তশপথ

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:০৭, ২২ মার্চ ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রাক্তন সৈনিকদের রক্তশপথ

৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর ঢাকার আউটার স্টেডিয়ামে প্রাক্তন সৈনিকদের এসেমব্লি

শাহ মতিন টিপু : ২২ মার্চ ১৯৭১। এইদিন ছিল লাগাতার চলা অসহযোগ আন্দোলনের ২১তম দিবস। এইদিনে প্রাক্তন সৈনিকরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আসন্ন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে রক্তশপথ নেয়। সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর হাতে  তরবারি তুলে দেন এমএজি ওসমানী।

গত ২১ দিন যাবত বাংলার মানুষ মরণপণ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ। আজও সরকারী-বেসরকারী বাসভবন এবং যানবাহনসমূহে যথারীতি কালো পতাকা উত্তোলিত ছিল। স্বাধীনতার দাবিতে বিক্ষুব্ধ মানুষের সভা, শোভাযাত্রা এবং গগনবিদারী স্লোগানে মুখরিত রাজধানীর আকাশ-বাতাস। যে সকল অফিস খোলা রাখার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নির্দেশ দিয়েছিলেন সেগুলো ছাড়া আর সব সরকারী-আধাসরকারী, স্বায়ত্তশাসিত এবং বেসরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহে অসহযোগ কর্মসূচী শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খলভাবে পালিত হয়।

বাংলার মানুষ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে নির্বাচিত নেতার বৈধ নির্দেশসমূহ বাস্তবায়ন করে এই প্রথমবারের মতো এ সত্য প্রমাণ করেছে যে বাঙালী জাতি স্ব-শাসন নিশ্চিত করতে জানে।

আজ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অসংখ্য মিছিলে রাজধানী ঢাকা ও আশপাশের এলাকা প্লাবিত হয়ে যায়। রাজপথজুড়ে যেন মানুষের বান ডাকে। বিক্ষুব্ধ বাংলার দশ দিগন্তে মুক্তিকামী গণমানুষের একটানা সর্বাত্মক অসহযোগের পটভূমিতে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার বুকে রাজনৈতিক পর্যায়ে পাকিস্তানের ভাগ্য নির্ধারণের প্রশ্নে বোঝাপড়া চূড়ান্ত পর্বে উন্নীত হয়।

সামনে থাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব প্রদত্ত ৪ দফা শর্ত। সেনাবাহিনীর গুলিতে অগণিত নিরীহ সাধারণ মানুষের প্রাণহানির ঘটনাবলীর অনিবার্য পরিণতি হিসেবে যে চরম রাজনৈতিক সঙ্কটের সৃষ্টি হয়েছে, বাংলার জনগণের পক্ষ হতে বঙ্গবন্ধু উত্থাপিত ৪ দফা শর্ত মেনে নেওয়ার মধ্য দিয়েই সামরিক কর্তৃপক্ষ সৃষ্ট এ অচলাবস্থার অবসান ঘটাতে পারে।

এমন একটি পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই সকাল সাড়ে ১১টায় প্রেসিডেন্ট ভবনে বঙ্গবন্ধু, ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হন। প্রেসিডেন্ট ভবনের সামনে অবস্থানরত সংগ্রামী জনতা বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশে “জয় বাংলা” রণধ্বনি দেয় এবং ভুট্টোবিরোধী বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।

প্রায় ৭৫ মিনিটের আলোচনার পর বঙ্গবন্ধু দৃঢ় অথচ বিষণ্ন অবয়বে প্রেসিডেন্ট ভবনের বাইরে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, “প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আমার নির্ধারিত বৈঠক ছিল। সে অনুযায়ী আমি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করতে যাই। সেখানে মিঃ ভুট্টো উপস্থিত ছিলেন। আমি প্রেসিডেন্টকে সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছি যে, ৪টি শর্ত পূরণ না হলে আমরা জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করতে পারি না।”

আজ পত্রিকায় প্রেরিত এক বিশেষ বাণীতে বঙ্গবন্ধু বলেন, “আমাদের আন্দোলনের বৈধতার কারণে বিজয় এখন থেকে আমাদেরই।” বাংলাদেশের সকল দৈনিক পত্রিকার জন্য প্রেরিত এ বাণীটির শিরোনাম ছিল “বাংলাদেশের মুক্তি।”

এ ছাড়া সংগ্রামী জনতার উদ্দেশে প্রদত্ত বাণীটিতে ছিল পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী কর্তৃক আসন্ন গণহত্যার চক্রান্ত প্রতিহত করার এবং প্রস্তুতি গ্রহণের সতর্ক সঙ্কেত।

এদিকে সন্ধ্যায় সংবাদপত্রে প্রেরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বলেন, ‘পাকিস্তানের উভয়াংশের নেতৃবৃন্দ এবং রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে আলোচনার ভিত্তিতে সমঝোতার ক্ষেত্র অধিকতর প্রসারিত করার সুবিধার্থে ২৫ মার্চে আহূত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করা হলো।’

অথচ বিবৃতিটিতে পুনরায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন কবে বসবে এ রকম কোন দিন তারিখ উল্লেখ ছিলনা। অর্থাৎ, ২৫ মার্চ তারিখেই গণহত্যার নীলনক্সা চূড়ান্ত করা হয়েছে। তাই বিবৃতিটি ছিল লোক দেখানো।

বিকেলে বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে আয়োজিত বিমান, নৌ ও স্থল বাহিনীর প্রাক্তন সৈনিকদের এক সম্মিলিত সমাবেশে বাংলাদেশের সকল অবসরপাপ্ত সৈনিকদের নিজ নিজ এলাকার আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সংগ্রাম পরিষদ এবং স্বেচ্ছাসেবকদের সংগঠিত করার নির্দেশ প্রদান করা হয়।

মেজর জেনারেল (অব) এমআই মজিদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সমাবেশে আসন্ন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে উপস্থিত সকলে শপথ গ্রহণ করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাঙালী সৈনিক এবং অফিসারদের কর্মস্থল ত্যাগ করে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণে উদাত্ত আহ্বান জানানো হয়।

সমাবেশ শেষে মিছিল সহকারে সবাই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যান। সেখানে কর্নেল (অব) এমএজি ওসমানী সকলকে রক্তশপথ অঙ্গীকারনামা পাঠ করান। এরপর মিছিল সহযোগে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে আসেন। বঙ্গবন্ধু বাড়ির সদর দরজায় এসে জয় বাংলা ধ্বনি দিয়ে তাদের স্বাগত জানান। এরপর মেজর জেনারেল (অব) এমআই মজিদ, কর্নেল (অব) ওসমানীসহ মোট ৪ জন বঙ্গবন্ধুর লাইব্রেরি কক্ষে একান্ত বৈঠকে মিলিত হন। এই বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর হাতে সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে একটি তরবারি তুলে দেন ওসমানী।

আলোচনা চলাকালে ওসমানী একপর্যায়ে বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘ডু ইউ থিংক দ্যাট টুমরো উইল বি এ ক্রুসিয়াল ডে?’ বঙ্গবন্ধু জবাবে বলেন, ‘নো, আই থিংক, ইট উইল বি টুয়েন্টি ফিফথ্।’

ওসমানী পুনরায় প্রশ্ন রাখেন, কালতো তেইশে মার্চ। পাকিস্তান দিবস। সে উপলক্ষে ওরা কী কিছু করতে চাইবে না? বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘ওরা যে কোন মুহূর্তে যে কোন কিছু করতে পারে। তার জন্য কোন দিবসের প্রয়োজন হয় না।’




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২২ মার্চ ২০১৮/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়