ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

টালিউডে সাফল্য পেতে ঢালিউডকে বঞ্চিত করেছেন যারা

রাহাত সাইফুল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৩০, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
টালিউডে সাফল্য পেতে ঢালিউডকে বঞ্চিত করেছেন যারা

রাহাত সাইফুল: ‘নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস,/ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস।/নদীর ওপার বসি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে;/কহে, যাহা কিছু সুখ সকলি ওপারে।’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘মোহ’ কবিতার মতো মোহে পড়ে ঢাকাই চলচ্চিত্রের এক সময়ের জনপ্রিয় শিল্পীরা ওপারে পাড়ি দিয়েছেন। তারা হয়তো এই কবিতার মতো ভেবেছিলেন- ও পারেতে সর্ব সুখ! কিন্তু তাদের সেই সুখ বেশিদিন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কিছুদিন যেতেই স্বার্থ ফুরিয়ে গেলে ওপার থেকে তাদের ছুড়ে ফেলে দেয়া হয়েছে। এপার-ওপার দু’কূলই হারিয়েছেন তারা। এদের কেউ কেউ পরবর্তী সময়ে জন্মভূমিতে ফিরে এসে চলচ্চিত্রে হারানো আসন ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সফল হননি। ফলে বাধ্য হয়ে অনেকে চলচ্চিত্রাঙ্গন ছেড়ে দিয়েছেন। ঘটনাগুলো কারো অজানা নয়। তারপরও ওপারে যাওয়া থেমে নেই। এ সময়েরও কেউ কেউ ওপারে ‘সর্ব সুখ’ ভেবে পাড়ি দিচ্ছেন টলিপাড়ায়। প্রশ্ন হচ্ছে তাদের কপালেও পূর্বসূরীদের মতো ঘটনা ঘটবে না তো?

অতীতে ফিরে তাকালে দেখা যায়- এক সময়ের তুমুল জনপ্রিয় অভিনেত্রী অঞ্জু ঘোষ। বাংলাদেশের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ব্যবসাসফল সিনেমার নায়িকা তিনি। ১৯৮২ সালে চলচ্চিত্র নির্মাতা এফ কবির চৌধুরীর ‘সওদাগর’ সিনেমার মাধ্যমে চলচ্চিত্রে পা রাখেন। এরপর ঢালিউডে প্রায় অর্ধ শতাধিক সিনেমায় অভিনয় করে তিনি তারকা হয়ে ওঠেন। ১৯৮৯ সালে অঞ্জু অভিনীত ‘বেদের মেয়ে জোস্‌না’ মুক্তির পর আকাশচুম্বী দর্শকপ্রিয়তা পায়। এরপরই অঞ্জুর দর্শক চাহিদা দুই বাংলায় সমানভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। দর্শকপ্রিয় হয়ে ওঠেন অঞ্জু ঘোষ। ১৯৯৫ সালে অঞ্জুকে নিয়ে ‘নেশা’ সিনেমার কাজ শুরু করেন নির্মাতা সাইদুর রহমান সাইদ। এই সিনেমাটির কাজ শেষ হওয়ার আগেই ১৯৯৬ সালে কলকাতায় পাড়ি জমান এই নায়িকা। তখন কলকাতায় অঞ্জুর চাহিদা ছিল। অবশেষে অঞ্জুকে ছাড়াই জোড়াতালি দিয়ে সিনেমাটি মুক্তি দিতে হয় নির্মাতাকে। সেই যে দেশ ছেড়ে গেলেন এরপর আর দেশে ফেরেননি অঞ্জু। কলকাতা গিয়ে চলচ্চিত্রে ব্যস্ত হয়ে পড়েন এই নায়িকা। তবে এই ব্যস্ততা খুব বেশিদিন থাকেনি। ২০০৪ সালের দিকে অঞ্জু মঞ্চে কাজ শুরু করেন। মঞ্চেও বেশিদিন তাকে দেখা যায়নি। এরপর হাতে অখণ্ড অবসর। কলকাতায় তিনি অলস সময় পার করেছেন। বয়সও বেড়েছে। এই উপমহাদেশে এমনিতেই ত্রিশের পর নায়িকাদের চাহিদা কমতে থাকে। মা-ভাবীর পার্শ্বচরিত্র তখন ভরসা। সেই ভরসার জায়গাটুকুও যখন নেই তখন অঞ্জু ঘোষ মনে করছেন-নিজ দেশে গিয়ে আবারো চলচ্চিত্রে মনোযোগী হওয়া দরকার। তাই তো দীর্ঘ ২২ বছর পর সম্প্রতি ঢাকায় এসে তিনি বিএফডিসি ঘুরে গেলেন। বলে গিয়েছেন তিনি আবারো চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত হবেন। ক্যারিয়ারের রমরমা সময় দেশ ছেড়েছেন। পড়ন্ত এই বেলায় দেশে এসে সত্যি তিনি কিছু করবেন কিনা, করলেও কতটুকু সফল হবেন তা সময়ই বলে দেবে।

১৯৯৭ সালে প্রয়াত জননন্দিত অভিনেতা সালমান শাহের আকস্মিক মৃত্যুর কারণে তার অভিনীত অসমাপ্ত ‘বুকের ভিতর আগুন’ সিনেমায় কাজ করতে ফেরদৌস প্রথম ক্যামেরার সামনে আসেন। ছটকু আহমেদ পরিচালিত এ সিনেমার গল্পে কিছুটা পরিবর্তন করে ফেরদৌসকে কাজ করার সুযোগ দেন। এরপর ১৯৯৮ সালে ফেরদৌস এককভাবে নায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন ‘পৃথিবী আমারে চায় না’ সিনেমার মধ্য দিয়ে। এরপরই দর্শক মহলে ফেরদৌস পরিচিতি পান। ঠিক সেই সময় ভারতের চলচ্চিত্রকার বাসু চ্যাটার্জির ডাকে সাড়া দিয়ে যৌথ প্রযোজনার ‘হঠাৎ বৃষ্টি’ সিনেমায় তিনি কাজ করেন। সিনেমাটি দারুণভাবে সাড়া ফেলে। এরপর থেকে তিনি ভারতের বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেন। এক পর্যায়ে জনপ্রিয়তা হারাতে থাকলে তিনি টলিউডে পার্শ্ব চরিত্রেও অভিনয় করেছেন। তবে ভারতীয় বাংলা সিনেমায় খুব বেশিদিন টিকে থাকতে পারেননি এই চিত্রনায়ক। তাকেও ফিরে আসতে হয়েছে আপন নীড়ে। দেশে এসে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে কাজ করছেন তিনি।

তিনবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেত্রী সাদিকা পারভিন পপি। ক্যারিয়ারের শুরুতেই ‘কুলি’ সিনেমা দিয়ে তাক লাগিয়েছিলেন। সেই সময় পপির দর্শক চাহিদাও ছিল বেশ ভালো। তখন তাকে নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন নির্মাতা ওয়াকিল আহমেদ। ‘কোটিপতি’ শিরোনামের সিনেমার কাজ শুরু করেছিলেন। সিনেমার কিছু অংশের কাজও হয়েছিল। মাঝ পথে এসে যৌথ প্রযোজনার সিনেমায় অভিনয়ের প্রস্তাব পেয়ে শুটিং রেখেই কলকাতা উড়াল দেন পপি। সেখানে শুটিং নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যান তিনি। এদিকে ওয়াকিল আহমেদের শুটিং ইউনিট পপির জন্য কিছুদিন অপেক্ষা করে অবশেষে শুটিং বন্ধ রাখে। পরবর্তী সময়ে প্রযোজক লোকসানের কারণে সিনেমাটির কাজ আর সম্পন্ন করতে পারেননি। এদিকে ‘ও পারেতে সর্ব সুখ’ এই ভাবনাটা পপিরও বেশিদিন থাকেনি। খুব কম সময়ের মধ্যেই তাকে দেশের সিনেমায় মনোনিবেশ করতে হয়েছে। পশ্চিম বঙ্গের সিনেমায় তিনি তার অবস্থান তৈরি করতে পারেননি। দেশের সিনেমা তাকে খ্যাতি দিয়েছে, সন্মান দিয়েছে। চলচ্চিত্রে এখন তার চলার পথ মলিন।

দেশ সেরা চিত্রনায়ক শাকিব খান। অনেক সাধনা ও পরিশ্রম করে রানা থেকে আজ শাকিব খান হয়েছে। একের পর এক ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র উপহার দিয়ে ঢাকাই চলচ্চিত্রে একক আধিপত্য বিস্তার করেছেন। তাকে নিয়ে সিনেমাপ্রেমীদের অনেক অহঙ্কার, অনেক স্বপ্ন। দেশের মানুষই দিয়েছেন তাকে ‘কিংখান’ খ্যাতি। অন্যদিকে কলকতার দর্শক শাকিব খানের নামই জানতেন না। যৌথ প্রযোজনার নামে ভারতীয় চলচ্চিত্র এদেশে মুক্তি দেয়া হয়েছে এক সময়। দেশীয় চলচ্চিত্র বোদ্ধারা মুখ বুজে মেনে নিলেও বাংলার দর্শক নীরবে সেইসব সিনেমা প্রত্যাখান করেছেন। এসব সিনেমায় আন্তর্জাতিক মানের শিল্পী, ঝকঝকে ছবি, নাচ-গান সবই ছিল। কিন্তু এ দেশের দর্শক প্রতারণার সিনেমা না দেখে শাকিব খানের সিনেমা দেখেছে। ফলে প্রশ্ন ওঠে কী ছিল শাকিব খানের সিনেমায়? এর উত্তর হয়তো শাকিব খানের কাছে ছিল না। কিন্তু আমরা দেখেছি সেসব সিনেমার গল্পে ছিল এই দেশের সমাজ বাস্তবতা। ছিল না সেখানে আরোপিত কোনো কিছু। আর ছিল গান। নিজস্ব ঘরানার কথা ও সুর তাতে স্থান পেত। এজন্য দর্শক শাকিব খানের সিনেমা দেখেছে। ঠিক সেই সময়টাতে কোনো কিছু না ভেবেই শাকিব খানও নিজের ভোল পাল্টে যৌথ প্রযোজনার ‘শিকারী’ সিনেমায় নাম লেখালেন। সিনেমাটি ব্যবসায়িকভাবে সফলও হয়েছে। এই সিনেমাটিতে বাংলাদেশের অংশে পরিচালক ছিলেন সীমান্ত। তাকে মূল্যায়ন করা হয়নি। এই ঘটনা সিনেমাটির মহরতের দিনই স্পষ্ট হয়েছিল। ইদানিং সময়ের যৌথ প্রযোজনার সিনেমা নির্মাণ করেন ওপার বাংলার নির্মাতারা। এটা ওপেন সিক্রেট। যৌথ প্রযোজনার অধিকাংশ সিনেমায় বাংলাদেশের কোনো নির্মাতাকে মূল্যায়ন করা হয় না। শুধু বাংলাদেশের নির্মাতা নয়, মূল্যায়ন করা হয় না এদেশের অন্যান্য কলাকুশলীদেরও। এসব জেনেও একটার পর একটা যৌথ প্রযোজনার সিনেমায় কাজ করে যাচ্ছেন শাকিব খান। শুধু কি তাই! এপার বাংলার সিনেমায় নামে মাত্র কাজ করছেন তিনি। কিন্তু ওপার বাংলার সিনেমায় অভিনয় করেই যাচ্ছেন তিনি। এখন তো সাফটা চুক্তির মাধ্যমে ভারতীয় এসব সিনেমা বাংলাদেশে অহরহ মুক্তি দেয়া হচ্ছে। অনেকেই মনে করছেন বাংলাদেশে শাকিব খানের দর্শকপ্রিয়তা থাকার কারণেই তাকে নিয়ে সিনেমা নির্মাণ করছেন কলকাতার নির্মাতা ও প্রযোজকরা। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের বাজারটা ধরতে চাচ্ছেন টলিউড সিনেমাসংশ্লিষ্টরা। দুদিন পর তারা অঞ্জু ঘোষ, ফেরদৌসের মতো শাকিব খানকেও ছুড়ে ফেলবেন না এর নিশ্চয়তা কে দেবে?

শাকিব খান চাইলেই এ দেশের নাজুক চলচ্চিত্রের হাল ধরতে পারতেন। নিজের ভুলগুলো শুধরে ঢাকাই চলচ্চিত্রকে দীর্ঘস্থায়ীভাবে ক্ষতির মুখ থেকে রক্ষা করতে পারতেন। এছাড়াও ওপারের ডাকে সাড়া দিয়ে কাজ করেছেন ওমর সানি, শাবনূরসহ অনেকেই। তবে ওপারে তারা বেশিদিন কাজ করতে পারেননি। যদিও এই প্রজন্মের শিল্পীদের মধ্যে ওপারে কাজ করার ইচ্ছেটা একটু বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এদের কেউ কেউ ওপারের স্বল্প বাজেটের আর্ট ফিল্মেও কাজ করছেন। আবার কেউ কেউ ছোটখাটো চরিত্র পেলেও ওপারের চলচ্চিত্রে কাজ করতে আগ্রহী হচ্ছেন। এই তালিকায় রয়েছেন- সোহানা সাবা, আইরিন, আমান রেজা, অরিন, শিপনসহ অনেকে। শিল্পীদের আসলে তারকাটা বেড়া দিয়ে আটকে রাখা যায় না। সেটা উচিতও নয়। শিল্পী বিভিন্ন দেশের সিনেমায় কাজ করবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যে দেশের কলাকুশলীদের মেধা আর দর্শকদের ভালোবাসায় শিল্পী হয়ে ওঠা সেই দেশের চলচ্চিত্রকে ভুলে গিয়ে নয়। অভিনয় ও কাজের মধ্য দিয়ে নিজ দেশের চলচ্চিত্র শিল্পকে আন্তর্জাতিক পর্যায় নিয়ে যেতে পারেন একজন দর্শকনন্দিত শিল্পী। দেশের সিনেমা কিভাবে আন্তর্জাতিক মানের করা যায় সেই বিষয়টা মাথায় নিয়ে বিদেশে কাজ করাটা অন্যায় নয়। যেমনটা ওপারে গিয়ে দাপটের সঙ্গে কাজ করেছেন নায়করাজ রাজ্জাক। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পকে গুরুত্ব দিয়েই ওপারে কাজ করেছেন বলেই তিনি দুই দেশেই সম্মান পেয়েছেন। তিনি আগে দেশীয় সিনেমায় শিডিউল দিয়ে সুযোগ পেলে তারপর ওপারে কাজ করেছেন।

একথা এখন আর কারো অজানা নেই, দেশীয় শিল্পীদের মধ্যে যেসব শিল্পীরা ওপারে পা বাড়িয়েছেন তাদের অধিকাংশের ভাগ্যে জুটেছে দুর্ভোগ। তাদের দিকে তাকালে মাইকেল মধুসূদন দত্তের সেই কবিতাটার কথাই শুধু মনে পড়ে-

‘হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন;—
তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,
পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ’

এই শিল্পীরা এটা ভুলে যান যে, মাইকেলও এক সময় কপোতাক্ষ নদের পাড়েই ফিরে এসেছিলেন।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮/রাহাত/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়