ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

গান গেয়ে জীবন ধারণ অন্ধ ইমদাদের

মুহাম্মদ নূরুজ্জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৫১, ৭ জুন ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
গান গেয়ে জীবন ধারণ অন্ধ ইমদাদের

মুহাম্মদ নূরুজ্জামান, খুলনা : ভিক্ষার বদলে গানকেই জীবন ধারণের উপায় করে নিয়েছেন অন্ধ ইমদাদ হোসেন বাউল।

‘গুরু উপায় বল না/জনম দু:খী কপাল পোড়া আমি একজনা’, ‘আল্লাহু আল্লাহু তুমি জাললে জালালু/শেষ করাতো যায় না গেয়ে তোমার গুণগান’ অথবা ‘আর কতকাল ভাসব আমি দুঃখের সাগরে’- এই সব মর্মস্পর্শী গান গেয়ে উপার্জিত অর্থ দিয়ে দীর্ঘ ৪৫ বছর সংসারের ঘানি টেনে চলেছেন ইমদাদ হোসেন। ভিক্ষার জন্য মানুষের কাছে হাত পাতার চেয়ে গান গেয়ে মানুষকে খুশি করাই তার কাছে আনন্দের। দুঃখ ভুলে থাকবার একমাত্র অবলম্বন গান। তাই গানকেই জীবন ধারণের উপায় করে নিয়েছেন তিনি। 

১৯৬০ সালে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলার চরকুশলী গ্রামে ইমদাদ হোসেনের জন্ম। বাবা মো. আবু সাদেক ও মা সূর্য বিবির ছয় ছেলে-মেয়ের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। মাত্র আড়াই মাস বয়সে ঘুমন্ত অবস্থায় বিছানায় আগুন লেগে ইমদাদ হোসেনের মাথা, ডান হাত, দুই চোখ, পাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থান পুড়ে যায়। গরিব বাবা-মায়ের শেষ সম্বল ভিটেমাটি বিক্রি করে তাকে চিকিৎসার জন্য ভারতের মাদ্রাজ পর্যন্ত নিয়ে যান। কিন্তু কাজ হয়নি। তার দুই চোখ চিরতরে অন্ধ হয়ে যায়। পচন ধরায় চিকিৎসকরা তার ডান হাতের কনুইয়ের নিচ থেকে কেটে ফেলেন। এরপর থেকে ইমদাদ হোসেনের দুঃখের জীবন শুরু।

ইমদাদ হোসেনের চার বছর বয়সে বাবা আবু সাদেক পরিবারের সদস্যদের নিয়ে খুলনা মহানগরীর পাঁচ নম্বর ঘাটে চলে আসেন। সেখানে তিনি কুলির কাজ করতেন। বাবার এই সামান্য আয় দিয়ে তাদের আটজনের সংসার চলত। এক সময় ইমদাদ হোসেন ভিক্ষায় নেমে পড়েন। এরপর ১০-১২ বছর বয়স পর্যন্ত ভিক্ষা করেছেন। একদিন তার কাছে মনে হয়েছে, ভিক্ষা করলে মানুষের কাছে ছোট হতে হয়। মানুষ গালি দেয়। তাই আর কারো কাছে হাত পাতা নয়। ইমদাদ মা-বাবাকে জানিয়ে দিলেন, তিনি আর ভিক্ষা করবেন না। এর বদলে তিনি গান শিখবেন। আর গান গেয়েই তিনি টাকা আয় করবেন। যে কথা, সেই কাজ। ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে দিয়ে তিনি ১৯৭৪ সালে ১৩ বছর বয়সে খুলনা মহানগরীর গোয়ালখালীর অন্ধস্কুলে হারমোনিয়াম বাজাতে শিখতে যান। পরে ওস্তাদ দেওয়ান মতি মিয়ার কাছে গান শেখেন। আর সেই থেকেই কাটা হাত দিয়ে হারমোনিয়াম বাজিয়ে তার গান গাওয়া শুরু।

খুলনা মহানগরীর জাতিসংঘ শিশুপার্ক, শহীদ হাদিস পার্ক, ডাকবাংলো মোড়, সাতরাস্তার মোড়সহ নগরীর বিভিন্ন স্থানে গান গেয়ে থাকেন তিনি। তিনি মূলত পল্লী কবি জসীম উদদীনের লেখা এবং আব্দুল আলীম, আব্বাস উদ্দীনের গাওয়া গানই বেশি গেয়ে থাকেন। তার সুরেলা কণ্ঠের গান শুনে মানুষ জড়ো হয়ে যায়। তারা খুশি হয়ে যে পয়সা দেন, তাই দিয়েই চলে তার সংসার।

ইমদাদ হোসেন বাউল বলেন, ‘আমি দুঃখের গান গাই, সুখেরও গানও গাই। আবার দর্শকদের পছন্দের গানও গাই। আর এই গান গায় জীবন ধারণের জন্য।’

তিনি জানান, গান গেয়ে প্রতিদিন তার ২০০-২৫০ টাকা আয় হয়। কখনো কখনো ৪০০-৫০০ টাকাও হয়। এই টাকা দিয়েই চলে তাদের চারজনের টানাটানির সংসার।

তিনি বলেন, গান গেয়ে উপার্জিত অর্থ দিয়ে তিনি তার তিন মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। এখন সংসারে স্ত্রী আর দুই ছেলে আছে। তারা ছোট, তাই আয় করতে পারে না।

তিনি দুঃখ করে বলেন, দুইবার কাগজপত্র জমা দিয়েও দুস্থ শিল্পী ভাতা পাননি। তাই আর আবেদন করেননি। যতদিন বেঁচে থাকবেন, ততদিন গান গেয়ে মানুষকে আনন্দ দিয়ে যাবেন। ভিক্ষা করবেন না।

কথা শেষে চলে যাওয়ার সময় তিনি গুনগুন করে গাইতে থাকেন- ‘গুরু উপায় বল না/জনম দুঃখী কপাল পোড়া আমি একজনা।’



রাইজিংবিডি/খুলনা/০৭ জুন ২০১৭/মুহাম্মদ নূরুজ্জামান/বকুল

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়