ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

চর থেকে চিরসবুজের ডাকে : ১০ম কিস্তি

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৩৭, ২০ জুলাই ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
চর থেকে চিরসবুজের ডাকে : ১০ম কিস্তি

ফেরদৌস জামান : নৌকার মাঝি এই ভ্রমণের মধ্য দিয়ে আরও আপন হয়ে উঠলেন। সৈকত থেকে ফিরছি দেখে অনবরত পান খাওয়া ঠোঁটে হেসে বললেন, আপনাদের খুঁজতে ছেলেকে পাঠিয়েছি সেই কখন, এখনও ফেরেনি।

কেন খুঁজছেন?

দেড়টার সময় নৌকা ছেড়ে দেব, আপনারা যাবেন কি না সেটা জানতে। কয়েক কথার পর জোর করে তার বাড়িতে নিয়ে গেলেন। বললেন, সময় অনেক আছে, আসেন পান খাবেন।

না না আমরা পান খাই না- অনেক বুঝালাম। কিন্তু তিনি মানলেন না। তার দাবি- মেহমান বাড়ির উঠান থেকে খালি মুখে যেতে দেওয়া উচিত নয়। তাছাড়া একদিন পান খেলে কিছু হবে না।


এরমধ্যে ছেলেও ফিরে এসেছে এবং গাছ থেকে দুটি ডাব পেড়ে রেখেছে। গ্লাসে ডাবের পানি এগিয়ে দিয়ে দুঃখ করে বললেন, ছেলেটা অসুস্থ, বয়সের তুলনায় বেড়েছে কম। তাকিয়ে দেখলাম, সত্যিই তাই। দেহের গঠন বাবার মতো মজবুত নয়। বাবাকে নৌকার কাজে সাহায্য করাই তার একমাত্র কাজ। সারা দিন টো টো করে ঘুরে বেড়ানো ছাড়া আর তেমন কাজ নেই। এদিকে জাবের আর তৈয়ব আমাদের খুঁজে হয়রান। বাইরে বের হতেই দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল দুই ভাই। মাঝির বাড়ি গিয়েছি তাই তাদের মন বেজায় খারাপ। কারণ মাঝির ছেলের সাথে তাদের শত্রুতা। দুই দিন আগে খালে মাছ ধরতে গিয়ে মারামারি হয়েছে এবং মাঝির ছেলে বেশি মার দিয়েছে। তাই এদের কাছে মাঝির ছেলের চেয়ে খারাপ ছেলে এই জগতে আর কেউ নেই।

 




কুৎসা করতে গিয়ে জাবের বলল, মাঝির ছেলের চুরির অভ্যাস আছে। এক সময় নাকি মুরগি চুরি করতো। তবে এখন আর আগের মতো করে না। ওদিকে মোহাম্মদ ভায়ের স্ত্রী আলু দিয়ে মুরগির মাংস রান্না করে রেখেছে, সাথে শুঁটকি ভর্তা। খেতে খেতেই মাঝির ডাক পড়ল- মেহমানরা বের হন, নৌকা ছেড়ে দেব।

দ্বীপের মানুষগুলোর কথা মনে পড়ছে বারবার। নৌকায় উঠে বসলাম। যথারীতি এক সময় যাত্রা শেষ হলো ঘাটে সেই সেতুর নিচে। পথের পাশে শুঁটকির কারখানা পার হওয়ার আগেই দেখা হয় সেই যুবকের সাথে। গতবার দেখা হলে যিনি এক রকম জোর করেই চা-পেঁয়াজু খাইয়েছিলেন। একে তো আমাদের হাতে সময় ছিল না, তারপরও দু’এক কথায় যখন জানলেন ঢাকা থেকে এসেছি, বিশেষ করে মিরপুর থেকে তখন আর ছাড়া পেলাম না। হাত চেপে ধরে বললেন, সর্বনাশ! আমার স্যার মিরপুরের এমপি। এখানে তার চিংড়ি ঘের আছে। আমি দেখাশোনা করি। তার এলাকা থেকে এসেছেন অন্তত চা না খাওয়ালে বেয়াদবি হয়ে যাবে। অনেক বুঝানোর চেষ্টা করেছিলাম বেয়াদবি হবে না, আমাদের হাতে সময় কম। কে শোনে কার কথা? সে খাওয়াবেই। সেবার পরিস্থিতি বেগতিক দেখে হাল ছেড়ে দিতে হয়েছিল। তবে এবার আর সে সুযোগ তাকে দিলাম না। রাতের মধ্যে সিলেট যেতে হবে, যদিও জানা নেই কোথা থেকে এবং কীভাবে যেতে হবে? শুধু এতটুকু জানি সিলেট যাওয়ার জন্য প্রথমে চট্টগ্রাম যাওয়া চাই। ঘাট থেকে একইভাবে আসতে হলো নতুন বাজার। ভেবেছিলাম মহেশখালী সদর গিয়ে আশপাশটা ঘুরে দেখব। তারপর সন্ধ্যার আগ দিয়ে স্পীডবোটে কক্সবাজার গিয়ে রাতটা থেকে যাব। পরে অবশ্য হিসাব কষে দেখলাম, সময় শেষ হয়ে আসছে। অতএব সমুদ্র যথেষ্টই দেখা হলো। এবার অন্য কোথাও।


নতুন বাজারের যে জিনিসটি আমার বেশি ভালো লাগল তা হলো, পেঁয়াজুর সাথে কাঁচা মরিচ আর চনা-মুড়ি (সোলা অথবা মটর কালাই সেদ্ধ সাথে মুড়ি)। এ শুধু নতুন বাজার নয়, চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজারের প্রায় সর্বত্রই পাওয়া যায়। প্রতিটি খাবার দোকানে অন্য কিছু না থাক, পেঁয়াজু আর চনা-মুড়ি থাকবেই। একবার তো কক্সবাজার গিয়ে নামার পরপরই প্রচণ্ড ক্ষুধা পেল। ডলফিন মোড়েই খাবার দোকানে ঢুকে এক বাটি চনা আর কয়েকটা পেঁয়াজু দিয়ে তিন থাল ভাত খেয়েছিলাম। দোকানের প্রায় সব কর্মচারী চেয়ে চেয়ে দেখছিল আমার চনা-ভাত ভক্ষণ। নতুন বাজার আজ অনেক জমজমাট, বোধহয় হাটের দিন হবে। দোকান থেকে পেঁয়াজু কিনে পানের খোঁজ করছি- কোথায় হরেক মশলা দিয়ে মহেশখালীর মিষ্টি পান পাওয়া যাবে? অমনি চল্লিশের ওপরে বয়স এক সিএনজি অটোরিকশাচালক হাঁক ছেড়ে বলল, নতুন ব্রীজ, নতুন ব্রীজ। জনপ্রতি ভাড়া কত জেনে নিয়ে বললাম, একটু অপেক্ষা করুন পান নিয়ে আসছি।

 

ঠিক হে কোই বাত নেহি, যাইয়ে অর পান খাকে মু লাল করকে আ যাইয়ে। হঠাৎ হিন্দি কথা শুনে চমকে উঠলাম। পান মুখে দিয়ে স্ট্যান্ডে ফিরে লক্ষ্য করি তিনি অন্য চালকদের সাথে হিন্দিতেই কথা বলছেন। কৌতূহল আরও বেড়ে গেল। অন্যরা তার সাথে স্বাভাবিকভাবেই কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছে, আমাদের মতো চমকে উঠছে না। গাড়ি ঘুরাতে গিয়ে পাশের গাড়ির সাথে ঠোকাঠুকি হওয়ায় দুজনের মধ্যে দু’চারটি উচ্চবাচ্য হলো, সেটিও হিন্দিতে।


চুপচাপ নেই। মুখে পান ঠেসে দিয়ে কথা বলছে তো বলছেই। ফাঁকে ফাঁকে যাত্রী ডাকছে- আইয়ে আইয়ে, জলদি আইয়ে, বারিশ আনেওয়ালা। কয়েক মিনিটের মধ্যে সামনে পেছনে মিলে পাঁচ জন যাত্রী হয়ে গেলে হিন্দি বাবু গাড়ি ছেড়ে দিলেন। ব্রীজ পর্যন্ত পাক্কা দেড় ঘণ্টার পথ আর এই সময়ের মধ্যে তার সাথে কথা চলমান থাকল। কথায় পাঞ্জাবি টানের সংমিশ্রণও লক্ষণীয়। হিন্দি ভাষায় তার পারদর্শিতা ও আগ্রহের বিষয়ে জানতে চাইলে বলল, বান্দাহি এইসা হু। ইছ দুনিয়ামে হাম সাব তো এক এক আজনাবি। ইসি লিয়ে সোচা মর তো যাউঙ্গা সাহি, খোদাকা দুনিয়া কিউ নেহি ঘুমকে দেখু? বাংলাদেশের বহু জায়গা ঘুরতে ঘুরতেই একদিন পাড়ি জমান ইন্ডিয়া। অবৈধভাবে প্রবেশ করে কলকাতায় কিছু দিন থেকে চলে যান শিলিগুড়ি। চায়ের দোকানে কাজ করা, বাসের হেলপারগিরি করা, কি করেন নি। এবার একটু থেমে বললেন, দুনিয়া ঘুরে দেখার জন্য গু সাফ করা ছাড়া সব কাজ করেছি। কয়েক বছর শিলিগুড়ি থাকার পর হঠাৎই একদিন পাড়ি দেন কেরালা, তারপর পাঞ্জাব। পাঞ্জাবের বিভিন্ন জায়গায় চার-পাঁচ বছর কাটানোর পর মন চাইল এবার দেশে যাওয়া দরকার তাই দেশে ফিরে এসেছেন। এখন নিজ এলাকায় সিএনজি অটোরিকশা চালান। সে সাথে পুরোদস্তুর সংসারী একজন মানুষ। এরপরও নাকি মন চায় অজানা কোথাও উড়াল দিতে। কথা চলছে হিন্দি-বাংলার মিশ্রণে। এর মাঝে যাত্রী ওঠা-নামা এবং ভাড়া নেয়ার কাজ সঠিকভাবেই চলমান। একজনের সাথে ভাড়া নিয়ে কথা কাটাকাটিও হলো। যাত্রী বাংলায় যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে তো সে করে হিন্দি ভাষায়। ভালোভাবে খেয়াল করলে দেখা যায় আমাদের মধ্যে কম বেশি একটি প্রবণতা আছে, রাগ হলে বা চটে গেলে ইংরেজি বলা। তার ক্ষেত্রেও তাই ঘটল, গড়গড় করে বলা হিন্দি কথা না বোঝার দরুন যাত্রীটির যেন নিজের চুল নিজেই উপড়ে ফেলার উপক্রম। এক পর্যায়ে কথা না বাড়িয়ে কোছার উপর টাকা ছুড়ে দিয়ে বিদায় হলো। এরপরও যাত্রীর মুক্তি নেই। ডেকে বলল, বেয়াকুফ খোদা ইয়ে দোনো হাত কিছিকে লিয়ে দিয়া, উঠা তেরে পায়সা, অর হাতমে দে। এ নিয়েও চললো কিছুক্ষণ। শেষমেশ হার মেনে যাত্রী মহোদয় টাকা তুলে তার হাতে দিয়ে যেন প্রাণে বেঁচে গেল। চলতি পথের বিভিন্ন জায়গার দোকানদার বা ব্যবসায়ী অনেকেই তার পরিচিত। কিছুক্ষণ পরপরই মাথা হেলে ডানে বাঁয়ে জিজ্ঞেস করছে, পাঁজি কেইছে হো? মন খোলা, স্পষ্টভাষী এবং হিন্দি ভাষায় কথা বলার কারণে তাকে চলতি পথের প্রায় সকলেই চেনে।

 




এমন পরিস্থিতির মধ্যেই আমরা ঠিক করি এই ভ্রমণে দেখা বিভিন্ন চরিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মানুষগুলোকে নিয়ে যৌথভাবে একটি গ্রন্থ রচনা করব। বইয়ের নামও নির্ধারণ করা হলো ‘ক্যারেক্টার্স থ্রু ফিফটিন হানড্রেড মাইলস’। জানি না সে বই কখনও লেখা হয়ে উঠবে কি না তবে একটি ভ্রমণ কাহিনি তো অন্তত লেখা চলমান। যাহোক, নেমে পড়তে হলো নতুন ব্রীজ। নেমেই বৃষ্টির কবলে পড়ে গেলাম। বেগতিক কাছের দোকানটায় বসে পেঁয়াজু আর চায়ে বেশ খানিকটা সময় পার করলাম। বৃষ্টি ছাড়বার নাম নেই, ওদিকে সময় মতো চট্টগ্রাম পৌঁছতে না পারলে সিলেট যাওয়ার পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে পারে। বৃষ্টি ভেজা হয়ে মহাসড়কে এসে এবার আর মাইক্রোবাস নয়, উঠে পড়লাম বড় বাসে। চট্টগ্রাম মহানগরের দামপাড়া এসে মিলে যায় সিলেটগামী রাতের একমাত্র বাসটি। হাতে সময় গুনে গুনে পনের মিনিট। সামনের দিকে কয়েক মিনিট হেঁটে গেলেই এখানকার একমাত্র খাবারের দোকান। পরোটা আর ডিম ভাজি নিয়ে দ্রুত ফিরতে চাইলে তা দুস্কর হয়ে পড়ল। বর্ষণের পর প্লাবিত রাস্তার পানি সরে গেলেও ড্রেন থেকে উঠে আসা পুরু ময়লা কাদা ঠিকই রয়ে গেছে। বাস প্রায় ছেড়ে দিয়েছে, আমাদের জন্যই অপেক্ষমান। ভেতরে উঠতেই সকলের দৃষ্টি আমাদের দুই জোড়া কাদা মাখা পায়ের দিকে। একজন নারী সাবধানে আসনের উপর পা তুলে নিল, ছিটকে গিয়ে শরীরে লাগলে করার কিছুই থাকবে না। শুরু হলো সারা রাতের অস্বস্তিকর ভ্রমণ। কাদায় মাখা পা এবং হাঁটু পর্যন্ত কালো ছিটার উজ্জ্বল দাগ আর হাতে পরোটা-ডিম নিয়ে বসে রইলাম। 

 

 


রাইজিংবিডি/ঢাকা/২০ জুলাই ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়