ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

জাতীয় গ্লানির দায়মুক্তির ১০ম বার্ষিকী

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ২৮ জানুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জাতীয় গ্লানির দায়মুক্তির ১০ম বার্ষিকী

শাহ মতিন টিপু : জাতীয় গ্লানির দায়মুক্তির ১০ম বার্ষিকী, ঐতিহাসিক ২৮ জানুয়ারি আজ। ২০১০ সালের এই দিনের সূচনালগ্নেই (রাত ১২টার পর) বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত ১২ আসামির পাঁচজনের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার মধ্য দিয়ে একটি জাতীয় গ্লানির দায়মুক্তি ঘটে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল। এটি ছিল পৃথিবীর অন্যতম জঘন্যতম বর্বর নির্মম নৃশংস রাজনৈতিক হত্যাযজ্ঞ।এর বিচারের জন্য জাতিকে দীর্ঘ ৩৪টি বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল ।

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে কার্যকর করা হয় কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, মেজর বজলুল হুদা, লে. কর্নেল এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ (ল্যান্সার), লে. কর্নেল মুহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি) ও লে. কর্নেল সুলতান শাহারিয়ার রশিদ খান এর মৃত্যুদন্ড। হন্তারক এ পাঁচজনই সাবেক সামরিক কর্মকর্তা।

এই রায়ে মৃত্যদন্ডপ্রাপ্ত আরও সাতজন হচ্ছেন আব্দুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম, এস এইচ এম বি নূর চৌধুরী, মোসলেমউদ্দিন, রাশেদ চৌধুরী ও আব্দুল মাজেদ। যারা বিদেশে পালিয়ে ছিলেন।

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যের নৃশংস হত্যার বিচার রাজনৈতিক কারণে দীর্ঘ সময় ধরে বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। হত্যাকান্ডের পর সঠিক বিচারের পথে বাধার পরে বাধা এলেও কোনো কিছুই ধোপে টিকেনি। সময়েরই বিলম্ব ঘটিয়েছে শুধু। এরমধ্যেই কেটে গেছে ৩৪টি বছর।

হত্যাকারীদের বিচারের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য দায়মুক্তি (ইনডেমনিটি) অধ্যাদেশ নামের কালাকানুন জারি করা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, হত্যাকারীদের পুরস্কৃতও করা হয়েছিল বিদেশি মিশনে লোভনীয় পদে চাকরি দিয়ে। এমনকি পরবর্তী সময়ে তাদের কাউকে কাউকে রাজনৈতিক দল গঠন ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল।

সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর কোনো মামলা করতে দেয়নি তৎকালীন সরকার। বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে গেলেও দেশে ফিরতে পারেননি বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা।

প্রথমে বাধা, এরপর হত্যাকান্ডের বিচারের পথ রুদ্ধ করার জন্য '৭৫ এর ২৬ সেপ্টেম্বর তৎকালীন খোন্দকার মোশতাক সরকার ইন্ডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করে।দীর্ঘদিন পর ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকার দায়মুক্তি অধ্যাদেশটি বাতিল করলে ওই হত্যাকান্ডের বিচারের পথ উন্মুক্ত হয়।

হত্যাকান্ডের ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী মুহিতুল ইসলাম ধানমন্ডি থানায় ২৩ জনকে আসামি করে মামলা করেন।

তদন্ত শেষে পুলিশ ১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। ওই বছরের ১২ মার্চ ঢাকায় দায়রা জজ আদালতে শুরু হয় বিচার। একই বছর ৭ এপ্রিল ওই আদালত ২০ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে। মারা যাওয়ায় আসামির তালিকা থেকে বাদ পড়েন মোশতাক আহমেদ, মাহবুবুল আলম চাষী ও মোস্তফা আহমেদ।

১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর ঢাকার দায়রা জজ গোলাম রসুল ২০ আসামির ১৫ জনকে 'ফায়ারিং স্কোয়াডে' মৃত্যুদন্ড দিয়ে রায় দেন। এর আগেই আব্দুর রশিদের স্ত্রী জোবায়দা রশিদ হাইকোর্টের আদেশে মামলা থেকে অব্যাহতি পান।

এরপর ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ এ মামলায় বিভক্ত রায় দেয়। ওই বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. রুহুল আমিন ১০ আসামির মৃত্যুদন্ড বহাল রাখেন। অন্য বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ১৫ আসামির ফাঁসির আদেশই বহাল রাখেন।

২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল হাইকোর্টের তৃতীয় বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম তার রায়ে ১২ আসামির মৃত্যুদন্ডাদেশ বহাল রেখে তিন আসামি মো. কিসমত হাসেম, আহমেদ শরিফুল হোসেন ও নাজমুল হোসেন আনসারকে খালাস দেন।তবে হাইকোর্ট প্রচলিত নয় বলে 'ফায়ারিং স্কোয়াডে' মৃত্যুদন্ডের পরিবর্তে 'ফাঁসিতে ঝুলাইয়া' মৃত্যুদন্ড কার্যকরের আদেশ দেয়।

মৃত্যুদন্ড বহাল থাকা কারাবন্দি চার আসামি বজলুল হুদা, ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার ও মহিউদ্দিন আহমেদ একই বছর আপিলের আবেদন করেন। যুক্তরাষ্ট্রে গ্রেপ্তার এ কে এম মহিউদ্দিনকে ২০০৭ সালে দেশে আনা হলে তিনিও আপিলের আবেদন করেন। এভাবে অনেক সময় গড়িয়ে গেলেও শেষাবধি সত্যেরই জয় হয়। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে জাতি।

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, এটি হয়েছে দেশের প্রচলিত সাধারণ আইনে, কোন বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে তড়িঘড়ি আসামিদের ফাঁসি দেওয়ার কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এই দৃষ্টান্ত বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া সব রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের বিচারের ক্ষেত্রে একটি উজ্জ্বল ও অনুসরণীয় মাইলফলক।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ জানুয়ারি ২০১৮/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়