ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

উপকূলের পথে

ছকিনা বিবির ভাঙা ঘর, ভাঙা কপাল

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৪০, ১৯ জুন ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ছকিনা বিবির ভাঙা ঘর, ভাঙা কপাল

রফিকুল ইসলাম মন্টু: ছকিনা বিবির কপাল ভাঙলো বিনা কারণে। তবে তার একমাত্র কন্যা রেশমা বেগমকে স্বামীর নির্যাতন সইতে হচ্ছে জোড়া গাভীর দাবিতে। যৌতুক হিসেবে জোড়া গাভী দাবি করেছিলেন জামাই মনির হোসেন। অন্যদিকে ছকিনার মেঝ বোন ছবুরা বিবিকে ৪ মেয়েসহ ফেলে যায় তার স্বামী আবদুস ছত্তার। ছোট বোন হাজেরা বিবি দ্বিতীয় বউ হয়ে বয়সী এক স্বামীর ঘরে গিয়ে বিপাকে আছেন। তার প্রথম স্ত্রীর ৫ সন্তান আর নিজের ২ সন্তান সামলাতে তারও গঞ্জনার শেষ নেই।

উপকূলের পথে কান পেতে শুনি হাজারো গল্প। এক একটি মানুষের জীবন মানেই এক একটি বিরাট গল্প; কখনো কখনো উপন্যাস। কিন্তু একই পরিবারের এত দুঃসংবাদের ঘটনা ততটা পাওয়া যায় না। ভোলার চরফ্যাসনের কুকরি মুকরি ইউনিয়নের চর পাতিলার ছকিনা বিবি, তার বোন এবং কন্যার এই গল্পগুলো এলাকার প্রায় সকলেই জানেন। চর পাতিলার পথে কষ্টে থাকা মানুষদের খুঁজি। সন্ধান পাই ছকিনার। সূর্যটা তখনো মাথার ওপরে আসেনি। দ্বীপের কিছু মানুষ বাইরের কাজে ব্যস্ত। বর্ষাকাল সামনে রেখে অনেকের হাতে বাড়ির ভিটিতে মাটি ভরাটের কাজ, পুকুর পারে মাটি দেয়ার কাজ, ঘর তৈরির কাজ, ঘর মেরামতের কাজ। এসব কাজে নারীরাও অংশ নিচ্ছেন। তবে ছকিনা বিবি ঘরের কাজেই ব্যস্ত ছিলেন। রাস্তার পাশে প্রশস্ত উঠোনের ছোট্ট একটি থাকার ঘর। ঘরের পেছনে ছোট্ট খাল, তারপরে বন। ছকিনা এখন থাকেন তার ছেলে আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে একই ঘরে। ঘরের সামনে মাটির সিঁড়ি পার হয়ে মাথা নিচু করে ঘরে ঢুকি। অচেনা মানুষ, ক্যামেরা- এসব ছকিনা ও তার ছেলেকে কিছুটা অবাক করে। সঙ্গে থাকা স্থানীয় দুই বাসিন্দা থাকায় তাদের শঙ্কা কাটে।

ছকিনা বিবির সঙ্গে কথা বলতে চাই। ‘কেমন আছেন?’- প্রশ্ন করতেই ঘর এবং সামনের বারান্দার মাঝখানে পাতার বেড়ার ফাঁক দিয়ে জবাব দেন- ‘ভালো আছি’। স্বামীর নাম জিজ্ঞেস করতেই বলেন- ‘মারা গেছে’। যেসব নারীদের স্বামী ফেলে চলে যায়, তারা সাধারণত এমন জবাবই দেন। মানে ওই নামটি তারা আর কখনো মুখে আনতে চান না। জবাব শুনে আমি ছকিনা বিবির মুখের দিকে তাকাই। আবার প্রশ্ন করি- ‘না, মারা যায়নি! কী হয়েছে বলুন?’ ছকিনার দীর্ঘশ্বাস পড়ে। বলেন- ‘কথার কী শেষ আছে? কত কথা কমু?’ ছকিনা জানালেন, তার স্বামী শফিউল্লাহ’র প্রথম স্ত্রী ছিলেন তিনি। দিনমজুর স্বামীকে নিয়ে চলছিল সংসার টানাটানির ভেতর দিয়ে। একে একে দুটো সন্তান আসে ছকিনা বিবির ঘরে। একজন আনোয়ার হোসেন, আরেকজন রেশমা বেগম। হঠাৎ ছেলেমেয়ে দু’টো বড় হওয়ার আগেই শফিউল্লাহ’র মনে পরিবর্তন আসে। বিয়ে করে আরেকটি। এ নিয়ে সালিশি বৈঠক বেশ কয়েকবার হয়েছে; কিন্তু ছকিনার ভাঙা কপাল জোড়া লাগাতে পারেনি কেউ। একদিন শফিউল্লাহ চলে যায়; ছকিনা বিষয়টিকে নিয়তি বলেই ধরে নিয়েছেন। স্বামী চলে যাওয়ার পর দুই সন্তান নিয়ে ছকিনার আরেক সংগ্রাম শুরু হয়। নিজে বিভিন্ন ধরণের কাজ করেছেন। ছেলেমেয়েরা একটু বড় হওয়ার পর তাদেরও কাজে পাঠিয়েছে।



নিজের জীবনের গল্পটা বলতে গিয়ে বেশ কয়েকবার চোখ মুছলেন ছকিনা। নিজের জীবনের মতই তার বোন আর মেয়ের জীবনও যেন একই সুতোয় গাঁথা। এই জীবনগুলো কীভাবে একই ছন্দে মিলে গেল; ছকিনা নিজেও ভাবতে পারেন না। একা একা বলতে থাকেন- ‘সব অভাগীরা এক জায়গায় জন্মাইছি। আমাগো সবাইর কপাল মন্দ’। আমি ভাবি, এটা কপালের দোষ নয়, এর সঙ্গে আমাদের সমাজ ব্যবস্থা জড়িত, আমাদের সামাজিক অবক্ষয়ের সঙ্গে এর নিবিড় যোগসূত্র আছে। এই সমাজে শক্তিমানেরা দাপটের সঙ্গে চলে। আর যারা দরিদ্র, একটু দুর্বল; তারা বারবার ঠকে। অবশেষে নিয়তিকে দোষারোপ করে একটু স্বস্তি ফেরে। ছকিনা বলেন, ‘আমাগো কষ্ট তো বিয়া থিকা না। কষ্ট শুরু অইছে সেই ছোটবেলা থেকে। ছোট বেলায় বাপ-মা দু’জনকেই হারাই। থাকি অন্যের বাড়ি। অন্যেরা বিয়া দিছে। বাপ-মা নাই, কে কাকে দ্যাখে। ভোগ এখন কপাল জুইড়া আছে।’ ছকিনা বিবির বাড়ি ছিল কুকরির শাহবাজপুরে। কিন্তু আকস্মিক বাবা-মা দু’জনেরই মারা যাওয়ার পর ছকিনাসহ তার ছোট দুই বোন ছবুরা ও হাজেরার আশ্রয় হয় ওই এলাকারই মোফাজ্জল বয়াতির বাড়িতে। তিন বোন আলাদা ঘরে থাকলেও মোফাজ্জল বয়াতিই ছিলেন তাদের অভিভাবক। তার সিদ্ধান্তেই ছকিনা এবং তার বোনদের বিয়ে হয়।

স্বামী শফিউল্লাহ’র অনুপস্থিতিতে ছকিনার ঘরে বড় হয় দুই সন্তান আনোয়ার হোসেন ও রেশমা বেগম। ছেলেকে বিয়ে করানোর সময় হয়; মেয়েকেও বিয়ে দেওয়ার সময় হয়। বিপাকে পড়েন ছকিনা। ধারদেনা করে প্রথমে বিয়ে করার ছেলেকে। পরে মেয়ের বিয়ের প্রস্তুতি নেন। একইভাবে এর ওর কাছে চেয়ে-চিন্তে, একটা গরু বিক্রি করে টাকা জমিয়ে মেয়ের বিয়ে দেন কুকরির ৫ নম্বর ওয়ার্ডের শাহজাহান মিয়ার ছেলে মনির হোসেনের কাছে। বিয়ের পর বেশ কয়েক বছর গড়িয়ে গেলেও যৌতুকের দাবি জামাই মনির হোসেন কখনোই ভুলছে না। জোড়া গাভি চেয়েছে মনির। এরইমধ্যে রেশমার কোলজুড়ে আসে ফুটফুটে এক মেয়ে সন্তান। এরপরও মনিরের চাই জোড়া গাভি। রেশমাকে সে বিতারিত করেনি; তবে যৌতুকের দাবি নিয়ে প্রতিনিয়ত মারধর করছে বলে অভিযোগ করেন ছকিনা বিবি। ছকিনা বিবি বলেন, ‘গরিব মানুষ। কোথা থেকে জামাই’র দাবি পূরণ করমু। এলাকায় তো মেয়েদের বিয়েতে গরু, নৌকা দেওয়ার প্রচলন আছে। যাগো আছে, হেরা দেয়। আমরা কোথা থেকে দিমু। তারপরও কইছি, পারলে আস্তে আস্তে দিমু। জামাই তো শোনে না।’ এই কথাগুলো বলতে বলতে মেয়ের কথা মনে করে কাঁদতে থাকেন ছকিনা বিবি। আমি প্রসঙ্গ পাল্টাই। জানতে চাই তার বোনদের কথা।

ছকিনা বিবির ঘর থেকে খানিক দূরে তার মেঝো বোন ছবুরা বিবির ঘর; ঠিক ছকিনার মতই যার অবস্থা। তর্জনী উঁচিয়ে ছবুরার ঘরটি দেখিয়ে দেন ছকিনা। ঘরের দরোজা বন্ধ। ছকিনা ডাকাডাকি করলেন; কোন আওয়াজ এলো না। ফলে ছবুরার গল্পটাও শোনাচ্ছিলেন ছকিনা। ছবুরা বিবির বিয়ে হয়েছিল চর পাতিলার আবদুস ছত্তার নামের একজনের সঙ্গে। ছবুরার কোলজুড়ে আসে দুটো মেয়ে। কিন্তু ছবুরাকে বিয়ের বেশ কয়েক বছর পর মাথায় ‘চক্কর দেয়’ আবদুস ছত্তারের। আরেকটা বিয়ে করতে হবে তাকে। যে ভাবনা, সেই কাজ। চর পাতিলার অন্যপ্রান্তে নূরজাহান নামের বিধাব এক নারীকে বিয়ে করেন তিনি। এক পর্যায়ে ছবুরার সংসার ছেড়ে উধাও। ঠিক ছকিনার মতোই ছবুরা বিবিও বিপাকে পড়েন স্বামী চলে যাওয়ার পর। স্থানীয় গন্যমান্য ব্যক্তিদের কাছে অভিযোগ দিয়ে, দেন দরবার করে লাভ হয়নি। ছবুরার সঙ্গে ছত্তারের ছিঁড়ে যাওয়া বন্ধন আর জোড়া লাগেনি। সেই থেকে সন্তানদের কোলেপিঠে করে বড় করার চেষ্টা করেন ছবুরা। কিন্তু নিয়তি এখানেও আরেক ধাক্কা দিল ছবুরাকে। বিয়ের পর বড় মেয়ে চম্পা বেগমের জীবনে নেমে আসে চরম অশান্তি। চরফ্যাসনের দক্ষিণ আইচার করিম পাড়ার জামাল হোসেন নামের এক ছেলের সঙ্গে চম্পার বিয়ে হয়েছিল। ৫০ হাজার টাকা যৌতুকের দাবি ছেলের। কিন্তু মাত্র ১৮ হাজার টাকা দিতে পেরেছেন ছবুরা। ফলে যা হবার তা-ই হচ্ছে; বিরোধ চলছে; চম্পা বেগমও সইছেন নির্যাতন। ছকিনা বিবির তিন বোনের মধ্যে অপেক্ষাকৃত ভালো আছেন ছোটবোন হাজেরা বিবি। যদিও তার ঘরেও গঞ্জনার শেষ নেই। বয়সী এক ব্যক্তি জয়নাল জোমাদ্দারের কাছে তাকে বিয়ে দেয়া হয়েছিল। প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পর দ্বিতীয় স্ত্রী হিসাবে হাজেরাকে ঘরে তোলেন জয়নাল। প্রথম স্ত্রীর ৫টি ছেলেমেয়ে এবং নিজের ২ মেয়েকে সামলাতে হচ্ছে হাজেরাকে। অনেক কিছু নীরবে সয়ে তাকে টিকে থাকতে হচ্ছে। বিচার ব্যবস্থা, সালিশ বৈঠক সব হচ্ছে। তবুও বিচারের বাণী নীরবে কাঁদে। বিবাহ বিচ্ছেদ, তালাক, যৌতুক, বাল্যবিয়ে- সকল বিষয়ে এদেশে যথাযথ আইন রয়েছে। কিন্তু ক’জন ছকিনা সেই আইনের সুফল পাচ্ছেন। ন্যায্য বিচার না পাওয়া নারীরা অবশেষে নিজের জীবনের দুর্ভোগকে ‘কপালের লিখন’ বলেই মেনে নেন।                 






রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ জুন ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়