ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

ছোটগল্প || পরম্পরা

ফিরোজ আলম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:১৭, ২০ ডিসেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ছোটগল্প || পরম্পরা

|| ফিরোজ আলম ||

 

মফস্বল শহরের ছোট্ট রেলস্টেশন।

দুপাশে সবুজের সমারোহ নিয়ে ছুটে আসা রেললাইনটা হঠাৎ বিরাম চিহ্নের মতো স্টেশনটিতে থেমে গেছে। নাম তার ‘নিদপুর’। ফসলের মাঠের ভেতর দিয়ে বাঁকা হয়ে আসা রেললাইনটিকে মনে হয় কোনো তরুণীর গলার মালা, আর মাঝে লকেটের মতো লাল টিনের চালা দিয়ে ঢাকা ছোট প্ল্যাটফর্ম। সেই টিনের ফাঁকে ফাঁকে চড়ুই পাখির বাসা। নিদপুর রেলস্টেশন এই চুড়ুই পাখিগুলোই কিছুটা জাগিয়ে রাখে। তাদের ক্লান্তিহীন কিচিরমিচিরে চত্বরটা মুখরিত থাকে সারাদিন।

 

দিনে ছয়টা আপ-ডাউন ট্রেন থাকলেও মাত্র দুটো এখানে থামে, বাকিগুলো আন্তঃনগর। যখন ট্রেন থামে তখন কিছু যাত্রীর আনাগোনা হয়। তাও দুবার মিলিয়ে জনা বিশেক যাত্রীর বেশি হবে না। বাকি সময়টা নিদপুর তার নামের স্বার্থকতা বজায় রেখে সারাদিন ঘুমায়। স্টেশনের কুকুরগুলোও দিনরাত শুধু ঘুমায়। এই ঘুম ঘুম নীরবতার রেল স্টেশনের বেঞ্চে কদাচিত দু’একজন যাত্রী কিংবা তাদের আত্মীয়-স্বজন বসে থাকতে দেখা যায়। কিন্তু আজ সকাল থেকেই এক বৃদ্ধ ঠাঁয় বসে আছে। স্টেশন মাস্টার শফিক বিষয়টা খেয়াল করলেও সারাদিন কিছু বলেনি। শফিক এখানে নতুন, কাউকে তেমন চেনে না। তার উপর সকাল থেকেই শফিকের ব্যস্ততা ছিল। রেলের সবচেয়ে বড়কর্তা এই পথে আজ হাওয়া বদলে যাবেন। তাই স্টেশনের ঝাড়ুদার, পিয়নসহ সবাইকে নিয়ে ঝাড়ামোছা করেছে সে। যদিও গরিবের বাড়িতে হাতির পা পড়বে না তবুও হাতি চলার পথে ডানে-বামে দেখতে গিয়ে যদি কোনো কারণে গোস্বা হন, তাই বড় কর্তারা এই লাইনের সব স্টেশন মাস্টারকে বিশেষ বার্তা পাঠিয়ে রেখেছিলেন। শফিক সেই নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। বিকেলে যে ট্রেনে কর্তা গিয়েছে তারা সবাই মিলে লাইন করে দাঁড়িয়ে আস্ত ট্রেনটাকেই সালাম ঠুকেছে। বড় কর্তারা চেপে বসার পর ট্রেন কি আর শুধু ট্রেন থাকে? সে তো তখন দেবতার বাহন!

 

ট্রেনটা চলে গেলে শফিক ধীর পায়ে বৃদ্ধের সামনে এসে দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করল, ‘চাচা কোথায় যাবেন? আজ তো আর কোনো ট্রেন নেই।’

বৃদ্ধ মুখ তুলে তাকালেন। তার চোখে এমন কিছু ছিল যে শফিক এড়িয়ে যেতে পারল না। তাকে টেনে তুলে অফিস কক্ষে নিয়ে বসাল। লোকটি কিছু বলতে যেতেই শফিক হেসে বলল, ‘সারাদিন তো কিছুই খাননি। আগে খেয়ে নিন।’

শফিক নিজের টিফিন ক্যারিয়ারটা এগিয়ে দিল। ব্যস্ততার কারণে স্টেশনের বাইরের একমাত্র চায়ের দোকান থেকে দুপুরে চা-বিস্কুট খেয়েছিল আজ। তাই দুপুরের খাবার টেবিলেই পরে ছিল। লোকটি খেতে না চাইলেও জোর করে শফিক তাকে খেতে বসাল।

 

চোখের সামনে ক্ষুধার্ত কাউকে তৃপ্তি নিয়ে খেতে দেখলে শফিকের খুব ভালো লাগে। ক্ষুধার জ্বালা কত ভয়াবহ হয় শফিক তা জানে। এতিমখানায় বড় হয়েছে বলে আপন কেউ নেই তার। তাই সুযোগ পেলেই ক্ষুধার্ত কাউকে খাইয়ে তৃপ্তি পায়। আজ শফিকের ভালোলাগার পরিমাণটা যেন বেশিই ছিল। ময়মনসিংহের রহমানিয়া এতিমখানার বড় হুজুর একটা কথা বলতেন- মানুষের সেবা করার চেয়ে বড় কোনো এবাদত নাই।

বড় হুজুরের কল্যাণে আজ শফিক স্টেশন মাস্টার হতে পেরেছে। তার এই পথচলায় আরেকজন অদেখা মানুষের অবদান আছে। যিনি তার উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ার খরচ যুগিয়েছেন। শফিক তার নামটাই শুধু শুনেছিল হুজুরের কাছে; কোনোদিন দেখেনি। রহমানিয়া এতিমখানায় অষ্টম শ্রেণির বেশি পড়ার ব্যবস্থা ছিল না। শফিক যখন অষ্টম শ্রেণিতে টেলেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিল তখন বড় হুজুর এতিমখানায় বাতাসা বিলিয়েছিলেন। সবাই খুব খুশি হলেও শফিক আর বড় হুজুরের মনে আনন্দ ছিল না। কারণ অষ্টম শ্রেণির পর এই এতিমখানায় কাউকে রাখা হয় না। যে দাতাদের টাকায় এই প্রতিষ্ঠান চলে তাদের এমনই নিয়ম। আর দরিদ্র এই এতিমখানার এর বেশি দায়িত্ব নেয়ার উপায়ও ছিল না।

 

শফিককে যেদিন এতিমখানা থেকে বিদায় দেয়া হচ্ছিল তখন বাক্সপত্র নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাঁদছিল সে। কোথায় যাবে সে?-এই উৎকণ্ঠায় পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন বড় হুজুরও। তাদের কান্না দেখে এক পথচারী এগিয়ে এসে হুজুরকে কী যেন বললেন। নিমিষেই হুজুরের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি শফিককে তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে চাইলে লোকটি আপত্তি করে দ্রুত চলে গেলেন। এরপর হুজুর শফিককে নিয়ে এতিমখানায় ফিরে নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন। বললেন, ‘বাবা শফিক, আল্লাহ আমাকে ধন সম্পদ দেননি। নিজের জন্য আমি কিছু চাইনি কোনো দিন কিন্তু অন্যের জন্য যা চেয়েছি আল্লাহ তাই দিয়েছেন। আজ যখন তোকে নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়েছিলাম তখনও আমার বিশ্বাস ছিল আল্লাহ আমাকে নিরাশ করবেন না। কিছুক্ষণ আগে যার সাথে আমি কথা বললাম উনি তোর উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ার সব খরচ বহন করবেন।’

শফিক শুনে আনন্দে কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছিল সেদিন। শুধু জানতে চেয়েছিল, ‘কিন্তু আমাকে কি এখানে থাকতে দেবে?’

হুজুর বললেন, ‘কেন দেবে না? তুই আমার ঘরে থাকবি আর পড়বি। আমি গরিব মানুষ তাই তোকে মনের অনিচ্ছায় বিদায় দিচ্ছিলাম। এখন যেহেতু তোর পড়ার খরচ যোগার হয়ে গেছে তখন তুই আমার সাথেই থাকবি।’

এরপর থেকে প্রতি মাসের দশ তারিখের মধ্যে মানিঅর্ডার আসতে থাকে। শফিকের আর পেছনে তাকাতে হয়নি। স্নাতক শেষ করে স্নাতকোত্তর পড়তে পড়তেই রেলওয়ের চাকরিটা সে পেয়ে গেছে।

 

'বাবাজি আমি এই স্টেশনে রাতটা থাকতে পারি?'

বৃদ্ধ লোকটির কথা শুনে শফিক স্মৃতির গহীন থেকে বাস্তবে ফিরে এসে বলল, ‘অবশ্যই থাকতে পারেন। তবে আপনার পরিচয় কী? কেনইবা এখানে বসে আছেন সারাদিন।’

লোকটি তার গল্প বলতে শুরু করল-

‘‘আমি খুব সাধারণ কৃষক পরিবারের ছেলে। বাবা-মা,দুই ভাই আর এক বোন খেয়ে না খেয়ে মিলেমিশে ভালোই ছিলাম। আমি ছিলাম বড়।  মা সারা বছরই কোনো না কোনো অসুখে ভুগতো। ফলে ভাইবোনকে আমারই দেখাশোনা করতে হতো। আমি যখন নবম শ্রেণিতে পড়ি তখন এক বর্ষায় তিন দিনের জ্বরে ভুগে বিনা চিকিৎসায় মা মারা গেলেন। সেই দুঃখে বাবাও দেশান্তরি হলেন। ছোট ভাইটার বয়স তখন তিন আর বোনটা সবে হাঁটতে শিখছে। শুরু হলো আমার কঠিন জীবনসংগ্রাম। ভাইবোনকে সাথে নিয়েই দিনে অন্যের বাড়িতে কাজ করি, আর রাতে শ্মশানঘাটে জ্বালানো প্রদীপের আলোয় বসে পড়ি। সন্ধ্যার পর গ্রামের বড়রাও শ্মশানের আশপাশে যেতে ভয় পেত। অথচ আমি নির্দ্বিধায় চলে যেতাম। ভয় পেলে যে আমার চলবে না। কারণ ঘরে বাতি জ্বালানোটা আমার জন্য তখন বিলাসিতা ছিল। এভাবেই প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করলাম। আমি জেলার সর্বোচ্চ নাম্বার পাওয়ায় চারদিকে হইচই পরে গেল। আমাদের গ্রামের স্কুলের হেড স্যারের সহায়তায় জেলা সদরে গিয়ে কলেজে ভর্তি হলাম। জেলায় সবার চেয়ে বেশি নাম্বার পাওয়ায় প্রিন্সিপ্যাল স্যার আমাকে ফ্রি পড়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।

 

 

গ্রামের ছোট ভিটেটা ছাড়া বাবার কোনো জমি ছিল না। সেটুকু বেচতে চাইলে দূর সম্পর্কের চাচা জমিটি তার বলে দাবি করলেন। আমার কোনো কাগজপত্র নেই, বাবা নিরুদ্দেশ। গ্রামের মুরুব্বীরা ভিটে না ছাড়ার পরামর্শ দিলেন। বললেন, বাবা ফিরে এলে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ভিটে ধরে পড়ে থাকলে আমার চলবে না। নিজেকে মানুষ হতে হবে, ভাইবোনকে মানুষ করতে হবে। তাই ভিটে ছেড়ে শূন্য হাতে ছোট ভাইবোনকে নিয়ে শহরে একটা ছোট ঘর ভাড়া নিলাম। ছোট ভাইকে স্কুলে ভর্তি করে দিলাম। প্রিন্সিপাল স্যারের সহায়তায় তিনটি টিউশনি পেলাম। ছোটবোনকে কোলে করে ছাত্র পড়াতে যেতাম। অনেকেই বোনটাকে দত্তক নিতে চাইত।  আমি বোনকে শক্ত করে বুকে চেপে ধরে শুধু মাথা নাড়তাম।

 

কত কষ্ট করে যে লেখাপড়া চালিয়ে নিচ্ছিলাম তা বলে বোঝাতে পারব না। এরপরও আমি স্টার মার্কসসহ এন্ট্রান্স পাশ করলাম। স্বপ্ন অনেক বড় হয়ে গেল। বিদেশে একটা ভালো স্কলারশিপও পেয়ে গেলাম। কিন্তু ছোট ভাইবোনকে কার কাছে রেখে যাবো? একজন পরামর্শ দিল এতিমখানায় রেখে যেতে। সেদিন সারারাত আমি কাঁদলাম। ফজরের আজানের সময় বিছানা থেকে নেমে স্কলারশিপের কাজগটা ছিঁড়ে ফেললাম। আমি বেঁচে থাকতে আমার ভাইবোন এতিমখানায় থাকবে না। স্থানীয় কলেজে ডিগ্রীতে ভর্তি হলাম। খরচের ভয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম না। তাছাড়া এই শহরে আমার ছয়টা টিউশনি ছিল। সেগুলো ছেড়ে আনিশ্চয়তায় পরতে চাইলাম না। ছোট ভাইটা তখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে আর বোনটা স্কুলে যাবার জন্য রোজ বায়না করে। এভাবেই প্রথম শ্রেণিতে স্নাতক পাশ করলাম। এরপর একটি ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে আবেদন করলাম। আল্লাহর রহমতে আমার অফিসার পদে চাকরি হয়ে গেল। আমাদের অন্ধকার দিনের শেষ আর রৌদ্রজ্জোল দিনের শুরু হলো।

 

ছোট ভাইবোনকে নিয়ে নিজের কর্মস্থলে ঘুরতে লাগলাম আর ওদের লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করলাম। ভাইটা এখন এমবিবিএস ডাক্তার আর বোনটা পিএইচডি করছে কানাডাতে। কিছুদিন আগে ওখানেই বিয়ে করেছে। বিয়ের দিন ফোন করে আমাকে বলল, ‘দাদাভাই আমি বিয়ে করছি আজ। আমার জন্য দোয়া কোরো।’ আমি শুধু বললাম খুকু আমাকে জানালিও না, বিয়ের দিন বলছিস?

বোনের উত্তর ছিল ‘আমি তো তাও আগে জানিয়েছি, তোমার আদরের ছোট ভাইয়ের মতো বিয়ে করার ছয় মাস পর বলিনি।’

আমি বললাম, খুকু তুইও আমার আদরের ছোট বোন।

খুকু ঝাজালো কণ্ঠে বলল, ‘বাড়িটা ভাইয়ার নামে লিখে দেয়ার আগে আমিও তাই জানতাম।’

ব্যাস ওটুকু বলেই ফোনটা কেটে দিল। ঠিকই তো খুকু তো তবু খোকার চেয়ে ভালো করেছে।

 

আমার সারাজীবনের সঞ্চয়ে একটা বাড়ি করেছিলাম সাভারে। ওদের মানুষ করতে গিয়ে নিজের সংসার করা হয়নি। ভেবেছিলাম শেষ বয়সে ভাইবোনের সাথে মিলেমিশে থাকব। হঠাৎ ছোটভাই চাকরির কথা বলে জমি কেনার জন্য টাকা চাইল, না হলে বাড়িটা লিখে দিতে বলল। স্থায়ী ঠিকানা না থাকলে নাকি বিসিএস ক্যাডার হওয়া যায় না। ভাবলাম আমরা আমরাই তো বাড়ি কার নামে থাকলো তাতে কি?

সাভারের বাড়িটা খোকার নামে লিখে দিলাম। সেটার কাগজপত্র বুঝিয়ে দিতে ঢাকা এসে ওর শাহবাগের মেসে গিয়ে শুনলাম, ছমাস আগেই খোকা এক বড়লোক বান্ধবীকে বিয়ে করে মেস ছেড়ে শ্বশুরের বাড়িতে উঠেছে। প্রচণ্ড আঘাত পেলেও ওর বন্ধুদের বুঝতে দিলাম না। জমির জরুরি কাগজ বলে অন্য কারো হাতে দেয়ার সাহস পেলাম না। খোকার শ্বশুরবাড়ির ঠিকানা নিয়ে সেখানে গেলাম। যাবার পথে নিউমার্কেট থেকে সোনার গহনা কিনে নিলাম। ছোটভাইয়ের বউ খালি হাতে দেখি কী করে।

 

আমাকে দেখে চমকে উঠল খোকা। আমতা আমতা করে বলল, ‘দাদাভাই, হঠাৎ করেই সব হয়ে গেল তাই তোমাদের জানাতে পারিনি।’

আমি শুধু বললাম, ছয় মাসেও যদি তোর হঠাৎ ঘটনা না জানাতে পারিস তবে সেটা আমার জন্য হঠাৎ হলেও তোর জন্য হঠাৎ নয়। যাই হোক, তুই জমি কেনার জন্য টাকা চেয়েছিলি। আমার কাছে জমি কেনার টাকা নেই। তাই আমার কেনা বাড়িটাই তোর নামে লিখে দিলাম। বৌমাকে ডাক মুখটা দেখে চলে যাই।

ছোটভাই চিবুনো কণ্ঠে বলল, ‘টাকা থাকবে কী করে, যা আয় কর তা দিয়ে তো ফকির-মিসকিনদের লেখাপড়া শেখাও। আমাদের জন্য তোমার কি কোনো চিন্তা আছে?’

অবাক হয়ে গেলাম। কী বলছে খোকা! অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিলাম। এখন তো আর সেই ছোট্ট খোকা নেই। যে সারাদিন আমার পিছু পিছু ঘুরতো আমি মুখে তুলে না খাওয়ালে খেতে পারত না। ওদের কোনোদিন বাবা-মায়ের অভাব বুঝতে দেইনি। সেই খোকা আজ আমার সাথে এভাবে কথা বলছে! মৃদু হেসে বললাম, খোকারে যাদের তুই ফকির-মিসকিন বলছিস একদিন তুই কিংবা আমি ওদের চেয়েও খারাপ অবস্থায় ছিলাম। তখন কিছু মানুষের সহায়তায় আজ এখানে আসতে পেরেছি আমরা। এতিম শিশুদের কিছু কিছু সহায়তা আমি সেই দায় থেকেই করি। আর আমি তো তোদের বাদ দিয়ে ওদের জন্য কিছু করিনি? তোদের পেছনে খরচ করে যেটুকু বেঁচে গেছে তাই ওদের দিয়েছি।

 

জমির কাগজ আর বৌমার জন্য গহনা দিয়ে চলে এলাম ভাইয়ের শ্বশুর বাড়ি থেকে। বৌমার মুখটাও দেখা হলো না, কারণ সে ঘুমুচ্ছে। তাকে নাকি ডাকা যাবে না। আমার কান্না ছোট ভাইটিকে একটুও বিচলিত করল না।  

 

ভাইবোন দুটোকে মানুষ করতে গিয়ে নিজে বিয়ে-থা করিনি। লেখাপড়া শিখলেই যে কেউ মানুষ হয় না তা আামি ওদের কাছ থেকেই শিখেছি। মানুষ হতে আসলে স্কুল-কলেজে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না। মানবিকতাই একজনকে পারে মানুষ বানাতে। আমি ব্যর্থ আমার ভাইবোনকে মানুষ করতে গিয়ে। যাই হোক আজ আমি আমার চাকরি জীবন শেষ করলাম। সারাদিন বসে বসে ভাবছিলাম-কোথায় যাবো আমি? কে আছে আমার? না আছে আপনজন, না কোনো ঠিকানা। সারাজীবন যে স্থায়ী ঠিকানা লিখে এসেছি সেটাও জ্ঞাতি ভাইয়েরা দখল করে রেখেছে। কিছুদিন আগে সেখানে গিয়ে দেখি আমার বাবার সেই দুঃসম্পর্কের ভাই মারা গেছেন। তার দুই ছেলে এখন অন্যের বড়িতে কাজ করে খায়। আমাদের জমিটুকুতে কোনো রকমে মাথাগুঁজে বেঁচে আছে। ওদের হাতে কিছু টাকা দিয়ে ফিরে এসেছিলাম।’’

 

শফিকের চোখ দিয়ে তখন টপটপ করে জল ঝরছে। একজন মানুষ কতটা মহান হতে পারে ভাবছিল সে। সামলে নিয়ে সে জানতে চাইল, এখন কী করবেন ভেবেছেন কিছু?’

বৃদ্ধ বললেন, ‘কাল সকালের ট্রেনে ময়মনসিংহ রহমানিয়া এতিমখানায় যাব। আমার পেনশনের একটা অংশ বড় হুজুরের কাছে দিয়ে এরপর ঠিক করব কী করা যায়। তাই রাতটা স্টেশনে থাকার অনুমতি চাইছি।’

রহমানিয়া এতিমখানা আর বড় হুজুরের কথা শুনে শফিকের চোখমুখ উজ্বল হয়ে উঠল। সে বলল, ‘চাচা আপনি রহমানিয়া এতিমখানার বড় হুজুরকে চেনেন?’

বৃদ্ধ বললেন, ‘চিনবো না কেন? খুব ভালো মানুষ হুজুর। আমি রহমানিয়া এতিমখানার কিছু কিছু ছেলের পড়ার খরচ দেই। আমি গরিব মানুষ যেটুকু পারি আর কি।’

 

শফিক এবার বৃদ্ধের পায়ের কাছে বসে পড়ল। তারপর কৌতূহলের আতিশয্যে দ্রুত কণ্ঠে জানতে চাইল, ‘আপনার নাম কি আনোয়ার হোসেন?’

 বৃদ্ধ লোকটি শুধু মাথাটা মৃদু নেড়ে সম্মতি জানালেন। অমনি শফিক হুরমুর করে বৃদ্ধের পা জড়িয়ে ধরল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘চাচা আপনার দেয়া সেসব দানে আমার মতো কতো শফিক আজ সমাজে প্রতিষ্ঠিত তা কি আপনি জানেন?’

বৃদ্ধ শফিককে টেনে তুলে বুকে জরিয়ে ধরলেন। বললেন, ‘বাবা তুমি আামার মনটাকে ভরিয়ে দিলে। আমি ভেবেছিলাম আামার জীবনটা বুঝি ব্যর্থই হয়ে গেল। কিন্তু তোমাকে দেখে আবার আশায় বুক বাঁধলাম। চল আবার রহমানিয়া এতিমখানায়। মানুষ তৈরি করার চেষ্টা চালিয়ে যাই।’

শফিক বলল, ‘তার আগে আমার বাসায় চলুন। বড় হুজুর এখন আমার কাছেই থাকেন। আপনাকে কতো খুঁজেছি আমি আর হুজুর মিলে। কিন্তু আপনি ঠিকানা গোপন করে টাকা পাঠান বলে খুঁজে পাইনি। আজ যখন আপনাকে পেয়েছি তখন আর হারাতে চাই না।’

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২০ ডিসেম্বর ২০১৬/তারা/এএন

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়