ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

খান বাড়ির লজিং মাস্টার

আমিনুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:৪৬, ৩১ জুলাই ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
খান বাড়ির লজিং মাস্টার

আমিনুল ইসলাম : আসরের নামাজ শেষে সোহরাব খান যখন বাড়ি ফিরলেন তখন খান বাড়িতে চাপা কৌতূহল ছড়িয়ে পড়ল। এলাকায় খান বাড়ির প্রভাব এখনও অটুট। খান বংশের সবাই এখনও একত্রে এই বাড়িতে থাকায় বাড়ির সদস্য সংখ্যাও কম নয়। ছেলে-বুড়ো, কিশোরী-যুবতী মিলিয়ে পাল্লাটা বেশ ভারি। এই পাল্লায় কি আরো একজন নতুন যুক্ত হলো?

 

কথাটি এ কারণে বলা যে, সোহরাব খান একটি ছেলেকে নিয়ে এসেছেন। ছিপছিপে গড়নের সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ ছেলেটিকে দেখলেই বোঝা যায় চরাঞ্চলের দরিদ্র পরিবারের ছেলে। এবং এই ছেলেকে নিয়ে সোহরাব খান সোজা বাবার ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। বৃদ্ধ বাবার অনুমতি ছাড়া তিনি কোনো কাজ করেন না। কিন্তু এই ছেলেটি ঠিক কী কাজে আসবে বুঝতে পারছিল না বাড়ির অন্যরা। যে কারণে বাড়ির উঠোন থেকে পুকুর ঘাট, কলপাড় এমনকি রসুই ঘরেও শোনা গেল ফিসফিস কিছু শব্দ। সেই শব্দ ক্রমেই জোড়ালো হয়ে ছড়িয়ে পড়ল বাড়িময়। বিশেষ করে কিশোরী যারা তাদের কৌতূহলের মাত্রাটা বেশি। সে তুলনায় সাহস কম। দাদার ঘরের জানালা দিয়ে উঁকি দিচ্ছিল তারা বারবার। ব্যাপারটা খেয়াল করলেন সোহরাব খান। তিনি ধমকে উঠলেন- এই, আমি কিন্তু সব দেখছি! যা এখান থেকে।

 

যাওয়ার কথাটা না বললেও চলত। সোহরাব খানের গুরুগম্ভীর কণ্ঠে দৌড়ে পালাল সবাই। তবে সন্ধ্যার পরই জানা গেল আসল রহস্য। সোহরাব খান সবাইকে জানিয়ে দিলেন, এই ছেলে এখন থেকে এই বাড়িতেই থাকবে। বিনিময়ে ছেলেটি ছেলেমেয়েদের পড়াবে। ব্যবস্থাটা রেহানার মায়ের ভালোই লাগল। তিনিও মনে মনে এমন চাইছিলেন।

 

সন্ধ্যার আযান হলে সোহরাব খানের সঙ্গে ছেলেটিও নামাযে যায়। মসজিদ থেকে ফিরেই সে রেহানা ও রিন্টুকে পড়াতে বসে। একটু পরে রেহানার মা এক গ্লাস দুধ এনে ছেলেটির সামনে রাখে। ছেলেটি সেদিকে লাজুক চোখে তাকায়। রেহানার মা ছেলেটিকে সহজ করতে বলে, তুমি আমার ভাইয়ের মতো। আমার ছেলেমেয়ে দুটোকে নিজের ভাগ্নে-ভাগ্নির মতো মনে করবে। ওরা কিন্তু বেশ দুষ্টু। প্রয়োজন হলে শাসন করবে।

 

ছেলেটির নাম বিল্লাল। সে দ্রুত বাড়ির সবার আস্থাভাজন হয়ে ওঠে। কারো যেন তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। বাড়ির ছোটরা তো বটেই বড়রাও তার ব্যবহারে মুগ্ধ। বিল্লাল নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। বিকেলে কিংবা রাতে সবাই টিভি দেখলেও সে টিভি দেখে না। বাড়ির ১২ বছরের বেশি বয়সী কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকায় না। বাড়ির বড় সবাইকে আসতে-যেতে যখন যার সঙ্গে দেখা হয় সালাম দেয়। চলনে-বলনে মুগ্ধ হওয়ার মতো ছেলে সে। কিন্তু তার সমস্যা একটাই এতদিনে সে জড়তা কাটিয়ে উঠেছে। ফলে যখন কথা বলা শুরু করে তখন বলতেই থাকে। সে যেন এক জীবন্ত গল্পের বই। যেকোনো একটি ঘটনার সঙ্গে পরম্পরা যোগ করে, আকাঙ্ক্ষা-আসক্তি জোড়া দিয়ে গল্প বানিয়ে বলবে। তার বাচনভঙ্গিতে সবাই মুগ্ধ!

 

বাড়ির কিশোরীরা তার দিকে আড়চোখে তাকাতে শুরু করল। বয়সে আর একটু বড় যারা তাদের কেউ কেউ তার সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু বিল্লাল এ বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন। প্রয়োজনের অধিক একটি কথাও সে ব্যয় করতে রাজি নয়। সে সময় কাটাতে প্রায়ই বাড়ির পাশে দিঘির শেষ প্রান্তে গিয়ে বসে। সেখানে বজ্রপাতে মারা যাওয়া প্রকাণ্ড একটি গাছ প্রায় কালো হয়ে ছিল এতদিন। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শ্যাওলা। ও দিকটায় কেউ সাধারণত যায় না। সন্ধ্যার আযান না হওয়া পর্যন্ত একটানা সেখানেই বসে থাকে বিল্লাল। রাতেও তাকে প্রায়ই সেখানে বসে থাকতে দেখা যায়। এ নিয়েও অনেকের কৌতূহল জেগে ওঠে। কী করে বিল্লাল সেখানে? বিষয়টি খান বাড়ির সবাইকে ক্রমেই ভাবিয়ে তোলে। তাছাড়া ওই গাছটিও ভালো নয়। সেখানে অনেকেই নাকি অনেক কিছু দেখেছে। কেউ মুণ্ডুহীন ঘোড়া, কেউ মস্তকহীন দেহ দেখে জ্ঞানও হারিয়েছে। অনেকে তো বলে তারা সেখানে জোড়ায় জোড়ায় পরী বসে থাকতেও নাকি দেখেছে!

 

তো ঘটনার শুরু এখান থেকে। সোহরাব খানের হাঁপানি আক্রান্ত চাচী একদিন বিকেলে বাচ্চাদের গল্পচ্ছলে বললেন, বিল্লালের সঙ্গে পরী আছে। সে মাঝে মধ্যেই জোড় দিঘির পাড়ে তাল গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে পরীদের সঙ্গে কথা বলে। এ কথা মুহুর্তের মধ্যেই খান বাড়ির সবার কানে পৌঁছে যায়। বড়রা বিষয়টি হেসে উড়িয়ে দিলেও ছোটরা গোঁ ধরে বসে পরী দেখার জন্য। যত সময় যেতে লাগল বিল্লালের কাছে পরী দেখার আবদার বেড়েই চলল। গোসল করার সময়, নামাজে যাবার সময়, কলেজ থেকে ফেরার সময়, বিকেলে দিঘির পাড়ে যাবার সময়- আবদার চলতেই থাকল। এমনকি বিল্লালের আচার-আচরণ দেখে বাড়ির বড়দের কেউ কেউ বিষয়টি বিশ্বাস করতেও শুরু করলেন। দেখা গেল কিছুদিন পর তারাও সময়ে-অসময়ে বিল্লালের কাছে পরী দেখার আবদার জানাতে শুরু করল।

 

এই আবদারে বিল্লাল রীতিমতো বিরক্ত। বার বার সে তাদের বোঝাতে চেষ্টা করেছে তার সঙ্গে পরী-টরী বলে কিছু নেই। সে জীবনে কখনো এসব কিছু দেখেওনি। কিন্তু কে শোনে কার কথা! আবদার একটাই- পরী দেখাতে হবে।

 

সময়টা তখন বর্ষাকাল। খান বাড়ির তিন দিকে থৈ থৈ পানি। কেবল রাস্তায় বের হওয়ার পথটি এখনো জেগে আছে। অন্য সবদিক পানিতে একাকার। একদিন বিকেলে বিলাল আসরের নামাজে যাবার আগে কয়েকজনকে ডেকে বললেন, আগামীকাল এশার নামাজের আগে সবাইকে পরী দেখাব। বিদুৎ গতিতে এই খবর খান বাড়ির সবার কানে পৌঁছে গেল। আশেপাশের বাড়ির কেউ কেউও জেনে গেল। এতে বাড়িতে অন্যরকম এক পরিবেশ তৈরি হলো। কারণ নতুন প্রজন্মের কেউ নিজ চোখে কখনো পরী দেখেনি। এবার সেই সৌভাগ্য হতে যাচ্ছে বিল্লালের কল্যাণে।

 

নির্দিষ্ট দিন সকালে বিল্লাল রেহানার মাকে বলল, ভাতের পাতিল থেকে কিছু কালি দিতে। কী প্রয়োজন জানতে চাইলে বিলাল জানাল তার দোয়াত কলমের কালি শেষ। কালি বানাতে হবে। রেহানার মা কালি তৈরি করে দিলেন। দুপুরের পর বিলালের আর কোনো খোঁজ নেই। সন্ধ্যার পর বিলাল চুপিসারে বাড়িতে ঢুকল। তার গায়ে আলখেল্লা। মাথায় বড় টুপি। বিল্লালকে দেখতে অন্যরকম লাগছে। এর আগে কখনো তাকে এমন লাগেনি। আজ বিল্লাল সবাইকে পরী দেখাবে।

 

সবাইকে বিল্লাল চুপ করতে বলে ঘাটে এনে দাঁড় করাল। বিল্লাল এবার দিঘির পাড়ের দিকে চলে গেল। সেখানে গিয়ে বার কয়েক তালগাছের মাথায় টর্চ লাইটের আলো ফেলল। এক ঝটকায় পকেট থেকে তসবিহ বের করে উপরে ছুড়ে দিল। এবং সবাই অবাক হয়ে দেখল সেই তসবিহ বিল্লালের মাথা গলে গলায় জড়িয়ে গেল। এবার বিল্লাল সেই অন্ধকারের মধ্যে কাউকে কিছু না বলে বাড়ির পথ ধরল। তখন সবাই আরো অবাক হয়ে দেখল, তার গলায় থাকা তসবিহটা জ্বলজ্বল করছে। গাঢ় অন্ধকারে তখন শুধু মনে হচ্ছিল তসবিহটা যেন উড়ে চলেছে কোথাও।

 

এটুকুতে সাধ মিটল না অনেকেরই। তারা পরী দেখতে চাইল। বিল্লাল তখন পকেট থেকে অন্যরকম একটি কৌটা বের করল। বের করতেই আতরের ঘ্রাণে ভরে গেল চারপাশ। সে সবাইকে বলল, পরী এই আতর দিয়েছে। সবাইকে আতর মুখে মাখতে হবে। তবেই পরী আসবে।

 

সবাই তখন সেই আতর মুখে মাখল। এবার বিল্লাল বিরবির করে শব্দ উচ্চারণ করতে করতে টর্চ জ্বালিয়ে উন্মাদের মতো দৌঁড়ে গেল ঘন অন্ধকারের দিকে। এ ঘটনায় হঠাৎ করেই সবার মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিল। প্রথমে একজন, তারপর দুজন, মুহূর্তেই সবাই দৌড় শুরু করল বাড়ির দিকে। তাদের দৌড় দেখে মনে হলো হরিণের পালে বুঝি বাঘ তাড়া করেছে।

 

সবাই বাড়ির আঙিনায় জড়ো হয়েই হতবিহ্বলের মতো পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইল। আর তখনি সেখান থেকে সমস্বরে চিৎকারের শব্দ পাওয়া গেল বহুদূর থেকেই। কারণ কেউ তখন কাউকে চিনতে পারছিল না।  

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩১ জুলাই ২০১৬/আমিনুল/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়