ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

জাহাজ ভাঙা দেখলাম, ছবি তোলা গেল না

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৪৫, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জাহাজ ভাঙা দেখলাম, ছবি তোলা গেল না

ফেরদৌস জামান: পাহাড় চূড়া থেকে চারপাশের দিগন্তজোড়া প্রকৃতির রূপে মুগ্ধতার আচ্ছন্নতা কেটে গেছে। মন বলছে, এমন নির্মল সৌন্দর্য দেখার জন্য সম্ভব হলে বারবার আসতাম! এত দিনের অভিজ্ঞতায় এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, নতুন করে দেখার ছলে একই জায়গায় দ্বিতীয়বার আর যাওয়া হয়ে ওঠে না। বৈকুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরছি উপজেলা সদরের দিকে। সম্ভব হলে আজ রাতেই বান্দরবান রওনা করব, কারণ পথেই ঠিক হয়েছে এর পরের গন্তব্য ব্যর্থ হয়ে ফেরা সেই নতুন চর।

হাটুরেরা হাট থেকে সদাইপাতি নিয়ে বাড়ি ফিরছে। কেউ হয়তো মরিচ নিয়ে গিয়েছিল; কেউবা আদা, চাল, সবজি। পাহাড়ি বাজার সাধারণত ভোর থেকে শুরু হয়ে বেলা এগারোটার মধ্যে শেষ হয়ে যায়। বাজার ধরতে তারা ভোরেই রওনা করে, দূরবর্তীরা মাঝরাতে বা তার পরে। নিজ পণ্য বিক্রি করে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে পুনরায় ফিরতি পথ ধরা। এই কষ্টের জীবনে তারা বংশ পরম্পরায় অভ্যস্ত। মাঝে মধ্যে  গিয়ে এসব দেখে আমাদেরও ভালো লাগে, পুলকিত হই, ছবি তুলি, গল্প-কবিতা বা কাহিনি লিখি কিন্তু কাউকে যদি পাহাড়ি জীবন বরণ করতে বলা হয় তখন এই অনুভূতিগুলো নিমিষেই  হাওয়ায় পালাবে। এটাই বাস্তবতা আর তাই কোন না কোনভাবে আমরা সকলেই একেকজন পর্যটক। ঠিক পাহাড়িদের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা প্রযোজ্য যদিও তারা শহর আর সমতলকে বেশি আরাম ও সুখের মনে করে।

খালে পৌঁছার আগেই সন্ধ্যা নেমে এলো। এই খাল ধরেই ভটির দিকে উপজেলা সদর। দেখতে দেখতে হাট ফিরতি মানুষের সংখ্যা ফুরিয়ে এলো। এখন বোধহয় নিঃসঙ্গ পথের সঙ্গী কেবল আমরা দুজন। দুই পাশে উঁচু পাহাড়ের নিচ দিয়ে খাল। ভরাট অন্ধকার রাতে খালের পানি কুলকুল করে বয়ে যাচ্ছে। মহোনীয় শব্দের অবিরত গুঞ্জন ব্যাহত হচ্ছে আমাদের এগিয়ে চলার ছপছপ শব্দে। এমন শব্দ যে শত সন্তর্পণ হতে চাইলেও গোপন করা যায় না, যেন কত কত মাইল দূর পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে, জেগে উঠছে হিংস্র জন্তু জানোয়ার। কনকনে শীত জেঁকে বসল। সদর পৌঁছে রাত বাজে আটটা। শেষ বাস চলে গেছে দুই ঘণ্টা আগে, অন্য বাহনও নেই। বাজার বন্ধ হতে চলছে। লোকেরা বলে রাতটা এখানেই থেকে যেতে। একটা মোটর সাইকেল মিলে গেল তবে দুইশ টাকার ভাড়া পাঁচশ। দরদামের সুযোগ না রেখে চালক মহোদয় চুপ। মুদির দোকানদারীর পাশাপাশি অনেকে এই কাজ করে। অসময়ের খদ্দের, মোটা ভাড়া। রাজি হলেই কড়কড়ে পাঁচশ টাকা! আমরাও ভাবনায় পরে গেছি, রাতে বান্দরবান যেতে পারলে অনেকটা সময় এগিয়ে থাকা যায়। সকাল সকাল রওনা দিয়ে চট্টগ্রাম গিয়ে জাহাজ ভাঙা শিল্প এলাকাটা দেখে নেয়া যাবে। নিশুতি রাত, চেকপোস্ট ফাঁকা, কোনো গাড়িঘোড়াও নেই। মাঝেমধ্যে দু’একটা পাথর বোঝাই ট্রাকের দেখা মিলছে। জানা মতে দেশের পার্বত্য এলাকার পাহাড় তথা খাল-ঝিরি ও নদী থেকে পাথর সংগ্রহ বা উত্তোলনের কোনো নিয়ম নেই। তাহলে ট্রাক বোঝাই পাথরগুলো কোথা থেকে আসছে আর কোথায় চালান হয়ে হচ্ছে?

 


বান্দরবানে ওঠা হলো পরিচিত শাওন রেস্ট হাউজের সেই একই ঘরটাতে। ২০১৪ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দুইদিন আগে যেখানে উঠেছিলাম। দেশব্যাপী অস্থিরতায় পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে তখন হাহাকার চলে। হাজার হাজার পর্যটকে যে সময় বান্দরবান ভরা থাকে, সেই সময় বান্দরবান শহরে পর্যটক বলতে ছিলাম গুনে গুনে আমরা মাত্র তিনজন।

রাতটা পার করে সকালেই চট্টগ্রামে যাত্রা। নতুন চর যেতে চট্টগ্রাম থেকে মজু চৌধুরীর ঘাট যেতে হবে। লক্ষীপুর জেলার কোনো একটা লঞ্চঘাট হয়ে থাকবে। চট্টগ্রাম থেকে ভোলাগামী যাত্রীরা এ পথেই যাতায়াত করে। রাত নয়টা কি সাড়ে নয়টায় বাস। টিকিট কেটেই ভাটিয়ারীর পথ ধরলাম। জাহাজ ভাঙা শিল্প দেখার অগ্রহ অনেক দিনের। যাওয়ার পথেই জনতে পাই শিপইয়ার্ডের ভেতর কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। কারণ জানতে চাইলে কেউ স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারে না বা বলতে চায় না। তাহলে কি ফিরে আসতে হবে? নির্দিষ্ট স্টপেজে নেমে মহাসড়ক থেকে একটা পথ ধরে এগুতে থাকলাম। ভাবসাব আর পোষাক দেখে আশপাশের লোকেদের মনোযোগ আমাদের দিকে। বিষয়টা ভালোভাবে আন্দাজ করতে পেরে বিকল্প ব্যবস্থার বুদ্ধি আঁটতে থাকলাম। সামনে একটা ইয়ার্ড, সামান্য বামে গিয়ে একটা, ডানে আরও একটা। এখানে এমন অনেক শিপইয়ার্ড রয়েছে। দুই পাশের ঘরবাড়ির কোন না কোন অংশে ভাঙা জাহাজের টুকরো-টাকরি বা এটাসেটার সংযোজন আছেই। যেমন, কোন বাড়ির পায়খানা, কোন বাড়ির সীমানাপ্রাচীর আবার, কোন বাড়ির ঘরের চাল এসব দিয়ে তৈরি। সমনের মোড়ে দুই কিশোর সাইকেল নিয়ে খেলায় ব্যস্ত। বলে, আমাদেরকে ঢুকতে দেবে না, তবে তাদের সাথে গেলে কোন ইয়ার্ডে না ঢুকেও ভেতরের কাজ কারবার দেখা সম্ভব।

 


তাদের কথাই ঠিক থাকল। ওরা আগে আগে আর আমরা অনেক পেছনে। কেউ বুঝতেই পারবে না যে, আমরা একসাথে। কিছু দূর গিয়ে প্রবেশ করলাম জেলখানার মত সুউচ্চ প্রাচীর দেয়া লম্বা গলির ভেতর। জনসাধারণের চলাচলের পথ নয়, দুই ইয়ার্ডের সীমানা প্রাচীরের ফাঁক এবং সেই জায়গাটুকু দিয়ে স্টীলের মোটা পাইপ পাতা নালা। তার উপর দিয়েই পথ। পাইপের অর্ধেক শরীর বেরিয়ে রয়েছে, দুই ধার থেকে সবুজ দুর্বা ঘাস লকলকে ডগা ছেড়েছে। পায়ের নিচে পরে যেন কুকড়ে উঠছে। গলির মাথায় পড়ন্ত বিকেলে সাগরের কমলা রং এর পানি। তার মাঝে বিশ্রী রকমে জমের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে কয়েকটা কদাকার জাহাজ। প্রাচীর শেষে উপস্থিত হয়েছি সমুদ্রের ধারে। এখান থেকে দুই পাশের দুই ইয়ার্ডের বেশ খানিকটা দেখা যায়। চরিদিকে নিরাপত্তা ক্যামেরা বসানো। উভয় ইয়ার্ড থেকে নিরাপত্তাকর্মী এসে হাজির। কি চাই, কেন এসেছি নানান প্রশ্ন। জোর দিয়ে বলতে পারছে না- বিদায় হন। সামনে একটা টারবাইন পরে আছে। চার পাখার বিশাল টারবাইন। এক পাখাতেই আমার মতো সাত-আট জন বসে থাকা সম্ভব। কথায় কথায় বহু ওজনের টারবাইনের এক পাখায় দাঁড়াতে সক্ষম হলাম। দুজন দুপাশ থেকে আরও নিকেটে এলো। এগিয়ে আসছে আরও কয়েক জন। এই শিল্প দেখার সহজ সরল ইচ্ছা বা আগ্রহের কথা বুঝানোর পর তাদের সন্দেহ যেন কাটল। কিসের সন্দেহ আর কেনইবা সন্দেহের দৃষ্টি সে এক প্রশ্ন। অনেক চেষ্টার পর তাদের মুখ খোলানো গেল। মৃদু শব্দে কথা চলল। এর মাঝে কয়েক মিনিট পরপরই আমাদের বিদায় হওয়ার কথাটা স্মরণ করে দিতে ভুলছে না। কথার পৃষ্ঠে কথার বুনন কেটেই চলছি। ক্যামেরা বের করতে নিলে সাবধান করা হলো, কোন প্রকার ছবি তোলা যাবে না! প্রকান্ড আকৃতির একেকটা জাহাজ কেটে ফালা ফালা করা হচ্ছে। সমুদ্রের পানিতে মিশে যাচ্ছে রাসায়নিক দ্রব্য, তেল আর নানান বর্জ্য। কয়েকশ মিটার দূর থেকে শ্রমিকরা সেই কাটা, ভাঙা অংশ শুকনায় টেনে তুলছে। পানি আর কাদা ঠেলে তুলতে গিয়ে তাদের শরীর কাদার প্রলেপে ঢেকে গেছে, যেন মানুষ নয় সিমেন্ট-বালির একেকটা ভাস্কর্য। জাহাজের বিভিন্ন ভাঙা অংশের নিচে চাপা পড়ে, বিস্ফোরণ অথবা অগুন লেগে শ্রমিকের মৃত্যু এখানে হরহামেশাই ঘটে। নিরাপত্তা রক্ষীর পেট টিপে টিপে জানা যায়, একটা সময় ছিল যখন শ্রমিকের মৃত্যু হলে লাশ বস্তায় ভরে দূরে পানিতে ফেলে দেয়া হতো। শ্রমিক নিয়োগের ক্ষেত্রে মালিক পক্ষ আর এদের মাঝে থাকে এক শ্রেণীর দালাল। যারা কিছু না করেই পারিশ্রমিকের একটা মোটা অংশ কেটে নেয়। কি পরিমাণ ঝুকিপূর্ণ কাজ তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। পেটের দায়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অত্যান্ত সমান্য পারিশ্রমিকে কাজ করা শ্রমজীবীর বড় অংশই উত্তর বঙ্গের মঙ্গা পিরিত এলাকা থেকে আগত। ক্ষুধার্ত সন্তানের মুখ যখন চোখের সামনে ভেসে ওঠে তখন ওই শ্রমিকের কাছে জীবনের ঝুঁকির বিষয়টা তুচ্ছ হয়ে যায়।

 


টারবাইনের পাখা থেকে নেমে আর একটু সামনে অর্থাৎ, পানির কাছে যেতে চাইলে নিরাপত্তারক্ষীদ্বয় এবার কড়া হলেন। এতক্ষণের বহু চেষ্টায় ছবি তোলার জন্য ক্যামেরা বা মোবাইল ফোন সেট কোন কিছুই বের করা সম্ভব হলো না। চোখের দেখা দেখে একই পথ ধরে ফিরে এলাম। রাতের খাবারের দাওয়াত সুজিতের খালার বড়ি। কালীবাড়ি বা কালী মন্দির রোডে খালার বাড়িতে খেয়েই বিদায়। কারণ বাস ধরতে না পারলে গতকাল থেকে একটু একটু করে বাঁচানো সমস্ত সময়টাই গোল্লায় যাবে। খালার বড়ি অনেক পদের মঝে আলু-পোস্তের তরকারী সত্যিই দারুণ ছিল। আমার কাছে যা নতুন এক পদ। তাই বোধহয় একটু মনোযোগ দিয়ে ভাবতে গেলে স্বাদটা আজ পর্যন্ত মুখে অটুট লেগে রয়েছে অনুভূত হয়। একটা ব্যাপর এখানে তুলে ধরতে চাই, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বেড়াতে বেড়াতে লক্ষ করেছি অঞ্চল ভেদে মানুষের যে ভিন্নতা রয়েছে তার মধ্যে খাবার অন্যতম। অর্থাৎ, একই খাবার অথচ দক্ষিণাঞ্চল এবং উত্তরাঞ্চলে স্বাদের তফাত খুঁজে পাওয়া যায়। তেমনি সম্প্রদায় ভেদেও খাবারের পদ ও স্বাদে ভিন্নতা পাওয়া যায়। যেমন, এই আলু-পোস্ত তরকারীর কথা বলতে গেলে তা কেবল সনাতন (হিন্দু) পরিবারে রান্ন হয়ে থাকে। তা-ও আবার সামর্থবান পরিবারে। তরকারীতে মেথি, ফোড়ন বা এই ধরণের মশলার ব্যাপক ব্যবহার তাদের খাবারেই পাওয়া যায়। অধিকন্তু রান্নার ধরনেও রয়েছে ভিন্নতা। যাহোক, আলু-পোস্তের আটুট স্বাদ মুখে নিযে দ্রুত উপস্থিত হলাম বাস কাউন্টারে। ছেড়ে দেবার বাকি মাত্র পাঁচ মিনিট। যাক এ যাত্রায় রক্ষা কারণ চট্টগ্রাম থেকে মজু চৌধুরীর ঘাট আপাতত এটাই একমাত্র বাস।

 

 


রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়