ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

গুচ্ছ ভাস্কর্যটি সম্পূর্ণ করতে চাই : রাশা

আশরাফুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৫১, ১ এপ্রিল ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
গুচ্ছ ভাস্কর্যটি সম্পূর্ণ করতে চাই : রাশা

আশরাফুল ইসলাম : মুক্তিযুদ্ধের সময় তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের (বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়) ভেতরে সাধারণ মানুষকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে হত্যা করা হয়। এরপর লাশের স্তূপ সাজিয়ে গণকবর দেওয়া হয়। সেই নারকীয় হত্যাজজ্ঞের স্মারক হিসেবে গণকবরের ওপরে ‘৭১-এর গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি’ শীর্ষক ভাস্কর্য নির্মাণ করেন ভাস্কর রাশা। যা দেশের একমাত্র গুচ্ছ ভাস্কর্য। এই ভাস্কর্য অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকতে দেখে মর্মাহত হয়েছেন রাশা।

 

সম্প্রতি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে এসেছিলেন ভাস্কর রাশা। অনুষ্ঠানের ফাঁকে তার নির্মিত ভাস্কর্যের সামনে রাইজিংবিডিকে সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন।

 

রাইজিংবিডি : মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র গুচ্ছ ভাস্কর্য নির্মাণ সম্পর্কে জানাতে চায়।

রাশা : মুক্তিযুদ্ধের অম্লান স্মৃতি ধরে রাখতে ব্যতিক্রমধর্মী এই ভাস্কর্যটি ১৯৮৮ সালে নির্মাণ শুরু করি। তবে শেষ করতে সময় লেগেছিল। মাঝে একবার কাজ বন্ধ ছিল। আসলে বড় কাজ করতে গেলে বাঁধা আসবেই। কাজটা শেষে করতে প্রায় তিন বছর লেগেছিল। ১৯৯১ তে শেষ হয়।



রাইজিংবিডি : আপনি বিভিন্ন স্থানে ভাস্কর্য নির্মাণ করেছেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র গুচ্ছ ভাস্কর্য নির্মাণের জন্য জগন্নাথ কলেজকে বেছে নিলেন কেন?
রাশা  : মুক্তিযুদ্ধের সময় জগন্নাথ কলেজ তথা পুরান ঢাকায় নির্যাতনের মাত্রা তুলনামুলক বেশি ছিল। এ ছাড়া সেই সময় নরপিশাচরা সাধারণ মানুষ ধরে এনে তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের ভেতরে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে হত্যা করে। এবং হত্যার পর লাশের স্তূপ সাজিয়ে গণকবর দেয়। সেই নারকীয় হত্যাজজ্ঞের স্মারক হিসেবে গণকবরের ওপরে এদেশের একমাত্র গুচ্ছ ভাস্কর্য ‘৭১-এর গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি’ শীর্ষক ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়।

 

রাইজিংবিডি : এই ভাস্কর্সে আপনি মুক্তিযুদ্ধকে কীভাবে তুলে ধরেছেন?

রাশা : আসলে মুক্তিযুদ্ধ গণমানুষের যুদ্ধ। তাই গণ বিষয় নিয়ে শিল্প করতে দুটি জিনিস থাকে- একটি প্রতীকী, অন্যটি বর্ণনামূলক। যেমন ‘দুর্জয় বাংলা’ এবং ‘অপারেজয় বাংলা’ প্রতীকধর্মী। আর এটা করেছি বর্ণনামূলক। ’৭১-এর অবস্থা তুলে ধরেছি। কামার, কুমার, জেলে, তাঁতি, সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে একটি যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, তার বিস্তারিত তুলে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছি।

 
রাইজিংবিডি : ভাস্কর্যটির বর্ণনার বিস্তারিত জানতে চাই।

রাশা : অবশ্যই জানাবো, ভাস্কর্যটির এক পাশে একাত্তরের গণহত্যা, অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। পাঁচটি পানির ফোয়ারা রেখেছি, এটি দিয়ে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার মৌলিক অধিকারের দাবি তুলে ধরেছি। ভাস্কর্যের নিচে রয়েছে পানি, এটি হলো নদী মাতৃক বাংলাদেশের চিহ্ন। পানির ভেতরে রয়েছে বাংলা বর্ণমালা, এটি আমাদের মাতৃভাষা চেতনাকে প্রমাণ করে। ৫২ এর ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলার মানুষের মাঝে স্বাধীনচেতা ভাবনা আসে। আর বাংলার কাদা মাটির সংমিশ্রণে মানুষ স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারপর বাংলার মাটি, মানুষ, আর ভাষা- একাকার হয়েই ভাস্কর্যটি উপরে উঠতে শুরু করে।

 

একাত্তরের গণহত্যা বিশ্বব্যাপী নিন্দনীয়। এই জন্য সবচাইতে দুর্ভাগ্যজনক ও বেদনার জায়গা হিসেবে চিহ্নিত করতে চেয়েছি ২৫ মার্চের কালো রাতকে। ভাস্কর্যে, ইয়াহিয়া মাতাল অবস্থায়, পাকিস্তানি হানাদাররা হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। গর্ভবতী মাকে অত্যাচার করে হত্যা করছে, হত্যা করে লাশগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সর্বোপরি বাংলাদেশ যেন শ্মশানে পরিণত করেছে। আমি এটাকে একটি পত্রশূন্য বৃক্ষ, তার উপর একটি শকুন বসার চিত্র দিয়ে তুলে ধরেছি।

 

আবার এর পাশেই রেখেছি প্রতিবাদের চিত্র। একদিকে প্রতিবাদ হচ্ছে, আর অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিতে বাংলার কামার, কুমার, জেলে, কৃষিজীবী মানুষ- মোট কথা সর্বস্তরের মানুষে একত্রিত হচ্ছে। যার যা কিছু আছে দা, বটি, খুন্তি, কোচ, বর্শা, সবকিছু নিয়ে যুদ্ধের মুখোমুখি হয়।

 

রাইজিংবিডি : স্বাধীনতা যুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায় কীভাবে তুলে ধরেছেন?

রাসা : সবাই আধুনিক অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। যুদ্ধে নামার পরে যখন যোদ্ধারা বুঝতে পারল যে, পুরাতন পদ্ধতি দিয়ে তাদের সঙ্গে পেরে ওঠা সম্ভব না তখন সবাই একটি পরিপূর্ণ যুদ্ধের জন্য গেরিলা কৌশল, মাঝারি আকারের অস্ত্রের ব্যবহার ও  প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। যেখানে রয়েছে ছোট, বড়, নারী, পুরুষ সব বয়সের মানুষ। সব শেষে একেবারে ডান দিকে দাঁড়িয়ে আছে প্রশিক্ষণ নেওয়া সাহসী এক কৃষকের ছেলে। যার চোখে যুদ্ধ জয়ের নেশা। মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিতে সকলের চোখে প্রতিশোধের নেশা এবং নির্মমতার ছাপ রয়েছে। সবার মাথা একটু সোজা কিন্তু মুখ লাল বর্ণ ধারণ করেছে। এর কারণ হলো- রাগ হলে কালো মানুষের চেহারাও লাল বর্ণ ধারণ করে। আবার অন্যদিকে গণহত্যার রং ধুসর। কারণ, এটি আমাদের স্মৃতি।


রাইজিংবিডি : আমরা জেনেছি ভাস্কর্যটি আংশিক, পরিপূর্ণ করার বিষয়ে আপনি কি ভাবছেন?

রাসা : হ্যাঁ, আপনি ঠিকই জেনেছেন। এটি সম্পূর্ণ করতে পারিনি। আমি ভার্স্কযের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের গণইতিহাসকে পাঁচটি ভাগে প্রকাশ করতে চেয়েছি- একাত্তরের গণহত্যা, মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি, ঘাতক, মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ এবং বিজয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্যে আমি দুটি করতে পেরেছি- গণহত্যা এবং প্রস্তুতি কিন্তু বাকি রয়েছে তিনটি- ঘাতক, মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ এবং বিজয়। ভাস্কর্যটি সম্পূর্ণ করার জন্য জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সুযোগ করে দেওয়ার কথা বলেছিল। জানি না সেই সুযোগ হবে কি না। আমি ভাস্কর্যটি সম্পূর্ণ করতে চাই।

 

রাইজিংবিডি : ভাস্কর্যটির বর্তমান অবস্থা আপনি দেখেছেন। এ বিষয়ে আপনার কিছু বলার আছে?

রাসা :  ভাস্কর্যটি বর্তমানে অনেকটা অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে। এর রক্ষণাবেক্ষণের ভার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের উপর ছিল। কিন্তু তারা এ ব্যাপারে উদাসীনতা দেখাচ্ছে। আর যদি সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়ে থাকে, তবে তা যথেষ্ট নয়। ভাস্কর্যটির আস্তরণ খুলে পড়ছে, উপরে অনেক ময়লা জমে আছে। পানির ফোয়ারা নষ্ট বলে মনে হচ্ছে। নিচে পানি নেই, ময়লা থাকায় বর্ণমালাও দেখা যাচ্ছে না। পানি দিয়ে নদীমাতৃক দেশ বুঝাতে চেয়েছি, কিন্তু এখনকার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে মরুভূমির দেশ বাংলাদেশ।

 

ভাস্কর্যটির এক একটি প্রতীকী চিহ্ন দিয়ে যা বোঝানো হয়েছে, তা আজ অনেকটাই অর্থহীন হয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। আমি এই বয়সে এসে ক্ষোভ প্রকাশ করছি, তা বলব না। ক্ষোভ প্রকাশ করার কথা তরুণ প্রজন্মের। মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র গুচ্ছ ভাস্কর্যের অব্যবস্থাপনা দেখে আমি ব্যথিত ও মর্মাহত। আশাকরি কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে।

 

রাইজিংবিডি : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

রাসা  : আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১ এপ্রিল ২০১৬/আশরাফুল/বকুল

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়

নির্বাহী সম্পাদক: তাপস রায়

প্রকাশক: এস এম জাহিদ হাসান

ঠিকানা: ১৯৮-১৯৯, মাজার রোড,
মিরপুর-১, ঢাকা ১২১৬

একটি স্কাইরুট মিডিয়া লিমিটেডের প্রতিষ্ঠান

টেলিফোন: +৮৮-০১৬৭৮০২৮১৩৬

মার্কেটিং : +৮৮-০১৬৮৬৬৯৩৫৪৯
+৮৮-০১৬৮৬৬৯০২৬৬

ইমেল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা বা ছবি অনুমতি ছাড়া নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি। সকল স্বত্ব www.risingbd.com কর্তৃক সংরক্ষিত