ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ডায়াবেটিস সম্পর্কে ভুল ধারণা

এস এম গল্প ইকবাল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৫৭, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ডায়াবেটিস সম্পর্কে ভুল ধারণা

প্রতীকী ছবি

এস এম গল্প ইকবাল : ডায়াবেটিস একটি বহুমূত্র রোগ, কিন্তু তাই বলে ঘনঘন মূত্রত্যাগই ডায়াবেটিসের একমাত্র উপসর্গ নয়। ডায়াবেটিসের আরো কিছু উপসর্গ রয়েছে যা কারো মধ্যে প্রকাশ পেলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে ডায়াবেটিস পরীক্ষা করা উচিৎ, যেমন- দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাওয়া ও খুব ক্লান্তি লাগা।

ডায়াবেটিস সম্পর্কে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। একজন স্বাস্থ্য সচেতন মানুষের অবশ্যই যেকোনো স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়ে সঠিক জ্ঞান থাকা উচিৎ। ডায়াবেটিস সম্পর্কে ভুল ধারণা নিয়ে তিন পর্বের প্রতিবেদনের আজ থাকছে প্রথম পর্ব।

* ভুল ধারণা: চিনি খেলে ডায়াবেটিস হয়
সত্য : চিনি সেভাবে ডায়াবেটিস সৃষ্টি করে না যেভাবে সিগারেট ক্যানসার সৃষ্টি করে, কিন্তু চিনি পরোক্ষ ভূমিকা পালন করতে পারে এবং চিনি সীমিত করা একটি সাধারণ কমন সেন্সের বিষয়। একটি বিষয় হচ্ছে, বেশি চিনি স্থূলতা সৃষ্টি করতে পারে এবং স্থূলতা হচ্ছে টাইপ ২ ডায়াবেটিসের একটি রিস্ক ফ্যাক্টর, বলেন আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশনের অন্তর্গত হেলথ কেয়ার অ্যান্ড এডুকেশনের সভাপতি ডেভিড জি মারিরো। কিন্তু ওজন বৃদ্ধি ছাড়াও গবেষণা সাজেস্ট করছে যে, চিনিযুক্ত পানীয় ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বৃদ্ধি করতে পারে। ২০১৫ সালে বিএমজে জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা অনুসারে, প্রতিদিন একবার চিনিযুক্ত পানীয় পান টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি ১৮ শতাংশ বৃদ্ধি করে। জেএএমএ’র গবেষণায় পাওয়া গেছে, চিনিযুক্ত পানীয় পান নারীদের মধ্যে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি পুরুষের তুলনায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি করতে পারে। প্রিভেনশন অনুসারে, এসব দ্রুত শোষিত চিনি অগ্ন্যাশয়ে ইনসুলিন নিঃসরণকারী কোষকে ড্যামেজ করতে পারে। প্যাকেটজাত খাবারে চিনি গোপন থাকে, তাই আপনি সম্ভবত আপনার ধারণার চেয়েও বেশি চিনি খাচ্ছেন। পুষ্টির লেবেল ভালোভাবে দেখুন এবং উচ্চ প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলুন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গড় প্রাপ্তবয়স্ককে দৈনিক ছয় চা-চামচের (অথবা ২৪ গ্রাম) বেশি চিনি খেতে অনুৎসাহিত করছে।

* ভুল ধারণা: পাতলা মানুষের টাইপ ২ ডায়াবেটিস হয় না
সত্য : ৮৫ শতাংশ টাইপ ২ ডায়াবেটিস হয়ে থাকে অতিরিক্ত ওজন বা স্থূল লোকদের, তার মানে হচ্ছে- ১৫ শতাংশ টাইপ ২ ডায়াবেটিস হয় স্বাস্থ্যসম্মত ওজন আছে এমন লোকদের, হার্ভার্ড হেলথ পাবলিকেশনে প্রকাশিত সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে। প্রকৃতপক্ষে, ২০১২ সালে জেএএমএ জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা থেকে জানা যায়, টাইপ ২ ডায়াবেটিস আছে এমন স্বাস্থ্যসম্মত ওজনের লোকদের হৃদরোগে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা টাইপ ২ ডায়াবেটিস আছে এমন অতিরিক্ত ওজনের লোকদের তুলনায় দ্বিগুণ বেশি। জিন ও ভিসেরাল ফ্যাট ভূমিকা পালন করতে পারে- পেটের অর্গানের চর্বি ইনফ্ল্যামেটরি কম্পাউন্ড উৎপাদনে প্রভাব ফেলে যা যকৃত ও অগ্ন্যাশয়কে ড্যামেজ করতে পারে এবং ইনসুলিন সেনসিটিভিটি হ্রাস করতে পারে, যার ফলে আপনি টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে থাকেন, বলেন মলিকিউলার ইমেজিং এক্সপার্ট জিমি বেল। আপনার ওজন যাই হোক না কেন, যদি আপনার বয়স ৪৫ বা তার বেশি হয়, তাহলে প্রতি তিন বছর পরপর রক্ত শর্করার মাত্রা চেক করা উচিৎ- বিশেষ করে যদি আপনার রিস্ক ফ্যাক্টর থাকে, যেমন- নিষ্ক্রিয় জীবনযাপন, ডায়াবেটিসের পারিবারিক ইতিহাস অথবা জেস্টেশনাল ডায়াবেটিসের ব্যক্তিগত ইতিহাস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও উচ্চ কোলেস্টেরল।

* ভুল ধারণা: ডায়াবেটিসের লোকদের জন্য ব্যায়াম বিপজ্জনক
সত্য : অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত শারীরিক সক্রিয়তা রক্ত শর্করার মাত্রা কমাতে সাহায্য করে এবং ডায়াবেটিস ব্যবস্থাপনা উন্নত করে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ব্যায়াম শুরু করার পূর্বে আপনার চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলুন (বিশেষ করে যদি আপনি নিষ্ক্রিয় হন) এবং চিকিৎসককে জিজ্ঞেস করুন যে ওয়ার্কআউট রুটিন হিসেবে আপনার কতবার/কখন রক্ত শর্করা টেস্ট করা উচিৎ। যদি আপনি রক্ত শর্করা হ্রাসের জন্য ওষুধ বা ইনসুলিন গ্রহণ করে থাকেন, তাহলে ব্যায়ামের ৩০ মিনিট পূর্বে আপনার রক্ত শর্করা টেস্ট করুন এবং ব্যায়ামের সময় প্রতি ৩০ মিনিটে রক্ত শর্করা চেক করে দেখুন। এটি আপনাকে নির্ণয় করতে সাহায্য করবে যে রক্ত শর্করার মাত্রা স্থির আছে নাকি বৃদ্ধি পাচ্ছে নাকি হ্রাস পাচ্ছে- নিরাপদ মাত্রায় থাকলে ব্যায়াম চালিয়ে যেতে পারেন। ব্যায়ামের পর রক্ত শর্করা ফিরিয়ে আনার প্রয়োজনে হাতের কাছে স্ন্যাক রাখা ভালো আইডিয়া। যদি আপনি দুর্বলতা বা কম্পন অনুভব করেন, তাহলে আপনার শরীর বলছে যে বিরতি নিন বা থামুন।

* ভুল ধারণা: ডায়াবেটিসের কোনো উপসর্গ নেই, শুধু চিকিৎসকই এটি শনাক্ত করতে পারে
সত্য: ডায়াবেটিসের কিছু প্রাথমিক সতর্কীকরণ লক্ষণ রয়েছে, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে- এসব লক্ষণ এতই ক্ষুদ্র যে তা প্রায়ক্ষেত্রে উপেক্ষিত বা অবহেলিত থেকে যায়। ২৫ শতাংশ ডায়াবেটিস রোগী জানে না যে তাদের ডায়াবেটিস আছে। ডায়াবেটিসের লক্ষণ হচ্ছে: পানি পান করা সত্ত্বেও ডিহাইড্রেটেড বা তৃষ্ণা অনুভব করা, সচরাচরের চেয়ে বেশি পানি পান করা, ঘনঘন মূত্রত্যাগ করতে বাথরুমে যাওয়া, ক্লান্তি বা দুর্বলতা অনুভব করা, সবসময় ক্ষুধা অনুভূত হওয়া এবং ডায়েট বা লাইফস্টাইলে পরিবর্তন ব্যতীত ওজন কমে যাওয়া। যদি আপনি এসব উপসর্গের কোনোটি লক্ষ্য করেন, তাহলে চিকিৎসক দেখানোই ভালো। রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে সহজেই ডায়াবেটিস নির্ণয় করা যায়।

* ভুল ধারণা: ডায়াবেটিস থাকলে গর্ভধারণ করা উচিৎ নয়
সত্য: ডা. মারিরো বলেন, ‘ডায়াবেটিস থাকলে লোকজন নিজেদের এবং তাদের বাচ্চার ঝুঁকি নিয়ে শঙ্কিত থাকে অথবা ডায়াবেটিসের নারীরা দুশ্চিন্তায় থাকে যে তারা গর্ভবতী হতে পারবে না, বিশেষ করে টাইপ ১ ডায়াবেটিস আছে এমন নারীরা; কিন্তু এটি এখন আর সত্য নেই।’ এই ভুল ধারণাটি তখন থেকে প্রচলিত যখন ডায়াবেটিসকে ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হতো না এবং ডায়াবেটিস ছিল দুর্বোধ্য। তবে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের কিছু জটিলতার ঝুঁকি রয়েছে, যেমন- প্রিটার্ম বার্থ বা সময়ের আগেই বাচ্চা প্রসব। কিন্তু প্রচুর নারী সঠিকভাবে রক্ত শর্করার মাত্রা মনিটরিংয়ের মাধ্যমে স্বাভাবিক গর্ভাবস্থা নিশ্চিত করেছে।

* ভুল ধারণা: সবসময় উচ্চ অথবা নিম্ন রক্ত শর্করার মাত্রা বোঝা যায়
সত্য: উচ্চ রক্ত শর্করার প্রাথমিক লক্ষণ প্রায়ক্ষেত্রে এতই হালকা যে তা উপেক্ষিত থেকে যায়। একারণে নিয়মিত রক্ত শর্করার মাত্রা টেস্ট ও নজর রাখা গুরুত্বপূর্ণ। এটি শুধু আপনাকে আপনার শরীর নিম্ন বা উচ্চ রক্ত সম্পর্কে সিগনাল দেওয়ার পূর্বেই আপনাকে সতর্ক করে না, এটি আপনাকে এটাও ধারণা দেয় যে কিভাবে আপনার ডায়েট, এক্সারসাইজ, স্ট্রেস ও অসুস্থতা রক্ত শর্করার মাত্রাকে প্রভাবিত করছে। যখন আপনি হাইপোগ্লাইসেমিক (রক্ত শর্করার মাত্রা অত্যধিক নিম্ন) হবেন, আপনি ঘেমে যাবেন অথবা কম্পন অনুভব করবেন। কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী ডায়াবেটিস প্রায়ক্ষেত্রে ‘হাইপোগ্লাইসেমিয়া আনঅ্যাওয়ারনেস’ ডেভেলপ করে- যার মানে হচ্ছে, সময় অতিবাহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনি এসব উপসর্গ অনুভব করার ক্ষমতা হারাতে থাকবেন, বলেন নিউ ইয়র্কে অবস্থিত মাউন্ট সিনাইয়ের অন্তর্গত ইকান স্কুল অব মেডিসিনের ডিপার্টমেন্ট অব এন্ডোক্রিনোলজি, ওবেসিটি অ্যান্ড মেটাবলিজমের সহকারী অধ্যাপক ডিনা অ্যাডিমুলাম। কতবার রক্ত শর্করার মাত্রা চেক করা উচিৎ তা জানতে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলুন। যদি দৃষ্টি ঝাপসা হয়, কনফিউজড বা নিদ্রালু অনুভব করেন অথবা বমি হয়, তাহলে জরুরি বিভাগে যান।

তথ্যসূত্র : রিডার্স ডাইজেস্ট

পড়ুন:




 


রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ ডিসেম্বর ২০১৮/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়