ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

খেলাপি ঋণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্তরায় : ইউনুসুর রহমান

কেএমএ হাসনাত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:০১, ১৬ আগস্ট ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
খেলাপি ঋণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্তরায় : ইউনুসুর রহমান

কেএমএ হাসনাত : অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের বিদায়ী সিনিয়র সচিব মো. ইউনুসুর রহমান বলেছেন, খেলাপি ঋণ দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির অন্যতম প্রতিবন্ধক। খেলাপি ঋণ সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে পারলে আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেশ কয়েকগুণ বাড়বে।

তিনি বলেন, ‘দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। এ খাতে নেতিবাচক দিকের পাশাপাশি ইতিবাচক দিকগুলোও সংবাদ মাধ্যমগুলোতে তুলে ধরা উচিত।’

সম্প্রতি রাইজিংবিডির বিশেষ প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনাকালে তিনি একথা বলেন।

এসময় তিনি বলেন, ‘২০১৬ সালে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব হিসেবে যোগ দেওয়ার পর এ খাতের অনেক কিছুই আমি অবহিত হয়েছি। বিদায়কালে ব্যাংকিং খাতের উন্নতির জন্য কিছু সুপারিশ করে যাবো।’

বৃহস্পতিবার তার শেষ কর্মদিবসে, হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের (বিএইচবিএফসি) সুদের হার কমানো সংক্রান্ত একটি ফাইল, ব্যাংকিং খাতের সর্বশেষ অবস্থা নিয়ে সব ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সঙ্গে বৈঠকের সিদ্ধান্ত সংক্রান্ত একটি ফাইলসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ফাইল অর্থমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠিয়েছেন বলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।

২০১৬ সালের ২০ মার্চ ইউনুসুর রহমান আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের দায়িত্ব পান। ১৬ আগস্ট ২০১৮ তিনি অবসরোত্তর ছুটিতে যান। প্রায় আড়াই বছরের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ ‘ব্যাংকিং খাত সম্পর্কে বিশেষ প্রতিবেদন’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব নজিবুর রহমানের কাছেও পাঠানো হয়েছে বলে বৃহস্পতিবার ইউনুসুর রহমান জানান।

প্রতিবেদনে তিনি  বলেন, দেশের ব্যাংকিং খাতে গত এক দশকে শিডিউল ও নন-শিডিউল মিলিয়ে ব্যাংকের সংখ্যা ৪৮ থেকে বেড়ে হয়েছে ৬৩। ঋণ, আমানত ও গ্রাহক সংখ্যায় উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে তবে বিকাশের এই পথে ব্যাংকিং খাতের সংকটও কম নয়। বিশেষ করে খেলাপি ঋণের কারণে বড় ধরনের সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে ব্যাংকিং খাত।

প্রতিবেদনে পাঁচটি পয়েন্ট আকারে ব্যাংকিং খাত নিয়ে নিজের মতামত তুলে ধরেছেন তিনি। এগুলো হলো ব্যাংকিং খাতের প্রসার/বিকাশ, ব্যাংকিং খাত নিয়ে নেতিবাচক প্রচার, সরকার কর্তৃক মূলধন ঘাটতি বাবদ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকে অর্থ প্রদান, খেলাপি ঋণ ও ব্যাংকিং কমিশন গঠন প্রসঙ্গ।

এতে বলা হয়েছে, ব্যাংকিং খাতের প্রসারে বিগত ১০ বছরের একটি তুলনামূলক চিত্র উপস্থাপন করা হয়। এতে বলা হয়, ২০০৮ সালে দেশে যেখানে ব্যাংকের সংখ্যা ছিল ৪৮টি, সেখানে ২০১৮ সালে এ সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৬৩টি। একইভাবে ব্যাংক শাখার সংখ্যা ৬ হাজার ৮৮৬ থেকে বেড়ে ৯ হাজার ৯৮১টি, ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা ৩ কোটি ৭৬ লাখ থেকে বেড়ে ৮ কোটি ১৭ লাখ (২০১৭ পর্যন্ত), ঋণগ্রহীতা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৮৬ লাখ থেকে বেড়ে ২ কোটি ৭৪ লাখ (২০১৭) হয়েছে। এছাড়া গত এক দশকে ব্যাংক আমানতে ২৯৮ শতাংশ এবং ব্যাংক ঋণ ও অগ্রিমে ৩১৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। কোনো কোনো সূচকে ব্যাংকিং খাতের বিকাশ দেশের সার্বিক প্রবৃদ্ধিকেও ছাড়িয়ে গেছে।

প্রতিবেদনে ব্যাংকিং খাত নিয়ে নেতিবাচক প্রচার অংশে বলা হয়েছে, বর্ণিত সময়কালে ব্যাংকিং খাতে কয়েকটি নেতিবাচক ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় অধিকাংশ বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, কিছু বিষয় প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

মূলধন ঘাটতি মেটাতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে সরকার কর্তৃক অর্থ জোগান প্রসঙ্গে ইউনুসুর রহমান বলেছেন, রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় মূলধন ঘাটতি মেটানোর জন্য সরকারি তহবিল থেকে অর্থ প্রদানের বিষয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। সমালোচকদের মূল বক্তব্য হলো, ব্যাংকের অব্যবস্থাপনার ফলে সৃষ্ট লোকসান রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে পুষিয়ে দেওয়াটা যৌক্তিক নয়। তবে শুধু অব্যবস্থাপনার কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর লোকসান হয় না উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোকে বিনামূল্যে নামমাত্র ফি নিয়ে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতাধীন বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের পক্ষে কাজ করতে হয়। ব্যাংকগুলো এ কাজ না করলে মন্ত্রণালয় বা বিভাগের অনেক জনবলের প্রয়োজন হতো। বিনামূল্যে সরকারের পক্ষে কাজ করার কারণেও ব্যাংকগুলোর লোকসান বৃদ্ধি পায়। এ অবস্থায় সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীসহ সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচিতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর জন্য সেবামূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া যেতে পারে। এজন্য প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দও থাকতে পারে। এ উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে সরকারি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি মেটানোর জন্য যে সমালোচনা, সেটি থেকে বেরিয়ে আসা যাবে বলে আমি মনে করি। 

বহুল আলোচিত ব্যাংকিং কমিশন গঠন প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংকিং খাতে নানামুখী সমালোচনার মধ্যে বিভিন্ন মহল থেকে ব্যাংকিং সংস্কার কমিশন (ব্যাংক কমিশন) গঠনের সুপারিশ করা হচ্ছে। কিন্তু সরকার তা করেনি। আসন্ন নির্বাচনের আগে পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী বা সুশীল সমাজের সমন্বয়ে এ রূপ ব্যাংক কমিশন গঠন না করার সিদ্ধান্ত যথাযথ বলে প্রতীয়মান হয়। তবে এ কথা সত্য যে, ব্যাংক ব্যবস্থার বিভিন্ন ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন বা নতুন উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে। নির্বাচন-পরবর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর এরূপ নতুন উদ্যোগ বাস্তবায়ন যুক্তিযুক্ত হবে। এ জন্য এখন থেকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে কাজ শুরু করে নির্বাচনের আগেই কিছু সুপারিশ প্রণয়ন করা যেতে পারে। নির্বাচন-পরবর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর (বা ১০০ দিনের কর্মসূচি প্রণীত হলে) প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ওই সুপারিশমালা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিতে পারবে।

ইউনুসুর রহমান তার প্রতিবেদনে খেলাপি ঋণ প্রসঙ্গে বলেছেন, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর অন্যতম বড় সমস্যা খেলাপি ঋণ। সমস্যাটি দিনে দিনে প্রকট হচ্ছে। ছোট ও মধ্যম আকারের ঋণ বিতরণ ও আদায় কার্যক্রম মোটামুটি স্বাভাবিক হলেও বড় ঋণের গ্রাহকরা সময়মতো ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে পুনঃতফসিল অনুমোদন করিয়ে নিয়েছেন।

পুনঃতফসিলকৃত ঋণের কিস্তিও সময়মতো পরিশোধ না করায় আবারো খেলাপি হচ্ছেন। এ অবস্থায় এসব বড় ঋণ খেলাপির বিষয়ে অনেকের ধারণা জন্মেছে যে, এদের মধ্যে কিছুসংখ্যক গ্রাহক ব্যবসায় কাঙ্খিত সফলতা না পাওয়ার ফলে খেলাপি হলেও বেশির ভাগই ইচ্ছাকৃতভাবে ঋণ পরিশোধ করছেন না। এ বিষয়ে কোনো কোনো মহল বড় ঋণ খেলাপিদের কাছ থেকে ঋণ আদায়ে সরকার বা মন্ত্রণালয়কে সংশ্লিষ্ট হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন।

এ বিষয়ে সদ্য বিদায়ী সচিবের পরামর্শ হচ্ছে, নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস আগে বড় ঋণ আদায়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট হওয়া সমীচীন হবে না। তবে সরকার এখন থেকে শুরু করে নির্বাচনের মধ্যবর্তী সময়ে বড় ঋণ খেলাপিদের বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে রাখতে পারে। নির্বাচনোত্তর নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর এসব খেলাপির বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়াটাই সমীচীন হবে বলে মনে করি।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৬ আগস্ট ২০১৮/হাসনাত/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়