ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

টেলিভিশন: টেলিবিভীষণ!!

ফিরোজ আলম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:২৭, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
টেলিভিশন: টেলিবিভীষণ!!

|| ফিরোজ আলম ||

একই গুরুর শিষ্যত্ব গ্রহণ করলে তাকে ‘সতীর্থ’ বলে। কিন্তু একই টিভি অনুষ্ঠান বা চ্যানেলের নিয়মিত দর্শক হলে তাকে কী বলা যায়? সেটা যে নামই দেই না কেন টিভি চ্যানেলের দর্শক ভিন্নতা হিসাব করলে আমাদের এখন অনেক বিভক্তি। বিভক্তি আমাদের জীবনদর্শন কিংবা আদর্শেও। এসব বিষয়ে মানুষে-মানুষে কিছুটা পার্থক্য সর্বযুগেই হয়তো ছিল। কিন্তু এখন তা অনেক বেশি। শুধু টিভি দেখেই এই পার্থক্য রচিত হয়েছে, এমন বলব না। তবে পারিবারিক বিনোদনের এই বৃহৎ মাধ্যমটি যে আমাদের চিন্তা-চেতনা ও জীবনযাপন প্রণালিতে অনেক প্রভাব রাখে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। আমার ছেলেবেলায় অর্থাৎ আশির দশকে আমরা মোটামুটি সবাই একটি চ্যানেলেরই দর্শক ছিলাম। তাই আমাদের মানসিক বিকাশ ছিল প্রায় একই ধারার।

নব্বইয়ের শুরুতে কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে টেলিভিশনের অনুষ্ঠান দেখার প্রচলন চালু হয়। মার্কিন সংবাদ চ্যানেল সিএনএন ১৯৯২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর বিটিভির মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টার অনুষ্ঠান সম্প্রচার শুরু করে। তাদের পথ ধরে একই বছর বিবিসিও সংবাদ প্রচার শুরু করে। এরপর সাধারণ বাসাবাড়িতে ডিশ অ্যান্টেনা ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ায় স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বিদেশি অনুষ্ঠানাদি দেখার নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়। ১৯৯২-৯৫ সালে বাংলাদেশের বাড়িঘরে ১০টির মতো আন্তর্জাতিক টিভি চ্যানেল দেখা যেত। ২০০১ সালে এই সংখ্যা ৫০ ছাড়িয়ে যায় এবং বর্তমানে তা ১৫০-এর ওপরে। তবে এসব সুবিধা নব্বইয়ের দশকের শেষ পর্যন্ত ঢাকা কিংবা বড় শহরগুলোতেই সীমাবদ্ধ ছিল। আমাদের মতো মফস্বলবাসীর তখন ভরসা ছিল শুধুই ‘বিটিভি’ নামক জাতীয় গণমাধ্যমটি। সে সময় আমাদের একমাত্র পারিবারিক বিনোদন ছিল এটি। প্রতিদিন বিকেল ৫টা থেকে শুরু হয়ে মধ্যরাতের আগেই সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যেত। শুক্রবারে সকালে একটি অধিবেশন হতো, আবার বিকেল ৩টা থেকে দ্বিতীয় অধিবেশন শুরু হতো। অনুষ্ঠান তালিকায় ছিল সপ্তাহে একটি ধারাবাহিক নাটক, একটি সাপ্তাহিক নাটক, একটি ইংরেজি সিরিয়াল, কখনো কখনো ডাবিংকৃত বিদেশি সিরিয়াল, মাসে এক দিন ছায়াছন্দ। এমন অল্প কিছু উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠান প্রচার হলেও সেগুলো ছিল জনপ্রিয়তার তুঙ্গে।

‘মুভি অব দি উইক’ শিরোনামে মাসের তিনটি শুক্রবারের দুপুর আমাদের কাটত বিশ্বখ্যাত ইংরেজি ছবি দেখে। আর মাসের একটি মাত্র শুক্রবার দুপুরে হতো বাংলা ছায়াছবি। সেদিন সকাল থেকে মা-চাচিদের কাজের গতি থাকত সুপারসনিকের মতো। দুই প্রান্তে দুটো U-আকৃতির বাঁকানো ও মাঝে সোজা কিছু অ্যালুমিনিয়ামের স্টিকের তৈরি টিভির অ্যান্টেনাগুলো কোনো লম্বা বাঁশের ডগায় লাগানো থাকত। কারো কারো অ্যান্টেনায় আবার হাঁড়ির ঢাকনা লাগানো থাকত। তাতে টিভির ছবির মান কতটা ভালো হতো তা জানি না। তবে অ্যান্টেনাগুলোর জৌলুশ বাড়ত বৈকি। ‘জিনিস যেটা ভালো দাম তার একটু বেশি’ বিজ্ঞাপনের এই কথা যদি সত্য হয়ে থাকে তবে ঢাকনা লাগানো অ্যান্টেনাগুলো অবশ্যই ভালো ছিল।

তখন তিন মাস অন্তর ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’ হতো। কাঙ্ক্ষিত সেই দিনে টিভি অ্যান্টেনা লাগানো বাঁশটি নিচে নামানো হতো। সিরিশ কাগজ দিয়ে ঘষে-মেজে অ্যান্টেনা চকচকে করা হতো। এরপর ডানে-বাঁয়ে ঘুরিয়ে সবচেয়ে পরিষ্কার ছবি আনার কসরত চলত অনেকক্ষণ। অবশ্য ভালো ঝকঝকে ছবি পাওয়া ছিল ভাগ্যের ব্যাপার। যেদিন রাতে ‘ইত্যাদি’ হতো সেদিন পুরো বাংলাদেশের রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যেত। সেই সময়গুলোয় আমাদের পড়াশোনায় মনোযোগী করানো হতো রাতে টিভি দেখার সুযোগ দিয়ে। আমরাও সন্ধ্যা হলেই বিপুল বিক্রমে তারস্বরে চিৎকার করে পড়াশোনা শুরু করতাম টিভিতে প্রিয় সিরিয়াল দেখব বলে। স্কুলে আলোচনার বিষয়বস্তুর বড় অংশজুড়ে থাকত আগের রাতে দেখা টিভি অনুষ্ঠানগুলোর চুম্বক অংশ। আমাদের গল্পের উপাদানও যেমন এক ছিল, তেমনি হিরো কিংবা ভিলেনও আমাদের একই ছিল। আমরা সবাই কখনো ম্যাগগাইভার, কখনো অটোম্যান, কখনো নাইট রাইডার কিংবা সিন্দবাদ হতে চাইতাম। আসলে বিটিভি আমাদের একই ধরনের স্বপ্নে আটকে রেখেছিল। সেটা ভালো ছিল না মন্দ ছিল সে মূল্যায়ন করছি না। আমি শুধু তখনকার অবস্থাটা তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

তখন আমরা টিভিতে প্রচারিত অনুষ্ঠানে কার কী ভালো লেগেছে, মন্দ লেগেছে, শেয়ার করতাম। আমরা রোজ কিছু না কিছু দেখে মুগ্ধ হতাম। এখনকার প্রজন্ম মুগ্ধ হতে ভুলে গেছে। মুগ্ধ হতে যে সূক্ষ্মদর্শী মননের প্রয়োজন হয়, তা আজকালকার কিশোর কিংবা তরুণেরা বোধ করি হারিয়ে ফেলেছে। এখন তারা কোনো কিছুতেই আর মজা পায় না। তাই তো তারা থ্রিল খোঁজে নেশা কিংবা অপরাধ জগতে। একই স্কুলে পড়ে কিংবা একই পাড়ায় থেকেও তারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে একজন আরেকজনকে খুন পর্যন্ত করে ফেলছে। আগে পাড়ার ভেতরের আন্তসম্পর্ক ছিল অনেকটা বৃহৎ পরিবারের মতো। অথচ আজকাল পরিবারের ভেতরেও পারিবারিক আবহের অভাব রয়েছে। বিটিভি যুগে জনপ্রিয় অনুষ্ঠানগুলো প্রচারের সময় সবাই একটি টিভির সামনে জড়ো হতো। আর এখন শত শত টিভি চ্যানেলের সাথে বাড়ির প্রতি ঘরে আলাদা আলাদা টিভি সেট যোগ হয়েছে। একই বাড়িতে বসবাস করেও আমরা দূরদ্বীপবাসীর মতো। এই দূরত্ব আরো বাড়িয়ে দিয়েছে ডিজিটাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম।

পাশের ঘরে অসুস্থ মা বিছানায় একা ছটফট করে আর আমরা স্ট্যাটাস দেই ‘মম সিক, প্রে ফর হার’। কিন্তু তার পাশে গিয়ে বসার সময় আমাদের হয় না। তবে কি আধুনিক সময়ের এত বেশি সহজলভ্য বিনোদন আমাদের অনুভূতি ভোঁতা করে দিচ্ছে? নাকি বিনোদনের ভিন্নতা আমাদের ভিন্ন ধরনের মানুষ হিসেবে বড় করছে। মাত্রাধিক্য টেলিভিশন দেখার কুপ্রভাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ‘হার্ভার্ড স্কুল অব পাবলিক হেলথ ইন্ডিকেটস’ পরিচালিত এক সাম্প্রতিক গবেষণায় যে তথ্য পাওয়া যায় তা ছিল ভয়াবহ। সমীক্ষায় দেখা যায়, তরুণদের প্রতিদিনের সময়ের একটা বড় অংশ কেড়ে নিয়েছে টেলিভিশন। ফলে বাড়ছে শারীরিক স্থূলতা ও টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি। রোড আইল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য গবেষণায় দেখা যায় যে, দীর্ঘ সময় ধরে নিয়মিত টেলিভিশন দেখার ফলে ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সুরক্ষার নিজস্ব দক্ষতা কমে যায়। আমেরিকান মোটিভেশনাল লেখক ও গবেষক সোফো আর্কন (Sofo Archon) একটি প্রবন্ধে অতিরিক্ত টেলিভিশন দেখার ক্ষতিকারক দিকগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘অধিকাংশ লোকের ঘরবাড়িতে অন্তত দুটি টিভি সেট আছে- এমন একটি সংস্কৃতিতে, অত্যধিক টেলিভিশন দেখার সম্ভাব্য ক্ষতিকর প্রভাব এড়ানো প্রায় অসম্ভব। টেলিভিশন অবশ্যই একটি বিশাল আবিষ্কার। কিন্তু যখন এটি নিয়ে ভাববেন তখন বুঝবেন তথ্য কিংবা বিনোদনের জোগান দেওয়ার সাথে সাথে এটি অবশ্যই মানুষের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।’

বর্তমানে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, টেলিভিশন যেন পরিবারের সবচেয়ে আপন সদস্য। তবে সে সদস্য সবাইকে এক না করে আলাদা আলাদা জগতে ঠেলে দিচ্ছে। পরিবারের প্রতিটি সদস্য প্রতিদিন নিজেদের মুখ দেখাদেখির সুযোগ না পেলেও টেলিভিশন নামক বোকা বাক্সের সামনে ঠিকই বসছে। তরুণ ও কিশোরদের সামাজিক জীবন গঠন এবং সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে টেলিভিশনের ভূমিকা এভাবেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। একইভাবে সাংস্কৃতিক পণ্যের অপব্যবহারের মাধ্যমে পরিবার, সমাজ, ধর্ম-  সবকিছুতেই নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।  নষ্ট হচ্ছে প্রতিভা ও সৃজনশীলতা। অথচ টেলিভিশনের এই শক্তিশালী অবস্থান পজিটিভলি ব্যবহার করতে পারলে এটি হতে পারে সমাজ গঠনের হাতিয়ার। উন্নত দেশগুলোতে টেলিভিশন ইতিমধ্যেই শিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। আমাদের দেশে কীভাবে এই শক্তিশালী মাধ্যমটিকে কাজে লাগাবেন ভেবে দেখুন, নিজেকে প্রশ্ন করুন। উত্তর খুঁজে দেখতে হবে, বের করতে হবে সমাধানও।


লেখক: মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

 


রাইজিংবিডি/ঢাকা/৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/এএন/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়