ক্যাথরিন দুঃখ পোষে না অনুভূতি পোষে
ক্যাথরিন মাসুদ, রোকেয়া প্রাচী
একজন বন্ধু ক্রমে ক্রমে দুইজনের প্রতিনিধিত্ব করতে শুরু করল। এক সময় বুঝতে পারলাম সে অন্য একটি দেশ থেকে এসে আমার দেশ, সংস্কৃতি, মাটি ও মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। আমার চোখের সামনে এবং মনের ভেতর তার ভিন্ন ভিন্ন উপস্থিতি আবিষ্কার করতে পারলাম। সে ক্যাথরিন মাসুদ। বন্ধু আমার। মাটির ময়না কিংবা অন্তর্যাত্রার অনিঃশেষ গল্পের মতো আমাদের সম্পর্কটাও এগিয়েছে সময়ের সঙ্গে।
আমার যখন সামাজিক, মানসিক চরম ক্রাইসিস চলছিল তখন দেখা হয় ক্যাথরিন মাসুদের সঙ্গে। এক অখণ্ড দেখার গল্প বুনেছি দিনের পর দিন। উপস্থিতিতে অনুপস্থিতিতে। কাজে-কর্মে, দেখা হওয়া-না হওয়ায়।
তারেক মাসুদের সঙ্গে কাজ করার আগে আমি আরো কাজ করেছিলাম। কিন্তু তারেক-ক্যাথরিনের সঙ্গে যেতে যেতে আমার আরো একটি পরিচয় তৈরি হয়েছে বলে আমার বিশ্বাস। এর মূলে ছিল ক্যাথরিন। ক্যাথরিনের একটি প্রস্তাব আমাকে ও আমার মেয়েকে যুক্ত করেছিল মাটির ময়না সিনেমার সঙ্গে।
আমি তখন গুলশান দুইয়ে থাকি। গুলশানের একটি আইসক্রিম পার্লারে হঠাৎ আমাদের দেখা হয়ে যায়। ঠিক তার দুই/তিন দিন পর তারেক মাসুদ ভাই একজনকে দিয়ে আমার বাসায় একটি চিঠি পাঠান। এরপর আমি তারেক মাসুদ-ক্যাথরিন মাসুদের ইন্দিরা রোডের বাসায় দেখা করি। চিঠিতে লেখা ছিল- আমি যেন আমার মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে দেখা করি। কথা অনুযায়ী গেলাম। একসঙ্গে কাজ করার সুযোগ হলো।
সিনেমার কাজ করার সময় ক্যাথরিন আমাকে অসম্ভব রকমের সহযোগিতা করেছিল। এরপর আমাদের ভ্রমণের স্মৃতি আছে। আমরা একসঙ্গে অনেক জায়গায় ঘুরেছি। ইন্ডিয়া, আমেরিকা, বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দিনের পর দিন কাটিয়েছি। সেই সময়ের ভ্রমণের সঙ্গী ছিলেন তারেক মাসুদ ভাই।
তারেক ভাইয়ের সঙ্গে কাজ শুরু করার আগে তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। মুক্তির গান নির্মাণ করলেন তারেক ভাই। আমি তখন দুখাই সিনেমাটা করেছি। আর আমরা যে যার জায়গা থেকে যারা যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিরূপে কাজ করছিলাম তাদের মধ্যে এক ধরণের যোগসূত্র ছিল।
বলতে গেলে তখন চলছিল সাংস্কৃতিক আরো একটি আন্দোলন। তারেক ভাই ও ক্যাথরিনের সঙ্গে আমার যে সম্পর্ক এই সম্পর্কটা অভিভাবকের। তিনি ছিলেন দিক নির্দেশক। তারেক ভাইয়ের দর্শন, তার ব্যক্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধা ছিল অপার। তারপর তারেক ভাইয়ের না থাকার অধ্যায় সূচিত হলো।
২০১২ সালের দিকে আমি-ক্যাথরিন একান্তে তিনদিন সময় কাটিয়েছিলাম ব্যাংককে। মানে আমরা মুখোমুখি বসবার সুযোগ পেলাম আর তখন আমাদের হাতে ছিল অফুরন্ত সময়। একজনের গল্প আরেকজনকে বলা হলো। কথা বলতে বলতে শুধু এইটুকুই মনে হয়েছে, আমাদের কষ্টগুলো কাছাকাছি।
দুঃখ আসলে দুঃখ নয়, দুঃখ কারো কারো কাছে কেবলই অনুভূতি। দুঃখতো মুছে দেওয়া যায়, সময়ের সাথে দুঃখ পুরোনো হয়ে যায়। কিন্তু অনুভূতি সময়ের। আমার কাছে মনে হয় ক্যাথরিন দুঃখ পোষে না অনুভূতি পোষে। অনুভূতি যাপন করতে করতে অনন্য এক শক্তিশালী মানুষ হয়ে ওঠেছে। মৃত্যুর কাছ থেকে ফিরে আসা ক্যাথরিন আরো বেশি শক্তিশালী। আরো বেশি আত্মবিশ্বাসী।
আমার কাছে মনে হয়, ক্যাথরিন আমার সঙ্গে ছিল, সঙ্গে আছে। আমার বিশ্বাস, একটি সম্পর্কের সৌন্দর্য হচ্ছে সঙ্গে থাকা। সম্পর্কের মূল কথাও হচ্ছে সঙ্গে থাকা।
অনুলিখন : স্বরলিপি
রাইজিংবিডি/ঢাকা/৬ আগস্ট ২০১৭/শান্ত
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন