ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

জাতিগত নিধন শান্তির পথ নয়

জাহাঙ্গীর আলম বকুল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:০৭, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জাতিগত নিধন শান্তির পথ নয়

জাহাঙ্গীর আলম বকুল : দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় জেলা কক্সবাজার সীমান্ত দিয়ে স্রোতের মতো মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের আসা অব্যাহত রয়েছে। জাতিসংঘের হিসাবে নতুন করে প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা এসেছে। আসার ধারা কিছু দিন যদি অব্যাহত থাকে, তাতে এ সংখ্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা অনুমান করাও কঠিন। এর আগে গত তিন দশক ধরে বাংলাদেশে পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছে।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী জাতিগত নিধনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। দেশটির সোয়া পাঁচ কোটি জনসংখ্যার ৪ শতাংশেরও কম রোহিঙ্গা। যারা মুসলিম। সামরিক বাহিনীর প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলে আর অল্প দিনের মধ্যেই সকলকে মাতৃভূমি ছাড়তে হবে। অনিচ্ছাকৃত হলেও এ বিশাল জনগোষ্ঠীর অধিকাংশের ভার বইতে হবে বাংলাদেশকে। এটাই এ মুহূর্তে এ দেশের জন্য নির্মম বাস্তবতা। 

রোহিঙ্গা সমস্যার সৃষ্টি মিয়ানমারে, এর সমাধান করার দায়িত্বও তাদের। এতে বাংলাদেশের দায়িত্ব বা দায় কোনোটাই নেই। বাংলাদেশ শুধু এখানে জড়িয়ে গেছে মানবিক কারণে। সামরিক সরকার যে মানবিকতার ধার ধারে না, তা মিয়ানমার দিয়ে আবার প্রমাণ হলো।

রোহিঙ্গারা রাখাইন রাজ্যের উল্লেখযোগ্য নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী। দেশটিতে বহু নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী অধিবাসীদের মধ্যে বৈচিত্র্য এনেছে। ১৩৫টি নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠীর মানুষ রয়েছে সেখানে। আজ যাদের দেশহীন রোহিঙ্গা বলা হচ্ছে, এক সময় সেখানে তাদের স্বাধীন রাজ্য ছিল। তারা সাতশ বছর ধরে সেখানে বাসবাস করছে। ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার পর বার্মার সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছে রোহিঙ্গারা, মন্ত্রীও হয়েছে। ১৯৮০ এর দশকে জান্তা সরকারের হঠাৎ মনে হয়- রোহিঙ্গারা বার্মিজ নয়। এরপর তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়। সমস্যার শুরু সেখান থেকেই। 

রোহিঙ্গারা এখন রাষ্ট্রহীন। নিজভূমে পরবাসী। তাদের ভোটাধিকার নেই এবং রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারে না। সামরিক সরকারকে যেহেতু জবাবদিহি করতে হয় না, তারা জাতিগত নিধনের মতো হঠকারী ও নিষ্ঠুর পদক্ষেপ নিতে পারে।

রোহিঙ্গা বিষয়ে বাংলাদেশের দায় শুধুই মানবিক। প্রতিবেশী হওয়ার কারণে এতে জড়িয়ে পড়তে হয়েছে। প্রথম দিকে নতুন করে এ দায়িত্বে না জড়াতে রোহিঙ্গা-স্রোত রুখে দেয়ার চেষ্টা করা হয়, কিন্তু একটা সভ্য-গণতান্ত্রিক দেশের এতটা নিষ্ঠুর হওয়া সম্ভব হয়নি। সভ্য-মানবিক সমাজ সেটা পারে না। অনিবার্যভাবেই তাই জড়াতে হয়েছে বাংলাদেশকে। 

কিন্তু বাংলাদেশে রোহিঙ্গা নামক এই বিষফোঁড়া কেটে ফেলা সহজ হবে না। তিন দশক ধরে পাঁচ লাখ রোহিঙ্গাকে খাইয়ে-পরিয়ে রাখতে হচ্ছে। এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে আরো চার-পাঁচ লাখ। একটি গরিব দেশের আট-নয় লাখ অতিথির ভার বহন করা কঠিন।

যে রোহিঙ্গাদের নিরূপায় হয়ে আশ্রয় দিতে হলো, এর জন্য একদিন হয়ত চড়া মূল্য দিতে হবে। মিয়ানমারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে আছে শক্তিধর চীন। সেখানে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য আছে ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রের। সে দেশের খনিজ সম্পদের ওপর নজর আছে অনেক দেশের। তারা জাতিসংঘকে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ নিতে বাধা দেবে। এ তিন দেশের অন্তত মৌন সমর্থন না থাকলে মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের ফিরিতে নিতে রাজি করানো যাবে না। এতে দীর্ঘ  দিন রোহিঙ্গাদের ভার বহতে হবে।

রোহিঙ্গারা এ অঞ্চলে স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে পারে এমন আশঙ্কা অমূলক নয়। রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের সশস্ত্র সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি- আরসার আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। এর প্রধান আতাউল্লাহর বাবা মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গা। আতাউল্লাহ বেড়ে উঠেছেন সৌদি আরবের শরণার্থীশিবিরে। স্বদেশ ভূমি থেকে বিতাড়নের ভ্রান্ত নীতি আরো আতাউল্লাহ জন্ম দেবে। এরা শুধু মিয়ানমারকে অস্থিতিশীল করবে না, এ অঞ্চলের শান্তিতে হুমকি সৃষ্টি করবে।

২০১৫ সালের ৮ নভেম্বর মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান হলেও সংসদে ২৫ শতাংশ প্রতিনিধিত্ব সামরিক বাহিনীর। নির্বাচনের ফলে এনএলডি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও শাসনতন্ত্রের বিধিবদ্ধ বাধায় দলীয় প্রধান সু চি রাষ্ট্রপতি হতে পারেননি। তিনি মিনিস্ট্রারিয়াল কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী। মূলত তিনিই সব। কিন্তু নেপথ্যে সব ক্ষমতা জান্তার হাতে। জান্তা প্রভাব থেকে মিয়ানমারের বেরিয়ে আসা সহজ নয় এবং সময়-সাপেক্ষ। সু চি স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় জান্তার সুরে কথা বলছেন।

মানবাধিকার কাউন্সিলের ৩৬তম অধিবেশনে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার জেইদ রাদ আল হুসেইন রোহিঙ্গা হত্যাকে ‘জাতিগত নিধন’ বলে অভিহিত করেছেন। এটি গুরুত্বপূর্ণ এবং অর্থবহ। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে গণহত্যার বিচারের পথ উন্মুক্ত হয়ে থাকল। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যদি কখনো মিয়ানমার শক্তিশালী দেশের সমর্থন হারায়, তখন তাদের বিচারের মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা থাকছে। এই মুহূর্তে জরুরি নিধন বন্ধ করে শান্তির পথ তৈরি করা।

দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য মিয়ানমার জান্তা নিয়ন্ত্রিত সরকার জাতিগত নিধনের যে পথ বেছে নিয়েছে, তাতে বিভেদ এবং ঘৃণা শুধু বাড়বে। ঘৃণার মধ্যে শান্তিতে সহ-অবস্থান করা যায় না। এতগুলো বৈচিত্র্যপূর্ণ জাতিসত্তার সমাহার ঘটেছে মিয়ানমারে, সেখানে শ্রদ্ধার সঙ্গে সহ-অবস্থান খুব জরুরি। শান্তির জন্য সেটিই একমাত্র পথ। যেটি কফি আনান কমিশন সুপারিশে বলেছেন। 

সুপারিশের মধ্যে অন্যতম- রোহিঙ্গাদের পূর্ণ নাগরিকত্ব প্রদান, তাদের অবাধ চলাচলের সুযোগ ও আইনের চোখে সমান অধিকার নিশ্চিত করা; রোহিঙ্গাদের স্থানীয় প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা; নিজ ভূমিতে ফিরে আসা রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ইত্যাদি। এ সুপারিশ বাস্তবায়নই মিয়ানমারে শান্তির একমাত্র পথ।

 

লেখক: সাংবাদিক
 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭/বকুল/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়