ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

চেতনায় হাবিপ্রবির মুক্তিযুদ্ধ কর্নার

প্রকাশিত: ১১:৪৩, ৫ এপ্রিল ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
চেতনায় হাবিপ্রবির মুক্তিযুদ্ধ কর্নার

হাবিপ্রবির মুক্তিযুদ্ধ কর্নারে শিক্ষার্থীরা

মো. মোস্তাফিজুর রহমান রুবেল : নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ইতিহাস বাংলাদেশের। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পার হয়েছে। এখনকার ছাত্র-ছাত্রী, যুব সমাজ এই মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি। এখন তাদের অনেকে নানা-নানি, মুরব্বিদের কাছে শোনে মুক্তিযুদ্ধের গল্প।

এর পরের প্রজন্ম হয়তো চাক্ষুস দেখা মানুষের কাছে থেকে এমন লোমহর্ষক ইতিহাস শুনতে পাবে না। তাদের জন্য ব্যবস্থা হচ্ছে বই, বই পড়ে ইতিহাস জানা, সেই ইতিহাস হৃদয়ে ধারণ করে দেশপ্রেমিক মানুষ হওয়া। এই মহান উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে সৃষ্টি হয়েছে হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযুদ্ধ কর্নার।

নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত রাখার প্রয়াসে তৈরি হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ কর্নার। মনোরম পরিবেশে হাজারো বইয়ের সংগ্রহ নিয়ে গড়ে উঠেছে এই কর্নার।

স্বাধীনতা আমাদের গর্ব। এই গর্বকে জ্ঞানে পরিণত করার প্রয়াসে মুক্তিযুদ্ধ কর্নার তৈরির পরিকল্পনা করেন হাবিপ্রবির প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক রুহুল আমিন। ক্যাম্পাসের নিজস্ব অর্থায়নে লাইব্রেরির দক্ষিণ-পশ্চিম কোনের তিন তলায় এর অবস্থান।

স্থাপত্যবিদ্যা বিভাগের শিক্ষকরা সম্মিলিত প্রয়াসে এই কর্নারের নকশা করেন। শিক্ষকদের মধ্যে অন্যতম প্রভাষক আবু তোয়াব মোহাম্মদ শাহরিয়ার ও  প্রভাষক সাজদিক আহমেদ। তারা বলেন,  মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শিক্ষার্থীদের উজ্জীবিত রাখার চিন্তা মাথায় রেখে এর ডিজাইন করা হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধ কর্নারের ডিজাইনের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হলো - এখানে দুটি কক্ষে দুটি জোন করা হয়েছে। একটিতে কালো এলাকা, যা তখনকার অবস্থা, আরেকটি উজ্জ্বল করে রাখা হয়েছে সেই সময়ের দেশপ্রেমী মানুষদের।  মানচিত্রের ওপর তিনটি রঙ ব্যবহার করা হয়েছে, যা তখনকার পতাকাকে বোঝায়- লাল, সবুজ, হলুদ। ছয় ঋতুর দেশকে দেখানো হয়েছে প্রথম ঘরে। বইয়ের তাকগুলো আকর্যনীয় রঙে সাজানো হয়েছে। চিরাচরিত নিয়মের বাইরে মানুষকে আকর্ষণ করবে এগুলো। তাকগুলোয় প্রায় ১০ হাজার বই রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

ছাদের পুরোটা কালো রাখা হয়েছে, যেন এই অল্প জায়গায় তার অস্তিত্ব শেষ হয়ে না যায়। বাস্তবে লাইট বন্ধ রাখলে ইচ্ছামতো বাড়ানো সম্ভব চেতনা দিয়ে। মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত সাদা-কালোর একটা দারুণ সমন্বয় করে সাজানো হয়েছে। ডিজাইন সম্পর্কে এ তথ্য জানালেন প্রভাষক আবু তোয়াব মোহাম্মদ শাহরিয়ার।

২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে পররাষ্ট্র মন্ত্রী মোহাম্মদ আবুল হোসেনে মুক্তিযুদ্ধ কর্নারের শুভ উদ্বোধন  করার পর ব্যাপক সাড়া পড়েছে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে। মুক্তিযুদ্ধ না দেখা শিক্ষার্থীদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জারি রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখবে এটি- জানালেন বেশ কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী।

কর্নারে প্রবেশ করে প্রথমে দেখতে পাবেন  কাঠের উপর বাংলাদেশের মানচিত্র, নিচে  নীল আলো। উপরে সাত বীরশ্রেষ্ঠের ছবি, পাশাপাশি তাদের সংক্ষিপ্ত জীবনী, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ছবি এবং জাতীয় চার নেতা তাজউদ্দীন আহমেদ, মোহাম্মদ কামরুজ্জামান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং মো. মনসুর আলীসহ জেনারেল মোহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী- এর ছবি, সেক্টর কমান্ডারদের নাম, যুদ্ধের সময়ের কিছু স্থিরচিত্র দেয়ালে লাগানো আছে।  পাশের সাতটা তাক মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য রাখা আছে।  সবুজ,  হলুদ ও লাল রঙের মানচিত্র আছে অফিসের দেয়ালে।  দ্বিতীয় কক্ষে প্রবেশ করলে ডান দিকে চোখে পড়বে চারটা বড় বড় আলমারিতে বই সাজানো আছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের রচনাবলি তিনটিতে এবং একটিতে মুক্তিযুদ্ধের ওপর বিদেশিদের রচনাবলি। দুই আলমিরার পাশে ১০টা তাক স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য। চারটা টেবিলের সঙ্গে ১৮টা চেয়ার রাখা আছে।

 



হাজী মোহাম্মদ দানেশ কৃষি কলেজ থাকাকালীন লাইব্রেরির মুক্তিযুদ্ধের সব বইপত্র এবং বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পরে সংগৃহীত এবং সরকার কতৃক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের ১০ খণ্ড বই রাখা হয়ছে এই কর্ণারে। পরে দিনাজপুর,  ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গার লাইব্রেরিতে খোঁজ নিয়ে বই সংগ্রহের গল্প শোনাচ্ছিলেন গ্রন্থাগারিক মো. আলাউদ্দিন। তিনবার কমিঠি করে বই কেনা হয়েছে। বাজারে আর পাওয়া যায় না- এমন বইয়ের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধে দিনাজপুর বইটি ১৫০০ টাকা দিয়ে কিনতে হয়েছে। বিদেশি লেখকদের বইগুলো ঢাকার অভিজাত লাইব্রেরি থেকে কেনা হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য বই হলো- ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের উপর ব্যাপক গভেষণাধর্মী বই রিচার্ড সিসন ও লিও রোজ এর  'War and secession, Pakistan, india and the creation of Bangladesh' (১৯৯০), অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস- এর বাংলাদেশের রক্ত ঋণ, বাংলাদেশ : এ লিগাসি অব ব্লাড (১৯৮৬)।

বিতর্কিত বই ছাড়া ইতিহাসের সব দুর্লভ বই সংগ্রহে রাখা হয়েছে। ইতিমধ্যে প্রায় ৪০০ শিরোনামের ৩০০ জনের  বেশি দেশি-বিদেশি লেখকের বই শোভা পাচ্ছে কর্নারের তাকগুলোতে।

ভেটেরিনারি অ্যান্ড এনিমেল সায়েন্স অনুষদের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র মো. মুশতাক ওয়াদুদ এলিস বলেন, এটি উত্তরবঙ্গের বৃহত্তম মুক্তিযুক্তভিত্তিক সংগ্রহশালা। এখানে এসে অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়ে আমি বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবনের দূরদর্শিতা সম্পর্কে জানতে পেরেছি।

ভেটেরিনারি অ্যান্ড এনিমেল সায়েন্স অনুষদের লেভেল ৫ সেমিস্টার-২-এর  আরেক ছাত্র মুনিরুজ্জামান বলেন, এটা আসলে একটা যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এক জায়গায় বসে গোটা পৃথিবীর মুক্তিপাগল মানুষদের জানা যায়। আমরা জানতে পারি আমাদের সংগ্রামী নেতাদের সংগ্রামী জীবনের ইতিহাস। এখানে থাকা মুক্তিযুদ্ধ অ্যালবামে যুদ্ধ চলাকালীন নির্মমতার কথা ছবিতে  দেখতে পাই।  এতে করে দেশের প্রতি ভালোবাসা ও দেশের জন্য আত্মত্যাগের অনুপ্রেরণা পাওয়া যায়। আমি মনে করি, দেশের স্বার্থে,  নতুন প্রজন্মের স্বার্থে আমাদের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল কলেজে সরকারি বেসরকারি গ্রন্থাগারের পাশে এ রকম মুক্তিযুদ্ধ কর্নার থাকা উচিত।

বই পড়ার সুন্দর ব্যস্থাপনা। নাম ঠিকানা ইস্যু করার পর শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কর্নারে বসে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত যে কেউ বই পড়তে পারবেন। পড়াশেষে  মন্তব্য দেওয়ারও সুযোগ রয়েছে।  বই পড়ে যাওয়ার পথে অসাধারণ মন্তব্য করলেন বিবিএ শেষ বর্ষের ছাত্র তারিকুল ইসলাম। প্রবেশ পথের ঘরে মনোমুদ্ধকর পরিবেশে সাজানো আছে দেশের মানচিত্র। মৃদূ আলোতে যেন সারা দেশকে এক নজরেই দেখছেন।

সবচেয়ে বেশি পঠিত বইয়ের মধ্যে  বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী, বাংলাদেশের মানচিত্র, দিনাজপুরের ইতিহাস, এবং হাবিপ্রবির মুক্তিযোদ্ধা প্রফেসর ডা. ফজলুল হকের লেখা ইতিহাস কথা বলে, পূর্বাপার ৭১, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র,  ১৯৭১ অপারেশন সার্চলাইট -সাঈদ হাসান, লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে -রফিকুল ইসলাম, বালকের চোখে দেখা একাত্তর -আব্দুল হাসিব, ছবি কথা বলে- প্রফেসর ড: আনন্দ কুমার শাহা, শেখ মজিব আমার পিতা- শেখ হাসিনা, একাত্তরের গেরিলা- জহিরুল ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধের গল্প- মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান, একাত্তরের চিঠি- প্রথমা প্রকাশনী, একাত্তরের ডায়রী- সুফিয়া কামাল, মুক্তিযুদ্ধ কোষ - মুনতাসির মামুন এবং একাত্তরের বীরযোদ্ধাদের অবিস্মরণীয় জীবন গাথা খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা স্মারকগ্রন্থ অন্যতম।

 



জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবনী পড়ার জন্য সবাই ছুটে আসে এখানে। স্বাধীনতার স্থাপতি দেশকে কীভাবে স্বাধীন করছেন তার ইতিহাস জানতে কর্নারে এসেছেন ডিভিএম শেষ বর্ষের ছাত্র মামুন। তিনি বলেন, সচেতন নাগরিক হিসেবে আমি ইতিহাস জানার জন্য এসেছি এখানে। বঙ্গবন্ধুর বংশপরিচয় সুন্দরভাবে বর্ণনা করা আছে হাবিপ্রবির ভেটেরিনারি অ্যান্ড এনিমেল সায়েন্স অনুষদের মেডিসিন, সার্জারি ও অবস্ট্রেটিকস বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. ফজলুল হকের ‘ইতিহাস কথা বলে, পূর্বাপর ৭১’ বইতে।

ছাত্রীদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বই পড়ার আগ্রহ চোখে পড়ার মতো। কর্নারে তাদের ভিড় থাকে বেশি।

ভেটেরিনারি অ্যান্ড এনিমেল সায়েন্স অনুষদের লেভেল ৫ সেমিস্টার-১-এর  ছাত্রী আরাফাত জাহান রিংকি বলেন, আমি এখানে এসে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিস্তারিত জেনেছি। যা আগে এত ভালো করে জানার সুযোগ হয়নি। বিশেষ করে সেই সময়ের বর্বরতার ছবিগুলো দেখে আমার চোখে পানি চলে আসে।

উদ্দেশ্য সফল হচ্ছে, উল্লেখ করে হাবিপ্রবির গ্রন্থাগারিক মো. আলাউদ্দিন বলেন, আমরা আশানুরূপ সাড়া পাচ্ছি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীর ইতিহাস জানার আগ্রহ দেখে আমরা উদ্বুদ্ধ হচ্ছি। বইয়ের সংখ্যা বাড়ানোসহ মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহার্য স্মৃতিবিজড়িত জিনিসপত্র সংগ্রহ করার চেষ্টা চলছে। দিনাজপুর ও অনান্য এলাকার প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের মুক্তিযুদ্ধকালীন ব্যবহার্য দুর্লভ বস্তু কেউ দিলে আমরা তা সানন্দে গ্রহণ করব। ক্যাম্পাসের বাইরের কোনো পাঠক, গবেষক এখানে আসতে পারেন, কর্তৃপক্ষ  তাদের সহায়তা করবে।

হাবিপ্রবির মুক্তিযুদ্ধ কর্নারের পরিকল্পনাকারী ও  প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক  মো. রুহুল আমিন বলেন, মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গৌরব, এই গর্বের জায়গাটাকে ধরে রাখতে হবে। ছাত্র-ছাত্রীদের ইতিহাস জানানোর তাগিদ থেকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এই কর্নার।

হাবিপ্রবির উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম. আবুল কাসেম বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানলে আমরা স্বাধীনতার পক্ষে দেশপ্রেমিক হতে পারব। জ্ঞান বিকাশে অন্যতম ভূমিকা রাখবে এটি। দক্ষতা আর দেশপ্রেম নিয়ে কাজ করলেই দেশ এগিয়ে যাবে। ভবিষ্যতে অন্যান্য দেশের মুক্তিযুদ্ধের বইও সংগ্রহে রাখা হবে।





রাইজিংবিডি/ঢাকা/৫ এপ্রিল ২০১৭/রুবেল/রাসেল পারভেজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়