ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

গায়ের চাদর সরিয়ে গানটা ওপেন করলাম: সোহেল রানা

রাহাত সাইফুল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:৪৫, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
গায়ের চাদর সরিয়ে গানটা ওপেন করলাম: সোহেল রানা

যুদ্ধের সময় প্রতি মুহূর্তে জীবন নিয়ে আমাদের শঙ্কায় থাকতে হয়েছে। রাজাকারদের সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হয়েছে। কাকে বিশ্বাস করবো, কাকে করবো না- সে বিষয়ও সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়েছে। এই সময়টা আমাদের খাওয়া-দাওয়ায় খুব কষ্ট ছিলো। অনেক সময় আমাদের খাওয়া ঠিকমত হতো না। এর কারণ ছিলো- খাবার পেতাম না। একদিন-দেড়দিন অনেক সময় না খেয়েই থাকতে হয়েছে।

একদিনের ঘটনার কথা বলি। সারা রাত হেঁটে খুব ক্লান্ত হয়ে কেরানীগঞ্জের আটি বাজারের কাছাকাছি একটি জায়গায় আমরা গিয়ে পৌঁছলাম। আমাদের প্রচণ্ড ক্ষুধা লেগেছিল। তখন আমার বন্ধু মোস্তফা মহসিন মন্টু। ও কমান্ডার। মন্টু বললো, খুব ক্ষুধা পেয়েছে, দেখ কিছু খাওয়ার ব্যবস্থা করা যায় কি না। তখন আমরা গায়ে চাদর জড়িয়ে বাইরে বের হতাম। কারণ চাদরের আড়ালে স্টেনগান থাকতো।

আমি ও আরো কয়েকজন হাঁটছিলাম খাবারের সন্ধানে। একটা বাড়ির সামনে গিয়ে দেখলাম কতগুলো মুরগি ছোটাছুটি করছে। কিছু মুরগি বাচ্চা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দেখে মনো হলো, এই বাড়িতে অনেক মুরগি রয়েছে। হয়তো ডিমও পাওয়া যাবে। হাতে যা পয়সা আছে তা দিয়ে ডিমগুলো কিনে নিলে আমরা খেতে পারবো। বাড়িতে ঢুকে এক বয়স্ক মহিলার সঙ্গে দেখা। তাকে বললাম, ‘মা আমাদের কাছে কিছু ডিম বিক্রি করবেন’? সে বললো, ‘বাবা ডিম তো নেই।’ শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। এরপর আমি মন খারাপ করে চলেই আসছিলাম। দশ-বিশ কদম হাঁটার পর ঘুরে আবার পিছন দিকে তাকালাম। দেখি একটি লোক ঐ মহিলার কাছ থেকে দুটো ডিম নিয়ে যাচ্ছে। দেখেই আমার খুব রাগ হলো। আমি টেম্পার হারিয়ে ফেললাম। 

তখনই গায়ের চাদর সরিয়ে গান ওপেন করলাম। আমি তাকে বাজে ভাষায় বকা দিয়ে বলেছিলাম, ডিম থাকা সত্ত্বেও আমাকে দিলেন না কেন? তিনি ততক্ষণে হাত-পা কাপা শুরু করে চিৎকার জুড়ে দিয়েছেন। কোনোমতে বললেন, ‘বাবা ডিম কোথায়?’ আমি বললাম, ‘এইমাত্র আপনি ঐ লোকটিকে ডিম দিলেন, আমি দেখেছি।’ তখন মহিলা বললেন, ‘আমি তো ডিম দেইনি। আমি ওকে বদা দিয়েছি।’ তখন আমি বুঝতে পারলাম, ‘বদা’ হচ্ছে ওদের আঞ্চলিক ভাষা। ডিমকে ওরা বদা বলে। তখন আমি বললাম, ‘আমি বদাই চেয়েছি’। মহিলা সেদিন আমাদের ত্রিশটা ডিম দিয়েছিলেন। কোনো দাম নেননি। টাকা দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তিনি বললেন, ‘তোমরা দেশের জন্য যুদ্ধ করছো। তোমাদের জন্য এতটুকু করতে পেরেছি এটাই সবচেয়ে বড়।’ এই ঘটনার মাধ্যমে প্রমাণ হয় যে, দেশের সব শ্রেণীর মানুষ দেশের স্বাধীনতার জন্য সহযোগিতা করেছেন।

সবগুলো ডিম এনে আমরা সিদ্ধ করেছি। একটা ডিমও আমাদের ভাগে পরেনি। অর্ধেক করে খেয়েছি। বড় অংশটুকু মন্টুকে দিয়েছি, কমটুকু আমি নিয়েছি। তখন মন্টু চোখের পানি ফেলে দিয়ে বললো, ‘দোস্ত আমার পেটে যে ক্ষুধা দশটা ডিম খেলেও কিছু হবে না। তুই তোর ভাগটা কমিয়ে দিলি- এটা করে লাভ নেই। মরলে এক সাথেই মরব।’ সে সময়ের কথাগুলো এখনও মনে করলে চোখে পানি চলে আসে। এভাবেই আমরা যুদ্ধ করেছি।

অনুলিখন: রাহাত সাইফুল

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ ডিসেম্বর ২০১৭/রাহাত/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়