ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

উপকূলের পথে

গাঙ ভাসায়, গাঙ বাঁচায়!

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৩৫, ১৮ জুন ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
গাঙ ভাসায়, গাঙ বাঁচায়!

রফিকুল ইসলাম মন্টু: গাঙ ভাসায়, গাঙ বাঁচায়! গাঙের তীরেই বসতি। ক্রমাগত বাঁক বদলানো গাঙ নিঃস্ব করে বহু মানুষকে। ভাঙ্গনের কবলে পড়ে গাঙ দুই কিলোমিটার পেছালে বসতিও ঠেকে সেই পর্যন্ত গিয়ে। উপকূলের পিঠ দেয়ালে ঠেকে যাওয়া মানুষেরা এভাবেই বেঁচে আছেন। ভাঙন তীরবর্তী মানুষেরা বিশ্বাস করেন, গাঙ যেভাবে ক্ষতি করে, সব ভাসিয়ে নেয়; ঠিক তেমনি আবার বাঁচিয়ে রাখে। নদীকে মধ্য-উপকূলের মানুষেরা ‘গাঙ’ বলে চেনে।

পশ্চিমের বউ বাজার, শুঁটকি পল্লী খেয়াঘাট ঘুরে নদীর তীর ধরে কাঁচা রাস্তা চলে গেছে নয়ারচর, মিটার বাঁধ, বাইলাবুনিয়ার দিকে। এটুকু স্থানে বিগত ১০-১৫ বছরে কত মানুষ যে নিঃস্ব হয়, তার হিসাব নেই। ভাঙনে বেড়িবাঁধ ধ্বসে গেলে নির্মিত হয়েছে নতুন বাঁধ। এভাবে ৩-৪ বার। তবে প্রথম বাঁধের মত শক্ত বাঁধ কখনোই হয়নি। এটি পটুয়াখালীর দ্বীপ ইউনিয়ন চরমোন্তাজের গল্প। হুবহু এমন চিত্র মিলবে উপকূলের আরও অনেক স্থানে। চরমোন্তাজের নয়ারচরের ভাঙন কবলিত এলাকায় বছরখানেক আগে নতুন বাঁধ হলেও সেটি আবার ঝুঁকির মুখে। এটাকে ঠিক নতুন বাঁধ না বলে পানি ঠেকানোর জন্য ‘মাটি ফেলা হয়েছে’ বলা চলে। স্থানীয় বাসিন্দাদের ভয়, এবার স্রোতের চাপ বড়লে মাটি সরে গিয়ে বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। এই পথে হাঁটি আর বছর চারেক আগের ছবির সঙ্গে দৃশ্যপট মিলাই। যেন পুরোটাই বদল। স্থানের সঙ্গে হারিয়েছে অনেক বসতি-মানুষ। অনেককে খুঁজে পেলাম না।

নয়ারচরে বেড়িবাঁধের ওপরে জাহাঙ্গীর হাওলাদারের দোকানে মানুষের জটলায় ল্যাপটপের পুরানো ছবি দেখাই, তারা আঙুল তুলে বলেন, ‘সে অনেক আগে পরিবারসহ অন্যত্র চলে গেছে, সে মারা গেছে, তার বাড়ি এখন ওইদিকে।’ সর্বত্রই যেন পরিবর্তনের ছাপ। আমার ফটো ফোল্ডারে থাকা কেউ আবার জীবিত নেই। মনটা ভারাক্রান্ত হয়। জাহাঙ্গীর হাওলাদারের দোকানের পূর্বে পুরানো ভাঙা বেড়িবাঁধের মাথাটা নদীর সাথে গিয়ে মিশেছে। কিন্তু এই অংশটুকুতেও দেখি বেশকিছু ঘর। অন্য কোথাও যাওয়ার সুযোগ হয়নি বলে এরা এখনও এখানেই পড়ে আছেন। জাহাঙ্গীর হাওলাদার, বয়স ৪০। নয়ারচরের স্থায়ী বাসিন্দা। ৯ বছর ধরে জীবিকার অবলম্বন হিসেবে দোকান করেছেন বাঁধের ওপরে। সঙ্গেই থাকার ঘর। পরিবার পরিজনসহ থাকেন এখানেই। কিন্তু নদী ভাঙন তাকে তাড়িয়ে ফিরছে। তিন বার বদল করতে হয়েছে দোকান ও বাড়ি। দোকানে নিজের আসন থেকে উঠে এসে এক কাপ লাল চা এগিয়ে দিতে দিতে জাহাঙ্গীর জানালেন, ‘কী করবো? যাওয়ার তো কোন জায়গা নেই। তাই বাঁধের ধারেই আছি। নদীর ব্যবসা বাণিজ্য আছে। বেচাকেনা হয়। চলে যাচ্ছে এভাবেই।’
 


পুরানো বেড়িবাঁধের শেষ মাথায় একেবারেই নদী লাগোয়া ঘরটি খাদিজা বেগমের। বয়স কতই বা ৪৫ হবে। বিকেলের রান্নায় ব্যস্ত। ঘরের সামনে রান্নার হাড়িপাতিল এলোমেলো। নদী থেকে ধরে আনা একটা পোয়া মাছ, ৭টি গাগড়া মাছ, ১টি চিংড়ি মাছ আর টুকরো কিছু গাগড়া মাছের ডিম একসঙ্গে ভাজছিলেন। কথা বলতে বলতেই মাছগুলো ধুয়ে চুলোয় বসালেন খাদিজা। তেল কম থাকায় মাছগুলো কড়াইয়ের সঙ্গে বারবার লেগে যাচ্ছিল। আর খাদিজা বেগম চুলোর লাকড়ি টেনে আগুন কমিয়ে তা সামলানোর চেষ্টা করছিলেন। সারাক্ষণ কাজের মধ্যে থাকা রোদে পোড়া শরীর খাদিজার সংবাদকর্মীদের সঙ্গে কথা বলতে কোন দ্বিধা নেই। ছবি তুলতেও বাঁধা নেই। কিন্তু বাঁধ থেকে খানিক দূরের বাড়ি থেকে আসা সোহরাব ডাক্তারের দ্বিতীয় স্ত্রী জহুরা বিবি পাশ থেকে বলতে শুরু করলেন, ‘এত ছবি তুলে কী অইবে? কত ছবি তো তুললেন। মোরা তো কিছু পাইলাম না।’ জহুরা বিবির সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল চার বছর আগে। তখন তারা ছিলেন মিটার বাঁধের ওপরে। সে বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় তারা একটু দূরে সরে গিয়ে বাড়ি করেছেন। তিনি এসেছেন নিজের গাছের বোম্বাই মরিচ বিক্রি করতে। খাদিজা বুঝলেন এবং বললেন ‘১০ টাকার বেশি দিতে পারবো না।’ জহুরা রাজি। কাপড়ে বাঁধা মরিচগুলো বের করে গুনে গুনে ১২টি বোম্বাই মরিচ তুলে দিলেন খাদিজার হাতে। খাদিজা জানিয়ে দিলেন, ‘আজ টাকা দিতে পারবো না।’ জহুরা সায় আছে তাতে- মাথা নাড়েন। বলেন, ‘কাল আসমু।’             

নীল জমিনে হলুদ শাড়ি পড়া কাজের ফাঁকেই বলছিলেন সব কথা। ঘরে অল্প কিছু চাউল ছিল, নদী থেকে ধরা হয়েছে মাছ। কিছু মাছ বিক্রি করে বাকিটা রেখেছেন নিজেদের খাওয়ার জন্য। নদীর পাড়ে পুরানো বেড়বাঁধের শেষ মাথায় নদী তীরের জায়গাটি বেশ খাড়া। উপর থেকে তাকালে শুকনো নদীর পানি বেশ দূরে। এখানে খাদিজার ঘর। ঠিক ঘর নয়, বলা যায় ‘ঝুপড়ি’। পুরানো চটের বস্তা, পলিথিন আর খরকুটা দিয়ে বানানো দোচালা ঝুপড়ি। স্বামী কাশেম বয়াতি এবং দুই সন্তান সুমন ও সুজনকে নিয়ে এখানেই থাকেন খাদিজা। আমি ঘরে ঢোকার অনুমতি নেই। খাদিজা বেগমের আপত্তি নেই। ঘরে ঢুকে দেখি, ঘরের অর্ধেকটা জুড়ে একটা মাত্র চৌকি। ছোট ছেলে সুজন কাঁথা মুড়ি দিয়ে জ্বরে কাতরাচ্ছে। ঘরের ভেতরে হাড়ি, পাতিল, পানির ড্রাম, অনেকগুলো কৌটা এলোমেলো পড়ে আছে, চালার সঙ্গে ঝুলছে নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্যান্য উপকরণ। ঘরের চৌকির ওপর বসে উপরের দিকে তাকালে পলিথিনের ছিদ্র দিয়ে আকাশ দেখা যায়। বৃষ্টি হলে এই ঘরের অবস্থা কী হয়, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। ঘরের সামনেটাই যেন খাদিজার রান্নাঘর। খোলা জায়গায় মাটির চুলা। পাশে পানির ড্রাম, পাতিল, বালতি; এমনকি ছেলেদের কাঁকড়া ধরার ঝুড়িটিও পড়ে আছে সেখানে। খাদিজা বলেন, ‘আমরা কোথায় যাবো? কোন জায়গায় গিয়া জমি কিন্না ঘর বানানোর সাধ্য তো আমাদের নাই। নদী ভাঙে, আমরাও পিছায়। ওই নদীর মাঝখানে আমাগো বাড়ি ছিল। পিছাইতে পিছাইতে এই পর্যন্ত আইছি। তিনডা বাঁধ দেকছি। এই জনমে আরও কয়ডা দেকতে হবে, জানি না।’
 


খাদিজার কাছে বোম্বাই মরিচ বিক্রি করতে আসা জহুরা বিবি দীর্ঘক্ষণ পাশে দাঁড়িয়ে। আমি তার দিকে তাকাই। একটা পরিচিত মুখ। মনে করতে পারি, চার বছর আগে মিটার বাঁধ এলাকায় তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। চার বছরে তার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। শুধু বদল হয়েছে বাড়ির স্থান। মিটার বাঁধের যেখানে তাদের ঘর ছিল, ঘরের চালা তৈরিতে স্বামী সোহরাব ডাক্তারকে সহযোগিতা করেছিলেন জহুরা; সেই স্থানটি ভেঙে গেছে অনেক আগেই। তাদের ঘরের পাশে ছিল চরমোন্তাজের সঙ্গে আন্ডারচরের প্রস্তাবিত ক্রসবাঁধের ভিত্তিপ্রস্তর। বহু প্রতিক্ষিত সেই ক্রসবাঁধ তো হয়ই নাই; বরং শ্বেত পাথরের ওপর নামখচিত ভিত্তিপ্রস্তরটিও হারিয়েছে নদীতে। নিজের বয়সের প্রায় দ্বিগুণ বয়সী স্বামীর সঙ্গে সেই ছোটবেলা থেকে ঘর করছেন জহুরা বিবি। বিয়ের গল্পটা বলতে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। মূল বাড়ি ছিল পটুয়াখালীর দশমিনার আউলিয়াপুরে। জহুরার বোন জামাই আনসার সিকদার আর সোহরাব ডাক্তার একসঙ্গে মাছ ধরতেন। সোহরাব ডাক্তার থাকতেন চরমোন্তাজেই। তার প্রথম স্ত্রী শাফিয়া বেগম থাকতেন দশমিনায়। আনসার সিকদার তর শ্যালিকা জহুরাকে তুলে দেন বয়সী জামাইয়ের কাছে। জীবন কেমন চলছে? জানতে চাইলে জহুরা বলেন, ‘মোরা খেটে খাওয়া মানুষ। কাজকাম করি। তিন বেলা খাই। এই তো অনেক। এতকিছু ভাবার সময় কই?’ এত সমস্যার মাঝেও অসম বিয়ের অনেক ঘটনা চোখে পড়ে, যেখানে নারী হয় ঘটনার শিকার। ঠিক জহুরার মতোই আর কিছু বলার থাকে না!

এলাকার বাসিন্দাদের কাছ থেকে জানতে পারি, নয়ারচর এলাকায় যে বেড়িবাঁধটি বর্তমানে কোনমতে এলাকার মানুষকে জোয়ারের পানি থেকে বাঁচিয়ে রেখেছে, এটি চার নাম্বার বাঁধ। এর আগেও তিনটি বেড়িবাঁধ ধ্বসে গেছে। প্রথমবার বাঁধ ভেঙে যাওয়ার পর আর কখনোই শক্ত করে বাঁধ তৈরি হয়নি। ফলে বার বার ভাঙছে। বিধ্বস্ত প্রায় ২ কিলোমিটার বাঁধ, সামনের বর্ষা মৌসুম, এলাকার মানুষ আতঙ্কিত। এই বাঁধের সঙ্গে ইউনিয়নের তিনটি ওয়ার্ডের প্রায় ৫ হাজার লোক ঝুঁকিতে রয়েছে। জোয়ারের পানির চাপ বাড়লে বাঁধ ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। গত বছরের বর্ষায় বাঁধ উপচে পানি ঢুকতে পারেনি; তবে পানির চাপে বাঁধ দুর্বল হয়ে পড়েছে; জানালেন বাসিন্দারা। এত ভয়, এত শঙ্কা নিয়েও নদী তীরে বাস। বাঁধের বাইরে, বাঁধের ওপরে এবং বাঁধের ভেতরে অসংখ্য বাড়িঘর। প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত এই মানুষদের এটাই নিয়তি। নদী সবকিছু ভাসিয়ে নিলেও এদের বিশ্বাস নদীই তাদের জীবিকার অবলম্বন। হয়তো প্রকৃতির নিয়মে ভাঙন থামবে; আবার ফিরবে সুদিন- এই আশায় প্রহর কাটে ভাঙন তীরের মানুষদের।                 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৮ জুন ২০১৮/তারা   

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়