ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

চোখ জুড়ানো কার্টেইন ক্রিপার

শাহনেওয়াজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:২৭, ১৪ জানুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
চোখ জুড়ানো কার্টেইন ক্রিপার

রাজধানীর মতিঝিলে দৈনিক বাংলার মোড় সংলগ্ন বিএসসি টাওয়ারের সামনে কার্টেইন ক্রিপার (ছবি: খান মো. শাহনেওয়াজ)

খান মো. শাহনেওয়াজ : বাংলাদেশে নান্দনিক স্থাপত্যশৈলীর বহুতল ভবন গড়ে ওঠার সাথে সাথে ভবনকে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য সৌন্দর্যবর্ধক গাছের চাহিদাও বাড়ছে। এ ধরনের গাছের মধ্যে সৌন্দর্যবর্ধক উদ্ভিদ, লতা এমনকি তৃণও রয়েছে। এর মধ্যে বর্তমানে বৃক্ষপ্রেমীদের প্রথম পছন্দ কার্টেইন ক্রিপার নামের লতা গাছ।

১৯৬০ এর দশকে রাজধানী ঢাকা বা অন্য নগরী ও শহরগুলোতে শৌখিন মানুষদের বাড়িতে বিশেষ করে দালান বাড়িতে স্থান পেতে শুরু করে বাগান বিলাস (bougainvillea) ফুল গাছ। এটি কাগজি ফুল ও গেট ফুল নামেও পরিচিত। ১৯৮০ এর দশকে এসে এই ফুল ঘরে ঘরে পৌঁছে যায়। মফস্বল শহর, উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ে পর্যন্ত ধনী ও সম্পন্ন ব্যক্তিদের বাড়িতে আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে যায় এই ফুল। রাজধানীর আবাসিক এলাকায় প্রায় প্রতিটি বাসায় বাগান বিলাস ফুল গাছের দেখা মেলে।

এরপর ১৯৯০ এর দশকের শুরুর দিকে রাজধানীর অভিজাত পাড়া ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী ও বারিধারায় অনেক সুদৃশ্য বাড়ির সীমানাপ্রাচীর বা ভবনের দেয়ালে দেখা মেলে মোড়ক লতা। ডুমুর লতা (fig ivy) বা লতাবট নামের এই গাছ দেয়াল আঁকড়ে বেয়ে বেয়ে অনেক ওপরে উঠে যায় এবং সারা দেয়ালে ছেয়ে যায়। দেখে মনে হয় সবুজ ঘাসে তৈরি দেয়াল। লতাবট দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে বাসায় বাসায়। কিন্তু ১৯৯০ এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে এর জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ে। বিশেষ করে বর্ষায় কেঁচো, পিঁপড়া আর পোকামাকড় এই গাছ বেয়ে উঠে ঘরের ভেতরে ঢুকে যায। পোকামাকড়ের উৎপাতের কারণেই মূলত শৌখিন ব্যক্তিরা লতাবটের প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেন। ৯০ এর দশকের শেষ দিকে এসে ঢাকায় লতাবট গাছ বলতে গেলে অদৃশ্য হয়ে যায়। বর্তমানে রংপুর মহানগরীর জেল রোডে বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) রুরাল ডেভেলপমেন্ট সংস্থার (আরডিএস) আঞ্চলিক কার্যালয় ভবনটি লতাবট দিয়ে সম্পূর্ণ ছেয়ে আছে।

২০০০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে এসে ভবনের শোভা বাড়ানোর জন্য যুক্ত হয় কার্টেইন ক্রিপার নামের লতা। যথারীতি রাজধানীর অভিজাত পাড়ায় বাসভবনগুলোর সীমানাদেয়ালে স্থান পেয়ে যায় কার্টেইন ক্রিপার। গাঢ় সবুজ এই লতা গাছের ডগা আনত হয়ে সমান্তরালে ঝুলে থাকে। ঝুল ডগার সমারোহ নজর কেড়ে নেয়। স্থপতিরা ভবনের সামনে উদ্ভিদসজ্জার (Yard plantation) পরিকল্পনায় কার্টেইন ক্রিপার লতাকে মানসে রেখে ভবনের নকশা তৈরি করেন।

রাজধানী মহানগরীর উল্লেখযোগ্য স্থাপনার মধ্যে শাহবাগে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালের বর্ধিত ভবনের সীমানা দেয়ালে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন কার্টেইন ক্রিপার। মতিঝিলে দৈনিক বাংলার মোড়সংলগ্ন ২-৩ রাজউক এভিনিউয়ে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) ভবন বিএসসি টাওয়ারের সামনে শোভা পাচ্ছে এই গাছ। দেশের প্রায় সব জায়গায় বৃক্ষপ্রেমীদের বাড়ির সীমানাদেয়ালে, বারান্দায় বা ছাদের বাগানে রয়েছে এই লতা।

কার্টেইন ক্রিপার পরাশ্রয়ী এবং অবলম্বন ছাড়া খাড়াভাবে উঠতে পারে না। ফলে অবলম্বন ছাড়া বড় হওয়ার সাথে সাথে এই লতা ঝুলে পড়ে এবং বহু লতার সমাহারে অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন হয়ে উঠে। ভারনোনিয়া (Vernonia) গণের এই গাছ সূর্যমুখী (Sunflower) পরিবারভুক্ত। এর বৈজ্ঞানিক নাম বা বোটানিক্যাল নাম ভারনোনিয়া এলায়াগনিফোলিয়া (Vernonia Elaeagnifolia)। আদি নিবাস ভারত, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড। এটি অস্ট্রেলিয়া ও তাইওয়ানেও পাওয়া যায়। কার্টেইন ক্রিপার নাম ছাড়াও এটি ভারনোনিয়া ক্রিপার ও পারদা বেল নামে পরিচিত। ফেব্রুয়ারি-মার্চে এতে ফুল ফোটে।

মূলত ভবন ও বাগানের শোভা বাড়াতে দেয়ালে ও সীমানাপ্রাচীরে লাগানোর জন্য এই লতা সমাদৃত। ভারতের খ্যাতনামা উদ্যানবিদ, মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সট্রামিউরাল সেকশনের ফ্যাকাল্টি মেম্বার নন্দন কালবাগের ভাষায়, কার্টেইন ক্রিপার গাছের সীমানা আবরণ বা উপস্থিতি ছাড়া নার্সারি কিংবা উদ্যান পূর্ণতা পায় না।

ভারতে এই গাছের জনপ্রিয়তা এতটাই বেশি যে, রীতিমতো এর চাষ হয়। বাংলাদেশেও এটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তবে দেখা গেছে, এই লতার সঠিক নাম বেশির ভাগেরই অজানা। অনেকেই এর পরিচয় দেন ইরানি লতা। কেউ কেউ বলেন কুমারী লতা, কামাক্ষ্যা লতা এমনকি গারো লতা। নার্সারিতে এটি ইরানি লতা নামেই বিক্রি হয়।  রাজধানীর আদাবরে বায়তুল আমান হাউজিং সোসাইটির বাসিন্দা ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আব্বাস মাহমুদ তার বাসভবনের ছাদের কার্নিশে দিয়েছেন কার্টেইন ক্রিপার। তিনি বলেন, ‘এই লতা বিশাল সবুজের সমারোহ ঘটায়। ভোরবেলা ছাদে এলে এই সবুজ চোখ জুড়িয়ে দেয়।’ তিনি খুলনা থেকে এই লতা সংগ্রহ করেছেন বলে জানান। 

ফেসবুকে বৃক্ষপ্রেমীদের গ্রুপ ‘সবুজ বাগান সোসাইটির’ সদস্য গৃহবধূ ফারজানা ইসলাম মুনিয়া জানান, তিনি দুই বছর আগে এই গাছের সঙ্গে পরিচিত হন নক্ষত্রবাড়ি অবকাশ কেন্দ্রে। অভিনয়শিল্পী, স্থপতি তৌকীর আহমেদ ও অভিনয়শিল্পী, চিত্রলিশ্পী বিপাশা হায়াত দম্পতির মালিকানায় পরিচালিত এই রিসোর্টে তিনি অবকাশে গিয়েছিলেন। গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলায় রাজাবাড়ি বাজার ইউনিয়নের চায়নাসুখানিয়া গ্রামে অবস্থিত রিসোর্টে ঘরের সিঁড়িমুখে ও দেয়ালে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন কার্টেইন ক্রিপার। রাজধানীর বাসাবো এলাকার বাসিন্দা ফারজানা ইসলাম মুনিয়া বলেন, ‘বিশাল বাগানের এক পাশের দেয়ালে এটি ঝুলে থাকলে দারুণ লাগে দেখতে।’ তিনি জানান, এই গাছ তার অত্যন্ত প্রিয়।

পোলট্রি ব্যবসায়ী গাজীপুর মহানগরীর ছায়াবীথি আবাসিক এলাকার বাসিন্দা মো. হাফিজ উদ্দিন তার বাসভবনে রেখেছেন কার্টেইন ক্রিপার। তিনি জানান, পাঁচ বছর আগে এই গাছ রাজধানীর উত্তরার একটি বাসার সীমানাপ্রাচীরের বাইরে থেকে সংগ্রহ করেছেন। দুটি ডাঁটা এনে মাটিতে রোপণ করেছিলেন। একটি বেঁচে গেছে। সেটাই এখন ঝোপ বেঁধেছে। এই গাছটি তিনি যখন সংগ্রহ করেন তখন নাম জানতেন না। পরে নাম জানার চেষ্টা করে জেনেছেন ‘ইরানি লতা’ এবং এতদিন এই নামই জানতেন। এর আসল নাম জেনে তিনি অত্যন্ত খুশি হন এবং বলেন, ‘আমাদের নিজেদের এবং ছেলেমেয়েদের প্রতিনিয়ত গাছের সাথে পরিচিত হওয়া উচিত। এই লতা আমার আঙিনাকে সবুজে ঢেকে দিয়েছে।’ 

জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার দুরমুঠ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও কলাবাধা বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সৈয়দ খালেকুজ্জামান তার বাড়িতে লাগিয়েছেন কার্টেইন ক্রিপার। তিনি বলেন, ‘এই গাছটি দেয়ালের সাথে ঝুলে থাকে, দেখতে অনেক সুন্দর দেখায়। একেবারে চোখ জুড়ানো।’

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ জানুয়ারি ২০১৭/শাহনেওয়াজ/এএন

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়