ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

জাতীয় সমস্যা প্রেম-ভালোবাসা!

রিয়াজুল হক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:১৮, ১২ মার্চ ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জাতীয় সমস্যা প্রেম-ভালোবাসা!

রিয়াজুল হক : বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে একদিন ক্লাসে আমার অত্যন্ত প্রিয় একজন স্যার প্রশ্ন করলেন, তোমরা বলতে পারবে বাংলাদেশের জাতীয় সমস্যা কোনটি? আমরা প্রত্যেকেই কেউ রাজনীতি, কেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, কেউ যানজট, কেউ সন্ত্রাস ইত্যাদি ইত্যাদি বলতে লাগলাম। স্যার হাসলেন এবং উত্তরে বললেন, বাংলাদেশের জাতীয় সমস্যা হল ‘প্রেম ভালোবাসা’।

অনেকেরই প্রশ্ন, কেন স্যার? এবার তিনি ব্যাখ্যা দিলেন, ‘সারাদিন কর্মব্যস্ততার পর একটু টিভির সামনে বসলেই, এমন কোন নাটক, টেলিফিল্ম, সিনেমা নেই যেখানে অল্প বয়সী ছেলে মেয়েদের প্রেমের বিষয় ছাড়া অন্য কোন কিছু দেখানো হয়। যত ধরনের অঘটন, দাঙ্গা, হানাহানি সেই প্রেম নিয়েই হচ্ছে। তাহলে বাংলাদেশের জাতীয় সমস্যা কি দাড়াল ? স্যার হয়ত রসিকতা করেই বিষয়টা বলেছিলেন কিন্তু কথাটির তাৎপর্য অনেক বেশি ছিল। যদি আমরা একটু খেয়াল করি, কথাটা কিন্তু অসম্ভব রকমের সত্যি। তরুণ-তরুণীদের প্রেম ছাড়া আর যেন কোন কাহিনী আমাদের বাংলা বিনোদনে চিন্তাই করা হয়না।

রিপন (ছদ্মনাম) নামের যে ছেলেটা অনার্স পড়ার পড়ার সময় তার প্রেমিকার বিয়ে হয়ে যাওয়ার কারণে ২৫-৩০টি ঘুমের বড়ি খেয়ে মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছে, সেই রিপন জেডিএস- এর স্কলারশিপ নিয়ে জাপানে পিএইচডি করেছে। অথচ অনার্স পড়ার সময় প্রাক্তন প্রেমিকার পরিবার থেকে রিপনকে ‘হোপলেস’ আখ্যা দিয়ে বলা হয়েছিল, অনার্স পাশই করতে পারবে না।

আবার, রত্নার (ছদ্মনাম) সঙ্গে ১২ বছর প্রেমের অভিনয় করে যে ছেলেটা অন্য একটি মেয়েকে বিয়ে করল, শোক সইতে না পেরে রত্না ঘরের সিলিং ফ্যানের সঙ্গে কাপড় প্যাচানোর সময় মায়ের চোখে ধরা পরে যায়। সেই রত্না এখন বিসিএস ক্যাডার। স্বামী-সন্তান নিয়ে ভালো আছে।

আমাদের স্কুল কলেজের ছেলেমেয়েদের যদি ‘নাসা’ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়, অনেকেই বলতে পারবে না। শেখ সাদী, আল্লামা রুমী, শেলীর নাম অনেকেই জানে না। সারাটা দিন যে মোবাইল কিংবা টেলিভিশন নিয়ে পরে থাকে, এগুলোর আবিষ্কারকের নাম জানারও চেষ্টা করে না। আমাদের ছেলেমেয়েরা সারদিন এখন ব্যস্ত ফেসবুক, হোয়াটস আপ, ভাইবার নিয়ে। ঘরের মধ্যে থেকেও বাবা-মায়ের সাথে কথা বলার সময় নেই। আগে সন্তানরা বাবা-মায়ের সঙ্গে এক বিছানায় ঘুমাতে চাইত। এখন কিছুটা বুঝে ওঠার আগেই ব্যক্তিগত জীবন শুরু হয়ে যায়। যে চেহারা চোখের সামনে কোনদিন দেখা হয়নি, তার সঙ্গে ইন্টারনেটের মাধ্যমে যোগাযোগ করেই যেন রাজ্যের সুখ পাওয়া যায়। কি অদ্ভুত চিন্তা ভাবনা আমাদের!

প্রেমে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যা করেছে- এ রকম ঘটনা আমাদের দেশে প্রতিনিয়ত ঘটছে। তোমাকে না পেলে আমি বাঁচবো না, জীবন থেমে যাবে, সম্পূর্ণ অর্থহীন কথা। জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না। জীবনের চেয়ে মূল্যবান আর কিছুই নেই। জীবনের জন্যই সব। জীবন আছে বলেই প্রেম, অভিমান, স্বপ্ন, দুঃখ সবকিছু আছে। জীবনে ব্যর্থতা আসতেই পারে। কিন্তু একবার ভেবে দেখুন, সবই সাময়িক সময়ের জন্য। পঞ্চম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া জামান (ছদ্মনাম) বার্ষিক ফলাফল দেখেই যদি লেখাপড়া বন্ধ করে দিত তবে এসএসসি পরীক্ষায় বোর্ডস্ট্যান্ড করার আনন্দ সে কখনই পেত না। আজ সেই জামান একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক। নিজেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে হবে। জীবনটা কোন সিনেমার অংশ নয় যে, সব সমস্যার সমাধান তিন ঘণ্টায় হয়ে যাবে। আর আত্মহত্যা করে আপনি কি প্রমাণ করলেন? নিজেকে শেষ করে অন্যকে কোনদিন শিক্ষা দেওয়া যায় না।

পৃথিবীতে কে কোন ব্যর্থতার কারণে আত্মহত্যা করেছে, কোন কারণে আত্মহত্যা করেছে, তার বিশ্লেষণে যাব না। যারা চলে গেছে তাদের নিয়ে ঘাটাঘাটি করে কি হবে? কিন্তু যারা আছে, তাদের বলব, জীবনকে ভালোবাসুন। যে সারাজীবন আপনার পাশে থাকবে কথা দিয়েছে, সে হয়ত কোন উদ্দেশ্য নিয়েই কথাটি বলেছে। শুরুতেই সাবধান হোন। পরে দুঃখ পাবেন না। আপনার সকল সিদ্ধান্ত আপনাকেই নিতে হবে। মাধ্যমিকের কারিক্যুলামে অনেক কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে কিন্তু আত্নহত্যা বিষয়ক আদৌ কোন অধ্যায় আছে কিনা, আমার জানা নেই। তবে না থাকলে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। পরীক্ষায় পাশ করতে হলেও সবাই পড়বে, জানবে এবং মনের মধ্যে তৈরি হবে দৃঢ়তা।

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি পাহাড় থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করবে, সে জাহান্নামে অনুরূপভাবে আত্মহত্যা করতেই থাকবে এবং উহা হবে তার স্থায়ী বাসস্থান। যে ব্যক্তি বিষ পানে আত্মহত্যা করবে, বিষ তার হাতেই থাকবে, জাহান্নামে সে সর্বক্ষণ বিষ পান করে আত্মহত্যা করতে থাকবে। আর উহা হবে তার স্থায়ী বাসস্থান। আর যে ব্যক্তি লৌহাস্ত্র দিয়ে আত্মহত্যা করবে, সেই লৌহাস্ত্রই তার হাতে থাকবে। জাহান্নামে সে তা নিজ পেটে ঢোকাতে থাকবে আর সেখানে সে চিরস্থায়ীভাবে থাকবে। কিসের আশায় আমরা আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছি? দুই মিনিটের হঠকারী সিদ্ধান্তে সব শেষ হয়ে যাবে, সেটা মানা যায় না।

একটা উদাহরণ দিয়েই শেষ করতে চাই। ব্রিটেনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জন মেজর। বাবা ছিলেন সার্কাস দলের কর্মী। অর্থাভাবে অষ্টম শ্রেণির বেশি পড়াশোনা করতে পারেননি। কর্মজীবনের শুরুতে তিনি বাস কন্ডাক্টর হওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু অংকে কাঁচা এই যুক্তিতে চাকরি হয়নি। পরবর্তীকালে এই জন মেজরই ব্রিটেনের অর্থমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী হন। যে যুবক অংকে পারদর্শী নয় বলে বাসের কন্ডাক্টর হতে পারেননি, পরবর্তী সময়ে তিনিই ব্রিটেনের মতো দেশে অর্থনীতির হাল ধরেন। এরপর প্রধানমন্ত্রীর পদেও অধিষ্ঠিত হন তিনি।

এত এত প্রতিবন্ধকতা ছাপিয়ে যদি জন মেজর পারেন, আর আপনি প্রেম ভালোবাসার নামে প্রতারণাকারীর জন্য কিংবা চলার পথে বিভিন্ন ব্যর্থতার জন্য জীবন দিয়ে দেবেন, এত সহজ নাকি আপনার জীবন? প্রেম ভালোবাসায় অন্যায় কিছু নেই, তবে অবশ্যই আগে নিজেকে তৈরি করুন। জীবনে সফলতা আসবেই। জীবন এমনই। শুধু ধৈর্য্য ধারন করা শিখতে হবে।

লেখক: উপ-পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১২ মার্চ ২০১৯/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়