ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

চর থেকে চিরসবুজের ডাকে : ১১তম কিস্তি

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৪৭, ১০ আগস্ট ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
চর থেকে চিরসবুজের ডাকে : ১১তম কিস্তি

ফেরদৌস জামান: নির্জন সিলেট শহর, পরিচ্ছন্ন কর্মীরা ঝাড়ু দিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করছে। সবে আলো ফুটে বেড়িয়েছে। ফাঁকা পথে কোনো রিকশা নেই। আপাতত একটা হোটেল খুঁজে বের করা দরকার, গোসল দিয়ে ঝরঝরে না হলেই নয়। সারারাত ঘুমের মধ্যেই পেরিয়ে গেছে। চট্টগ্রাম থেকে সিলেটের দূরত্ব কতখানি জানি না, তবে ভাড়া লেগেছে জনপ্রতি সাতশ পঞ্চাশ টাকা। ভ্রমণের অষ্টম দিন চলমান। ছিলাম সমুদ্রে, সেখান থেকে পাহাড়ে। পাহাড় থেকে পুনরায় সমুদ্র হয়ে চলে এলাম চায়ের দেশ সিলেট।
 


চট্টগ্রাম থেকে সিলেট পর্যন্ত কেমন ছিল পথ, পথের দুই পাশ; কিছুই দেখা হলো না। রাতে কোনো ধরনের ভ্রমণ আমার পছন্দ নয়। পথের চারপাশে কত বৈচিত্র আর সৌন্দর্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে আমরা তার কতটুকুই দেখি? সুতরাং, যে কোনো ধরনের যাত্রাতেই এক ঝলক দেখে নেয়া যায় সেসবের অনেক খানি। আর সেই দেখার অভিজ্ঞতা থেকে নিজেকে বঞ্চিত না করতে চাওয়া থেকেই বোধহয় রাতের যাত্রা বা ভ্রমণ আমার অপছন্দ। শুধু তাই নয়, চলন্ত অবস্থায় কানে হেডফোন লাগিয়ে গান বা অন্য কিছু শোনারও আমি বিপক্ষে। প্রকৃতির কত শব্দ, কোলাহল- এসবও কি শোনা বা উপলব্ধি করার নয়? প্রতি আট কিলোমিটার অন্তর নাকি মানুষের কথায় ভিন্নতা থাকে। কি সুন্দর আমাদের ভাষা, কথা বলার রীতি; এমনকি ঝগড়া! কোনো কিছুই ফেলনা হতে পারে না। তাছাড়া শুধু বই খবরের কাগজ পড়ে অথবা টেলিভিশন দেখে তার কতটুকুই বা উপলব্ধি করা যায়? একেক এলাকার একক শ্রেণী-পেশার মানুষের ভাবনা লুকিয়ে থাকে কথোপকথন আর দৈনন্দিন কাজ-কর্মের মধ্যে, যা আসলে সমগ্র সমাজমানসের ভাবনার অংশ। এই অতি সামান্য বিষয়গুলো নিয়ে সকলের ভাবনাই যে এক হবে তাও আবার প্রত্যাশা করা যাবে না। কারণ একেকজনের দেখার দৃষ্টি একেক রকম।
 


যাই হোক, শহরের কোন জায়গায় আছি জানি না। জানি না মানে ঠিক মনে নেই। একটা হোটেল দেখার পর দ্বিতীয়টাতে চাহিদা ও সাধ্যের মধ্যে ঘর মিলে গেল। বেশিক্ষণ নয়, গোসল করে আধাঘণ্টা বিশ্রামের পরই রওনা দেব লালাখালের উদ্দেশ্যে। লালাখালের কথা অনেক শুনেছি, এবার খালের জলে নৌকা ভাসাবো। শহরের ঘাট থেকে বাসে উঠতে হবে জৈন্তাপুর উপজেলার সারিঘাট যাওয়ার জন্য। রিকশাওয়ালা বলল, নামুন এসে পরেছি। এসে পরেছি মানে? আমরা তো সোবহানীঘাট যাবো। হ্যাঁ, ঠিকই তো আছে, এটাই সোবহানীঘাট! রিকশাওয়ালা অবাক হয়ে শুধু চেয়ে দেখল, কত টাকা ভাড়া দিলাম তা পরখ করেও নিল না। এতক্ষণ তো রিকশায় আসছিলাম আর ভাবছিলাম ঢাকা সদরঘাটের মতো গাদাগাদি করা লঞ্চ না থাকলেও অন্তত নৌকা-টৌকা থাকবে, অনেক মানুষের ভিড় ইত্যাদি। কিন্তু এ তো শহরের একটা রাস্তার মোড় মাত্র! এখান থেকেই ছেড়ে যায় সারিঘাটের বাস। সাধারণ মানের বাস, কোনোমতে ব্যাগ বোচকা নিয়ে বসা যায়। তার ওপর দিয়ে সুজিতের লাইফ জ্যাকেট। সে ওটা ছাড়বার নয়, ভ্রমণের  নিদর্শন হিসেবে সাথে নিয়ে যাবেই যাবে। সুতরাং, যেভাবেই হোক ঢাকা পর্যন্ত টেনে নিতে হবে। পাহাড় পর্যন্ত সাথে করে টেনেছে। নদী-সমুদ্রের লাইফ জ্যাকেট পাহাড়ে সাথে করে নেয়া দেখে অনেকেরই কৌতূহলের কারণ হয় সেটি। সারিঘাট নেমে খুঁজে বের করলাম একটা ওষুধের দোকান- কিভাবে লালাখাল যাওয়া যায় তার খবর জানতে। নতুন জায়গায় গেলে তথ্য সংগ্রহ বা পথ বাতলে নিতে ওষুধ অথবা বইয়ের দোকান বেছে নেয়া আমার অভ্যাস। তাতে তুলনামূলক সঠিক খবর পাওয়া যায়। সড়কের পাশে বাজার আর বাজারের পাশে সড়কের নিচ দিয়েই বয়ে গেছে সারি নদী, স্থানীয়ভাবে যা সারিগাং বলে পরিচিত। পাকা সিঁড়ি দিয়ে নেমে দেখি ছাউনি দেয়া নৌকা বাঁধা। ভাড়া শুনে যেন বিদ্যুতের ঝাকুনি খেলাম। উঠে এসে সোজা হাঁটতে থাকলাম ঐ লোহার সেতুর দিকে। দারুণ একটা সেতু, গাড়ি গেলে কাঁপতে থাকে। ওপারে গিয়ে দেখি বালি বোঝাই নৌকা খালি করা হচ্ছে। বালি নামানের পর লালাখাল ধরে উজানের দিকে যাবে। অতএব, এমন একটা নৌকা হলেই চলবে। শ্রমিকেরা অপারগ, উপরে বসা মহাজনকে দেখিয়ে দিয়ে তার সাথে কথা বলতে বললো। মহাজনের কথার মধ্যে এক ধরনের সুদীর্ঘ টান অনুভূত হলো। বুঝতে পেলাম সুযোগটা সেও ছাড়তে চায় না। বালি নামাতে আধাঘণ্টা লাগবে। মোটা দানার বাদামী বালু, ঢাকার বাজারে বেশ কদর। এই ফাঁকে মহাজনের সাথে ছোলা আর চা পান চললো। বুঝতে পারলাম আগে কোনো মতে ভাবটা জমিয়ে নিতে পারলে বিনা পয়সাতেই যাওয়া যেত।
 


বালি নামানো শেষ, মহাজন সাহেব দোয়া-নসিহতের সহিত বিদায় জানালেন। ফটফট শব্দে নৌকা চললো সারি গাঙ্গের ভাটিতে। কিছু দূর গিয়ে প্রবশ করল খালে। এটাই লালাখাল। মেঘালয়ের পাহাড় থেকে এসে মিশেছে সারি নদীতে। চওড়া খাল, যেন স্বতন্ত্র আর একটা নদী। কয়েক মিনিটের মধ্যে পানির রং নীল হয়ে গেল। লালাখালের নীল জলের কথা আগেও শুনেছিলাম। এতটা নীল তা ভাবিনি। দশ-পনের ফুট পানির নিচেও তলানী দেখা যায়। উভয় পাশে লাল মাটির অনুচ্য টিলার পাড়, তার মাঝ দিয়ে কুলকুল করে বয়ে যাওয়া স্বচ্ছ জলের লালাখাল। জানি না নামের উৎপত্তির ইতিহাসটা আসলে কি? তবে মনে হলো লালাখাল না হয়ে নীলাখাল হলেও মন্দ হতো না। বুকের মধ্যে পুরনো ব্যথাটা উস্কে উঠল। আবারও চোখের সামনে মেঘালয়ের পর্বত শ্রেণী। যত না সুন্দর ঐ পর্বত তার চেয়ে বহুগুণ অপ্রিয় হয়ে উঠছে বিষয়টা। চোখ তো আর বন্ধ করে রাখা যায় না! নীল জল বয়ে আসছে ওপাড় থেকে এপাড়ে। স্পর্শ করে কি যে প্রশান্তি! একাকার হয়ে যাচ্ছে সারিগাং আর মেঘালয়ের পানি। নৌকার তিনজন শ্রমিক ইতিমধ্যেই যথেষ্ট আপন হয়ে উঠেছে। নিমন্ত্রণ জানিয়ে বলল, তাদের বাড়ি থেকে ইন্ডিয়ার পাহাড়গুলো আরও স্পষ্ট দেখা যায়। নৌকায় ওঠার আগে চা খেলাম সে পানি এই খাল থেকেই নেয়া। স্থানীয়রা খাওয়া থেকে শুরু করে দৈনন্দিন অন্যান্য কাজে নির্দ্বিধায় লালাখালের পানি ব্যবহার করে। কৌতূহল দেখে একজন বলল, বোতলের পানি ফেলে দিয়ে খালের পানি ভরে দেখুন তফাৎ খুঁজে পাবেন না। হ্যা সত্যিই তাই! সাধ মিটিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে নিলাম খানিকটা।
 


দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম লালাখাল ঘাটে। বেশিরভাগ পর্যটক সারিঘাট বাজার থেকে অটোরিকশা করে এখানে আসে। লালাখাল ঘাটে নৌকা ভীড়তেই বাংলাদেশের পতাকাওয়ালা ছোট নৌকাগুলো ডাকাডাকি শুরু করল- সীমান্ত দেখতে যাব কি না? ইতিমধ্যেই যা দেখেছি তাতেই যথেষ্ট হয়েছে, সীমান্ত দেখতে গিয়ে খামাখা মনের কষ্ট বাড়িয়ে কাজ নেই। দূরত্ব বেশি নয়, যাওয়া আসায় আধাঘণ্টা। তার চেয়ে বরং খালের স্বচ্ছ জলে খানিকক্ষণ সাঁতার দেয়াটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো। লালাখালের শীতল পানিতে ধুয়ে গেল শরীরে জমে থাকা এত দিনের সমস্ত ক্লান্তি, অনুভূত হলো অনাবিল প্রশান্তি! আর দশ মিনিট, আর পাঁচ মিনিট এমন করে পেরিয়ে গেল প্রায় এক ঘণ্টা। প্রশান্তির সাঁতার শেষে উঠে এলাম বাজারে। বাজার বলতে হাতে গোনা কয়েকটা দোকান। ছোলা-মুড়ি দিয়ে দুপুরের খাবারটা এখানেই সারতে হলো। সারি ঘাটের ফিরতি পথ ধরলাম তবে এবার আর নৌকায় নয়, অটোরিকশায়। গ্রামের মাঝ দিয়ে চিকন রাস্তা, তারপরেই পাথর আর পাথরের শেষপ্রান্ত দিয়ে পাহাড়ের রেঞ্জ। সিলেট-জৈন্তাপুর সড়কের একটা জায়গায় এসে সড়ক দুই ভাগ হয়ে গেছে। অল্প কিছু দূর পর তা আবারও মিলিত হয়ে এক হয়ে গেছে। মাঝের জায়গাটুকুতে বহু আগের চুন-শুরকির ঢালাই দেয়া দোচালা একটা কক্ষ। কক্ষটা সংরক্ষণের জন্যই এখানে সড়ক এভাবে তৈরি করা হয়েছে। নিশ্চয়ই এর পেছনের ইতিহাসে চমৎকার কোনো উপাদান লুকিয়ে রয়েছে! কক্ষের আশপাশে ভালো করে খুঁজে কোনো ফলক বা পরিচিতিমূলক কিছু না পেয়ে হতাশ হলাম। এরই মধ্যে বৃষ্টি শুরু হলো। বৃষ্টির মধ্যেই চলে এলাম সিলেট। সিলেটে নতুন করে কিছু দেখা হলো না, ছুট দিতে হবে শ্রীমঙ্গল। কীন ব্রীজ হেটেই পার হলাম। ব্রিটিশ আমলে নির্মিত সুরমা নদীর উপর লোহার ব্রীজটা এতই উঁচু যে দুপাশে রিকশাগুলো ঠেলে তোলায় নিয়মিত কিছু লোক খাটে। পাঁচ টাকার বিনিময়ে গোড়া থেকে রিকশা ঠেলে উপরে তুলে দেয়। বিচিত্র পেশা, এই সামান্য কাজ করে তাদের আনেকেরই সংসার চলে। বৃদ্ধ এবং যুবকদের পাশাপাশি শিশুরাও এই কাজে বেশ তৎপর। ব্রীজ পেরিয়ে আবারও খানিকটা পথ হেঁটে বাসে করে রওনা দিলাম শ্রীমঙ্গলের উদ্দেশ্যে।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১০ আগস্ট ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়