ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

চীনের বন্ধুরা || শান্তা মারিয়া

শান্তা মারিয়া || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:২৯, ১৪ জানুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
চীনের বন্ধুরা || শান্তা মারিয়া

শাড়ি পরা উৎসবে সুবর্ণা, শিশির, আমি, স্বর্ণা ও লিউ আপা

(চকবাজার টু চায়না শেষ পর্ব)

চীন বেতারের বাংলা বিভাগে কর্মী ছিলেন একুশ জন। এদের মধ্যে তিন জন বাঙালি, বাকিরা চৈনিক। প্রবীণ কর্মী পাই খাই ইউয়ান সবচেয়ে ভালো বাংলা জানতেন। তিনি বাঙালিদের মতোই বাংলা বলতেন। প্রবীণ ও সজ্জন পাইভাই ছিলেন আমার খুব প্রিয় মানুষ। তিনি রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও জসীমউদদীনের কবিতা চীনা ভাষায় অনুবাদ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের অনেক কবিতা ও অন্যান্য লেখা চীনা ভাষায় অনুবাদ করেছেন তিনি। তাকে রীতিমতো রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ বলা যায়। আরেক জন প্রবীণ কর্মী হলেন শিচিউ। তিনিও অমায়িক ভদ্রলোক। অত্যন্ত সুন্দর বাংলা বলেন। লেখেনও ভালো।

শিভাই প্রসঙ্গে একটা মজার ঘটনা বলি। আমি তখন সদ্য কাজে যোগ দিয়েছি। একদিন অফিসে একটা রেকর্ডকৃত অনুষ্ঠান বাজছে। অর্থনীতি বা রাজনীতি বিষয়ক কোনো অনুষ্ঠান। এক ভদ্রলোক অত্যন্ত সুললিত ভাষায় কথিকা পাঠ করছেন। আমি ভাবলাম, এটি বাঙালি কোনো সহকর্মীর কণ্ঠ। কিন্তু কার কণ্ঠ বুঝতে পারলাম না। শিহাবকে জিজ্ঞাসা করতেই ও হেসে বললো আরে এটা তো আমাদের শি সাহেবের কণ্ঠ। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে শিভাই কি চমৎকার বাংলা বলতে পারেন।

চুং শাও লিন অরেকজন প্রবীণ কর্মী। তিনিও বাংলায় দক্ষ। বলা এবং লেখা দুটোতেই। চুং আপাও একসময় এই বিভাগের ডিরেক্টর ছিলেন। চুং আপার সঙ্গে আমার বেশ বন্ধুত্ব হয়েছিল। ভারি ভালো লাগতো আমার এই সুন্দরী প্রবীণ ভদ্রমহিলাকে। এরা সবাই ছিলেন রিটায়ার্ড। তবে চুক্তি ভিত্তিতে কাজ করতেন।

বাংলা বিভাগের ডিরেক্টর ইয়ু কুয়াং ইউয়ে। তার বাংলা নাম আনন্দী। সুন্দরী মহিলা। বয়স আমার মতোই। বাংলা ভালো বলেন। লেখেনও মন্দ নয়। তবে মাঝে মধ্যে একটু বেখাপ্পা শব্দ ব্যবহার করে ফেলেন। ব্যবহার তার খুবই ভালো। আমাকে একাধিকবার লাঞ্চ ও ডিনার খাইয়েছেন। না, শুধু সেজন্যই তাকে ভালো বলে সার্টিফিকেট দিচ্ছি না। তিনি এমনিতেও ভালো। চীন গিয়ে জানতে পারলাম তিনি আমার পূর্বপরিচিত। যখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউটে জার্মান ও রুশ ভাষা শিখছিলাম, সে সময় তিনি বাংলা ভাষার ছাত্রী ছিলেন। আমরা দুজন একসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের ১৪০০ সাল কবিতা আবৃত্তি করেছিলাম ১৯৯৩ সালে বাংলা ১৪০০ সনের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে।

ডেপুটি ডিরেক্টরের নাম চিয়াং চিনশেং। তিনি এমনিতে ভালো মানুষ। তবে কিছুটা একগুঁয়ে। একবার কিছু মাথায় ঢুকলে বা কারও সম্পর্কে বিরূপ ধারণা হলে তাকে সেখান থেকে টলানো যায় না। আমি চলে আসার পরের বছর চিয়াং ভাই অবসরে চলে যান।

নতুন যে ছেলেমেয়েরা বাংলা বিভাগে কাজ করছেন তাদের প্রত্যেকেরই একটি করে বাংলা নাম রয়েছে। একজন চীনা শিশুর দুটি নাম থাকে। একটি চীনা ভাষায়, অন্যটি ইংরেজিতে। যাতে বিদেশিরা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে তাদের সঙ্গে আলাপে। আর সি আর আইয়ের বিভিন্ন বিভাগে যারা কাজ করেন তাদের তিনটি করে নাম। চীনা, ইংরেজি এবং যে যে ভাষায় কাজ করছেন সে ভাষার নাম। বাংলা বিভাগে কাজ করেন স্বর্ণা (ইয়াং উইমিং), সুবর্ণা (ছাও ইয়ান হুয়া), মুক্তা (ছাই ইউয়ে), উর্মি(ওয়াং হাইমেন), শিখা (শুয়েই ফেইফেই), প্রেমা(খোং চিয়া চিয়া), লাবণ্য (লিলি), রুবি (ওয়াং তান), শিশির (লি ওয়ান লু), জিনিয়া(ওয়াং ছুই ইয়াং), আকাশ(শিয়েনান), প্রকাশ (মুং ফেন শিং) ও লতা (লিয়াং লিয়াং)। লতা কিন্তু কোনো মেয়ের নাম নয়। লতা ছেলে। কেন একজন জলজ্যান্ত পুরুষের নাম লতা তা আমার বোধগম্য নয়।

 


  মিষ্টি মেয়ে জিনিয়া, স্বর্ণা ও আমি

আমি যখন কাজে যোগ দেই তখন স্বর্ণা বাংলাদেশে ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি বিভাগের কাজে যোগ দেন। স্বর্ণার সঙ্গে আমার সবচেয়ে বেশি বন্ধুত্ব হয়েছিল। অসাধারণ এক মেয়ে। বয়স ত্রিশের কোঠায়। তখন অবিবাহিত ছিলেন। তিনি পরে এক বাঙালি ছেলেকে বিয়ে করেন। বেশ সুন্দর দেখতে। স্বর্ণাকে আমার মনে হতো অর্ধেক বাঙালি। চমৎকার বাংলা বলতো। রবীন্দ্রসংগীত গাইতে পারতো। সবচেয়ে বড় কথা বাংলা রসিকতাও বুঝতো। এমনিতে চীনাদের রসবোধ কিছুটা কম। কিন্তু স্বর্ণা আশ্চর্য ব্যতিক্রম। স্বর্ণার কথা বলে শেষ হবে না। কোমল স্বভাবের মেধাবী সুন্দরী ইত্যাদি অনেক বিশেষণে তাকে ভূষিত করা চলে।

আকাশের বয়স স্বর্ণার মতোই। যথেষ্ট ভালো মানুষ। আমাকে অনেক সাহায্য-সহযোগিতা করেছিল। অবশ্য ডিসেম্বর মাসের দিকে আকাশ চলে আসে বাংলাদেশে। পরবর্তীতে আকাশের সঙ্গে আমার দেখা হয় বাংলাদেশে যখন আমি কিছুদিন চীনাভাষা শেখার চেষ্টা করি।

প্রকাশও খুব ভালো ছেলে। তেইশ চব্বিশ বছর বয়স। বাংলা ভালো বলতো কিন্তু লেখায় তেমন ভালো ছিল না। পরে অবশ্য সে ভালো লিখতে শেখে। প্রকাশের সঙ্গেও আমার বেশ বন্ধুত্ব ছিল। প্রকাশের সঙ্গে আমি দুটি অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতাম।

লিয়াং ভালো গান করতো। কিছুটা সরল প্রকৃতির ছেলে। একটু লাজুকও। সুবর্ণা দারুণ সুন্দরী। ‘চলুন বেড়িয়ে আাসি’ নামে একটি অনুষ্ঠান আমরা একসঙ্গে করতাম। এই অনুষ্ঠানের সুবাদে অনেক জায়গায় একসঙ্গে বেড়িয়েছি আমরা। মুক্তা এবং লাবণ্যর সঙ্গেও আমি দুটি অনুষ্ঠান করতাম। তাদের সঙ্গেও আমার বেশ ভালো বন্ধুত্ব ছিল। রুবি এবং শিখাও বেশ ভালো বাংলা লিখতেন ও বলতেন। বলতে গেলে বিভাগের প্রত্যেকের সাথেই আমার মোটামুটি সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে।

বাঙালি সহকর্মী ছিলেন আবাম ছালাউদ্দিন এবং আমার ঘনিষ্ট বন্ধু শিহাবুর রহমান। বাংলা বিভাগের কোনো অনুষ্ঠান হলে আমরা সবাই একসাথে যেতাম। হয়তো কোনো অতিথিকে ডিনার খাওয়ানো হবে কিংবা একসাথে সিনেমা দেখা হবে। বাংলাদেশের দূতাবাসের কোনো অনুষ্ঠান হলেও আমরা একসাথে যেতাম। ডিরেক্টর ইয়ু কুয়াং ইউয়ের বাড়িতে একবার একটি চমৎকার অনুষ্ঠান হয়েছিল। শাড়ি পরা অনুষ্ঠান। দারুণ মজার। সেটা ছিল কিটি পার্টি মানে শুধু মেয়েদের অনুষ্ঠান। ওই দিনের জন্য ডিরেক্টর তার শিশু পুত্র এবং যুবক স্বামীকে বাড়ির বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আমার সংগ্রহে প্রায় বারো তেরোটি শাড়ি ছিল। ডিরেক্টরের নিজেরও শাড়ি ছিল। সব মিলিয়ে সবাই মিলে শাড়ি পরে বাঙালি সাজা হলো। শুধু শাড়ি না, সেই সঙ্গে টিপ, কাজল, লিপস্টিক, চুড়ি, বালা সবই পরা হলো।

শাড়ি পরা উৎসবে আরও উপস্তিত ছিলেন লিউ আপা। লিউ আপা চমৎকার নারী। তিনি আগে বাংলা বিভাগের কর্মী ছিলেন। তার স্বামী বিখ্যাত মানুষ। তিনি বাংলা বিভাগের পরিচালক ছিলেন। তিনি বাংলা ভাষা শিক্ষা বিষয়ে বই লিখেছেন। চীনে বাংলা ভাষা চর্চার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুণী একজন মানুষ ছিলেন তিনি। এক সড়ক দুর্ঘটনায় লিউ আপা তার স্বামী ও নাতিকে হারান। তার ছেলেও গুরুতর আহত হয় সেই ঘটনায়।

 


চীন যোগাযোগ বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই সহকর্মী বৃষ্টি ও সুস্মিতার সঙ্গে

 

লিউ আপার মা ছিলেন নেপালি। তাই তার চেহারায় দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের কিছুটা ছাপ রয়েছে। তিনি অনেকদিন কলকাতা ছিলেন। তাই জলের মতো বাংলা বলেন। এমনকি তার বাংলা শুনে অনেক সময় বোঝাই যায় না তিনি বাংলাভাষী নন। সেদিন লিউ আপা আমাদের সাথে অনেক গল্প করলেন। তিনি এখন অবসরে আছেন। তবে বাংলা বিভাগের সাথে তার যোগাযোগ রয়েছে। প্রায় প্রতিটি অনুষ্ঠানেই তিনি আসেন। আরেকজন ছিলেন ফুং আপা। তিনিও অবসরে আছেন। ভালো বাংলা বলেন। মানুষও ভালো। সেদিন আরও ছিল চীন যোগাযোগ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের শিক্ষক সুস্মিতা। ওর চীনা নামটি ভুলে গেছি। সুস্মিতা ভালো নাচ জানেন। বিশেষ করে বলিউডের নাচ। সেই নাচ তিনি অনেক অনুষ্ঠানে দেখান। সেদিন আমরাও দেখলাম। এককথায় দারুণ। সেদিন আমরা নানা রকম বাংলা রান্না করলাম। মানে যে যা পারি। সব মিলিয়ে খুবই মজা হয়েছিল।

শাড়ি পরে সবাইকেই মনে হচ্ছিল অপরূপা সুন্দরী। বাংলা বিভাগের সকলের সাথেই আমার বেশ বন্ধুত্ব ছিল। চীন যোগাযোগ বিশ্ববিদ্যালয় মানে যেখানে আমি বাংলা পড়াতাম সেখানকার শিক্ষক বৃষ্টির কথাও খুব মনে পড়ে। তার সঙ্গে আমার বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়েছিল। এখনও তার সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে। আমার ছাত্রছাত্রীদের কথা খুব মনে পড়ে। তাদের মধ্যে আসাদ চাও-এর সঙ্গে এখনও কিছুটা যোগাযোগ আছে। আমি যে এলাকায় থাকতাম সেখানকার ফলওয়ালা, দোকানীসহ অনেকের সঙ্গে ভালো বন্ধুত্ব ছিল। এদের কথাও মনে পড়ে।

চীনে আমি টানা একটি বছর কাটিয়েছি। এরপর আরও বেশ কয়েকবার মাসখানেক করে গিয়ে থেকেছি। আমার কাছে চীন অসাধারণ সুন্দর এবং প্রিয় একটি দেশ। বিশাল এই দেশটির খুব কম জায়গাতেই যাবার সুযোগ হয়েছে। তবে যেটুকু দেখেছি মুগ্ধ হয়েছি প্রকৃতির সৌন্দর্যে ও মানুষের সৌহার্দ্য। চীনের সাধারণ মানুষ খুবই অতিথি বৎসল ও বন্ধুসুলভ।আমি যেখানেই গিয়েছি ভালো মানুষের দেখা পেয়েছি। চকবাজার থেকে চীন পর্যন্ত আমার ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতায় বলতে পারি ভালো মানুষ সর্বত্রই আছে এবং তাদের সংখ্যাই বেশি। আমার চীনা বন্ধুদের সকলের প্রতি এই ধারাবাহিক রচনার মাধ্যমে জানাই ভালোবাসা। এবার একুশে গ্রন্থমেলায় এই ভ্রমণ ধারাবাহিক গ্রন্থ আকারে প্রকাশিত হচ্ছে। বিশ্ব ছোট হয়ে আসছে, আর বই তো কখনও দূরে যেতে ভয় পায় না। তাই কখনও যদি আামার কোনো চীনা বন্ধুর কাছে বইটি পৌঁছে যায় তাহলে তাকে বলছি, তোমার স্মৃতির ফোল্ডারে আমার জন্যও রেখ অল্প একটু স্থান। মনে রেখ বন্ধু, যেমন আমি মনে রেখেছি তোমাদের। আবার দেখা হবে, চাই চিয়েন। (সমাপ্ত)




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ জানুয়ারি ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়