ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

খেজুর গাছেই জীবন

ছাইফুল ইসলাম মাছুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:৫৬, ৬ জানুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
খেজুর গাছেই জীবন

বিপ্লব উদ্দিন, ছবি: লেখক

ছাইফুল ইসলাম মাছুম : গ্রামের শীতের সকাল মানেই অন্য রকম আবহ। শীতের রকমারি পিঠাপুলির উৎসব। শীতের সকালে একটু খেজুর রসের পায়েস না হলে যেন চলেই না।

 

সেই রসের আবর্তে অনেকের জীবন জীবিকা আটকে আছে খেজুর গাছেই। দিনের বড় একটা অংশ খেজুর গাছে গাছেই কাটে তাদের। রস সংগ্রহ করার জন্য খেজুর গাছের ডাল বাকল ছাঁটাই করে খেজুর গাছকে প্রস্তুত করাই তাদের কাজ। আঞ্চলিক বাসায় তাদেরকে গাছি বলা হয়ে থাকে।

 

তেমনি একজন নোয়াখালী হাতিয়া দ্বীপের সোনাদিয়া ইউনিয়নের বিপ্লব উদ্দিন। ২৬ বছর বয়সী সাহসী যুবক। বিপ্লব ১০ বছর ধরেই ঝুকিপূর্ণ এই পেশায় রয়েছেন। মজুরিভিত্তিক প্রতিদিনই প্রায় ৩০ থেকে ৩৫টা খেজুর গাছ পরিষ্কার করছেন। প্রতি খেজুর গাছে ৪০ থেকে ৪৫ টাকা মজুরি পান তিনি।

 

নানার কাছে হাতেখড়ি

বিপ্লবের গাছি হওয়ার জীবনের গল্পের শুরুটা হয় নানার কাছ থেকে শিখে। তার শৈশব কৈশোর কেটেছে নানা বাড়িতে। বিপ্লবের বয়স যখন মাত্র তিন মাস তখন তার পিতা হেলাল উদ্দিন আরেক বিয়ে করেন। মা রিজিয়া বেগম স্বামী পরিত্যাক্তা হয়ে বাপের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। বিপ্লবের শৈশব স্মৃতি অত সুখকর হয়নি, অবহেলায় অনাদরে বেড়ে উঠেছেন। দারিদ্রতার কারণে স্কুলের গন্ডিতেও যাওয়া হয়নি কখনো। আহার জুটতো না তিন বেলা। মা চেয়েছিলেন বিপ্লবকে অন্য কোথাও দত্তক দিতে। জীবনের প্রয়োজনে সে অনেক বেশি পরিশ্রমি হয়ে উঠে। মানুষের ক্ষেতে খামারে মজুরি খাটতো। নানা মোজাহার উদ্দিন ছিল এলাকার পরিচিত খেজুর গাছের গাছি। নানার থেকে দেখে দেখে ছোট্ট বিপ্লবও একদিন হয়ে উঠেন দক্ষ গাছি।

 

পুজিঁ কেবল ১২০০ টাকা

১৫ বছর বয়সে বিপ্লব একটি দা, দুটি চেনি, কোমরে বাঁধার রশি, লাট (গাছের সঙ্গে বাঁধার জন্য লম্বা কাঠের লাঠি), বস্তা, সরঞ্জাম নেওয়ার খাঁচাসহ ১২০০ টাকার পুজিঁ নিয়ে মাঠে নামেন।

 

খেজুর গাছির পেশাটা মৌসুমী পেশা। বাংলা অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে পৌষ-মাঘ মাস পর্যন্ত খেজুর গাছ পরিষ্কার করেন। হাতিয়া দ্বীপের সাগরিয়া, চরচেঙ্গা, সোনাদিয়া চৌরাস্তা, জাহাজমারা ও নিঝুমদ্বীপে খেজুর গাছ ছাটাঁয়ের জন্য সাধারণত বিপ্লব গাছির ডাক পড়ে। বিপ্লব জানান, প্রতি শীতের মৌসুমে প্রায় ১২০০ থেকে ১৫০০ খেজুর গাছ ছাটাই করতে পারেন। এতে খেজুর গাছ কাটার মৌসুমে তার আয় হয় ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা।

 

বছরের বাকি সময় বেকার বসে থাকতে হয়না বিপ্লবকে। নারিকেল গাছ পরিষ্কার, তাল গাছ কাটা, কাঠ মিস্ত্রির কাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করেন। এ কাজে ও কাজে সারা বছরই ব্যস্ত থাকতে হয় তাকে। প্রতি মাসে গড়ে আয় হয় ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা।

 

 

১০ বছরে দূর্ঘটনায় শিকার তিনবার

গাছি পেশাটা খুবই ঝুঁকিপূর্ন পেশা। ছোট গাছ থেকে শুরু করে লম্বা গাছেও উঠতে হয়। প্রতিটি গাছ ছাঁটাই করার সময় রাখতে হয় সতর্ক মনোযোগ। গাছ কাটার সময় অবর্জনা থেকে চোখ বাচাঁতে ব্যবহার করেন সানগ্লাস। কোমরে বাধেঁন মোটা রশি। পায়ের নিচে বাঁধা থাকে লাটাই। কারণ একটু পা ফসকে গেলে ঘটে যেতে পারে বড় বিপদ, বরণ করতে হতে পারে পঙ্গুত্ব কিংবা মৃত্যুও।

 

সব সতর্কতার পরও মাঝে মাঝেই দূর্ঘটনায় শিকার হতে হয়। কখনো খেজুর কাটা বিঁধে যায়, কখনো খেতে হয় বিষাক্ত পোকার কামড়। বিপ্লব জানান, ১০ বছরে তিনবার বড় দূর্ঘটনার শিকার হয়েছেন তিনি। একবার হাত কেটে গেছে, একবার পা কেটে গেছে। আরেকবার তো গাছ থেকেই পড়ে গেছেন।

 

দশজনের চেয়ে অনেক ভালো আছি

বিপ্লব এখন আর নানা বাড়িতে আশ্রিত নন। আড়াই লাখ টাকার জমি কিনে নিজেই এখন বাড়ি করেছেন। লাখ টাকা খরচ করে দিয়েছেন টিনের ঘর। ঘরে লাগিয়েছেন সৌর বিদ্যুত। ঘটা করে বিয়ে করেছেন। এখন তিনি এক সন্তানের বাবা। টাকার অভাবে নিজে পড়তে না পারলে, ছেলেকে পড়ালেখা শিখিয়ে মানুষ করার ইচ্ছা তার।

 

বিপ্লব বলেন, এখন আমার কোনো অভাব নেই, নিজের পরিশ্রমের টাকায় চলি। সমাজের দশজনের চেয়ে অনেক ভালো আছি।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৬ জানুয়ারি ২০১৬/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়