ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের ভিআইপি মর্যাদার উদ্যোগ সূতিকাগারে

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:২৬, ১২ ডিসেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের ভিআইপি মর্যাদার উদ্যোগ সূতিকাগারে

হাসান মাহামুদ : পরিকল্পনা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের মধ্যেই আটকে আছে খেতাবপ্রাপ্ত ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি (ভিআইপি) মর্যাদা দেওয়ার উদ্যোগ। একই সঙ্গে পর্যাপ্ত হুইলচেয়ার প্রদান এবং বিদেশে  নিয়ে যুদ্ধাহতদের উন্নত চিকিৎসা দেয়ার উদ্যোগেও ভাটা পড়ে আছে। এ ব্যাপারে গত সাত বছরে মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয় নীতিমালা তৈরি করতেও ব্যর্থ হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আট বছর আগে এক নির্দেশে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের ভিআইপি মর্যাদা দেওয়ার কথা বলেন। এর প্রেক্ষিতে মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে নানামুখী উদ্যোগের অংশ হিসেবে ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের ভিআইপি পর্যাদা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। ভিআইপি পর্যাদা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদেরও।

এটি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত মহাজোটের এটি অন্যতম প্রতিশ্রুতি। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও এ প্রতিশ্রুতি ছিল। এমনকি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত মহাজোটেরও অন্যতম প্রতিশ্রুতি এটি।

একই সঙ্গে তখন শহীদ ও যুদ্ধাহত  মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের জন্য রেশন কর্মসূচি চালু করারও পরিকল্পণা করা হয়। তখন এ বিষয়ে একটি নীতিমালা তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। এসব বিষয়ে ওই বছরের ডিসেম্বরে একটি আন্ত:মন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, একটি কমিটি করা হয়, এ বিষয়ে একটি নীতিমালা তৈরি এবং ব্যয় নির্ধারণ করার জন্য।

কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এরপর থেকে এ বিষয়ে আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। এমনকি এ পর্যন্ত কোনো সুপারিশ এবং নীতিমালা তৈরি করতে পারেনি মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে এ বিষয়ে অগ্রগতির কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে অগ্রগতি বলতে গত বছর ডিসেম্বরে সেনানিবাসে সশস্ত্র বাহিনী দিবসে খেতাবপ্রাপ্ত জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে প্রথমবারের মতো পরিচয়পত্র বিতরণ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বীরশ্রেষ্ঠদের পরিবারের সদস্য ও অন্য খেতাবপ্রাপ্তদের সম্মানির চেক, শাল, মোবাইল ফোন-ট্যাব দেন তিনি।

সেই অনুষ্ঠানেও প্রধানমন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধাদের যথাযথ মর্যাদা প্রদর্শন ও তাদের অবদানের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেন। প্রধানমন্ত্রী মুক্তিযুদ্ধকে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ অধ্যায় অভিহিত করে বলেন, ‘বাংলাদেশ রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করে।  মুক্তিযোদ্ধারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অনন্য অবদানের মাধ্যমে লাল-সবুজের পতাকাসহ একটি স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছেন। এজন্য আমাদের সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের যথাযথ মর্যাদা প্রদর্শন ও তাদের অবদানের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি দিতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।’

২০১২ সালের ২১ নভেম্বর স্বাধীনতাযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের উত্তরাধিকারীদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানেও বিষয়টির পুনরাবৃত্তি করেন। তিনি বলেন, ‘খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের ভিআইপি মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা প্রদানের বিষয়টি আমাদের সক্রিয় বিবেচনাধীন আছে।’

কিন্তু এতো বছরেও এসব উদ্যোগ বাস্তবে রূপ পায়নি।

মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে বর্তমানে ১১২ জন বেঁচে আছেন। বাকি খেতাবপ্রাপ্তরা বেঁচে নেই। ভিআইপি পর্যাদা দেওয়া হলে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা সার্কিট হাউসের ভিআইপি রুম ব্যবহার, রেল, বিমান, বাস ও লঞ্চে যাতায়াতে বিশেষ সুবিধাসহ রাষ্ট্রীয় অন্যান্য সম্মান ও মর্যাদা এবং সুবিধা ভোগ করতে পারবেন বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

প্রসঙ্গত, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, বর্তমানে দেশে ৫ হাজার ৬৬৬ জন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। আর খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৬৭৬। এদের মধ্যে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধি পান ৭, বীর উত্তম ৬৮, বীরবিক্রম ১৭৫ এবং বীর প্রতীক খেতাব পান ৪১৬ জন। এদের মধ্যে এখন কতজন বেঁচে আছেন তার কোনো পরিসংখ্যান নেই মন্ত্রণালয়ে। 

এ ব্যাপারে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ‘২০০৯ সালের শেষ দিকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অনুযায়ী খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের ভিআইপি মর্যাদা দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। তারা কি কি সুবিধা পাবেন- এ বিষয় নিয়ে একটি সুপারিশ তৈরির প্রক্রিয়াও শুরু হয়। তখন খেতাবপ্রাপ্তদের পাশাপাশি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের ওই মর্যাদা দেওয়া যায় কিনা তাও বিবেচনাধীন রাখা হয়। কিন্তু এরপর থেকে আর কোনো অগ্রগতি হয়নি বিষয়টির।’

মেলেনি যুদ্ধাহতদের ভিআইপি মর্যাদাও : ২০০৯ সালের নভেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রী ঢাকা সেনানিবাসে এক অনুষ্ঠানে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের ভিআইপির মর্যাদা দেওয়ার বিষয়টি সরকারের সক্রিয় বিবেচনায় রয়েছে বলে উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু এই প্রস্তাবনাটিও দীর্ঘদিন ধরে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পড়ে আছে বলে জানা গেছে।

তবে সরকার যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বাড়িয়েছে। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ভাতা সর্বোচ্চ ক্ষেত্রে ১৯ হাজার টাকা আর সর্বনিম্ন ৩ হাজার টাকা করা হয়েছে।

এদিকে ওই সময়ে দেশে প্রথমবারের মতো যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের বিদেশে নিয়ে উন্নত চিকিৎসার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ বিষয়েও একটি নীতিমালা প্রণয়নের কাজ শুরু করা হয়। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ মিলে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকও করে। তখন পরিকল্পণা করা হয়, বিদেশে চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল বিধায় তা দেওয়া হবে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের এবং যদি তা প্রয়োজন পড়ে। বিশেষ করে বিদেশে পাঠানোর আগে মেডিক্যাল বোর্ডের মতামত নেওয়া হবে। মেডিক্যাল বোর্ড কোন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার ব্যাপারে মতামত প্রদান করার পর তাঁকে উন্নত চিকিৎসার উদ্দেশ্যে বিদেশ পাঠানো হবে। এ বিষয়েও কোনো অগ্রগতি হয়নি।

তবে বর্তমানে দেশের কয়েকটি সরকারি হাসপাতালে মুক্তিযোদ্ধাদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সুবিধা দেওয়া হয়। আগামী বছর নাগাদ দেশের সব সরকারি হাসপাতালে এই সুবিধা চালু হবে বলে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।

এসব বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য হচ্ছে, ‘গত আট বছরে মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে বেশকিছু কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। প্রথমদিকে নেওয়া পরিকল্পনাগুলো পরবর্তী সময়ে অন্য কোনো প্রকল্পের সঙ্গে যোগ করা হয়েছে। এর ফলে কিছু উদ্যোগে ভাটা পড়ে গেছে।

তবে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাকে ভিআইপি মর্যাদা দেওয়ার বিষয়টি এখনো সরকারের পরিকল্পনায় রয়েছে বলে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সচিব অপরূপ চৌধুরী জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাদের যোগ্য সম্মান জানানো আমাদের কর্তব্য। সরকারেরও পরিকল্পনা রয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ সম্মানপ্রাপ্তি নিশ্চিত করার। এ জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ ও কর্মসূচি গ্রহণ করা হচ্ছে।

খেতাবপ্রাপ্ত ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বা ভিআইপি মর্যাদা দেওয়াসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো চলমান প্রক্রিয়ায় রয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

প্রসঙ্গত, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছে, স্বাধীনতার স্বপ্ন ও মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার বাস্তবায়নে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হবে। এছাড়া সকল মুক্তিযোদ্ধাকে সম্মানিত নাগরিক হিসেবে রেল, বাস ও লঞ্চে বিনা খরচে চলাচল করার সুযোগ দেওয়ার কথাও বলা হয়।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১২ ডিসেম্বর ২০১৭/হাসান/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়