ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

ড্যাম স্কোয়্যারে এক বিকেল

শান্তা মারিয়া || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৫৬, ২০ মার্চ ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ড্যাম স্কোয়্যারে এক বিকেল

(লক্ষ্মণরেখার বাইরে: ৭ম পর্ব)

শান্তা মারিয়া: ঢাকার প্রাণকেন্দ্র কোনটি? মতিঝিল, পল্টন, নিউমার্কেট, ধানমন্ডি, গুলশান? নাকি চকবাজার? কলকাতার প্রাণকেন্দ্র কি চৌরঙ্গি? যে শহরের প্রাণকেন্দ্র নিয়ে যত বিতর্কই থাকুক, আমস্টারডামের সিটিহার্ট যে ড্যাম স্কোয়্যার তাতে সন্দেহ নেই। আমস্টারডামের পুরনো শহরের মাঝখানে বিশাল খোলা চত্বর হলো ড্যাম স্কোয়্যার। সেন্ট্রাল স্টেশনের খুব কাছেই এর অবস্থান। এর কাছাকাছি হলো রিকস মিউজিয়াম, ভ্যানগঘ মিউজিয়াম, হীরার মার্কেট, পনিরের মার্কেট ও ফুলের মার্কেট। এটি ছিল শহরের চকবাজার। এই চত্বরের পশ্চিমেই রয়েছে রাজপ্রাসাদ। ১৬৫৫ সাল থেকে ১৮০৮ সাল পর্যন্ত এই প্রাসাদ ছিল সিটি হল। পরে এটিকে রাজ পরিবারের বাসস্থানে পরিণত করা হয়। এই চত্বরসংলগ্ন হলো মাদাম তুঁশোর জাদুঘরের ডাচ শাখা। এই চত্বরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শহীদদের স্মরণে তৈরি স্মৃতিসৌধ রয়েছে। চারপাশে আরও অনেক ঐতিহাসিক স্থাপনা ও প্রাসাদ রয়েছে।

আমরা মানে আমি, পার্থ, কারেন ও তার বস এবং ছোট্ট মেয়ে মিয়া যখন ড্যাম স্কোয়্যারে পৌঁছলাম তখন বিকেল। চমৎকার বিকেল। অসাধারণ বিকেল। হেমন্তকালের পাতাঝরা বিকেল।

আমস্টেল নদীর বাঁধের সাথে তৈরি এই চত্বরের ইতিহাস বেশ পুরনো। সেই ১২৭০ সাল থেকে এখানে খোলা চত্বর গড়ে উঠেছে। শহরের বাজার, জনসভা অনেক কিছুই এখানে বসতো। আমি এই চত্বরে ঢুকে চারপাশের প্রাসাদগুলো দেখে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম এর সৌন্দর্যে। মনে হচ্ছিল মধ্যযুগের আমস্টারডামে চলে এসেছি। এখনি তীরন্দাজদের কুশলতা প্রদর্শনের খেলা শুরু হবে। কোনো বাজিগর আসবে বাজির খেলা নিয়ে। ঝুড়িতে করে ফল আর পনির বিক্রি করতে আসবে ডাচ কৃষাণীরা।

 


পর্যটকে গিজগিজ করছে এলাকাটা। ইউরোপীয়, এশীয় সবরকম পর্যটকই চোখে পড়ছে। ঐতিহ্যবাহী ডাচ পোশাক পরে বেশ ক’জন তরুণ-তরুণী ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আরও আছেন সাগরদেবতা সেজে, ও নানা রকম মুখোশে ঢাকা কয়েকজন। এরা মূলত পর্যটকদের আনন্দ দেন। একজনের গায়ে এমনভাবে রং লাগানো যে দেখলে মনে হচ্ছে উইজার্ড অফ ওজ ছবির টিনের মানুষ।

চত্বরের একটি বড় অংশে ফুলের পাপড়ি বিছিয়ে নানারকম বিচিত্র নকশা করে রাখা হয়েছে। হেমন্তকালে আশেপাশের গাছের পাতা সব লাল হয়ে আছে। ‘ওরে ভাই ফাগুন লেগেছে বনে বনে’ এই গানটি বসন্তের পরিবর্তে ইউরোপের হেমন্তে গাওয়া যায় অনায়াসে। শুধু ফাগুনের জায়গায় ‘আগুন’ শব্দটি বসিয়ে দিলেই চলে। চমৎকার মৌসুম বলে সাধারণত হেমন্তে আমস্টারডামে পর্যটকের ঢল নামে। আর সেই ঢলের একাংশ বইছে ড্যাম স্কোয়্যারে। কাছেই ডি ভ্যালেন বা রেড লাইট এরিয়া যার কথা আগেই লিখেছি। আর তার সঙ্গেই রয়েছে বার স্ট্রিট বা রেস্টুরেন্ট এলাকা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের খাবার পাওয়া যায় এই রাস্তার দু’ধারের রেস্টুরেন্টগুলোতে। সস্তা বা দামি দু’রকমই আছে। খাঁটি ডাচ খাবার আমার বেশ ভালো লেগেছিল। পনির আর বিশাল ডাচ রুটি দেখলেই রুচিকর মনে হয়। সুরিনামিজ খাবারও এ শহরে খুব চলে। সুরিনামের প্রচুর মানুষ এখানে রয়েছে। তাই পথেঘাটে সুরিনামিজ রেস্টুরেন্ট। এই খাবারও আমাদের মানে বাংলাদেশের মানুষের স্বাদের সঙ্গে যায়। বেশ মসলা দেওয়া, মজাদার ও জিভে জল আনা গোছের খাবার এগুলো।

 


ভাতও রয়েছে। ফ্রাইডরাইসের মতো খাবারও। ইন্ডিয়ান ফুড নামে মোগলাই খাবার তো আছেই। বিশ্বের সব বড় শহরের মতো এখানেও আছে মোগলাই, বিরিয়ানি আর অন্যান্য খাবার। থাই রেস্টুরেন্টে পাওয়া যাবে টম ইয়াম স্যুপ আর লবস্টার গ্রিল। দারুণ স্বাদের। ইন্দোনেশিয়ান রেস্টেুরেন্টে রয়েছে আমাদের দেশের মতো পোলাও জাতীয় খাবার, সঙ্গে মাংসের কাবাব। আবার মুসলিম রেস্টুরেন্টও রয়েছে। সেখানে মাংসের কাবাব, রুটি আর হালুয়া ধরনের মিষ্টি রয়েছে। তাছাড়া পাল্প ফিকশনের সেই বিখ্যাত ফ্রেঞ্চ ফ্রাইজ উইথ মেয়োনিজ এখানে তো আছেই, বলতে গেলে সারা শহরের প্রতিটি টুরিস্ট স্পটের কোণায় কোণায় সেগুলো পাওয়া যায়।

আমস্টারডামে গেলে ভ্যানগঘ মিউজিয়াম এবং আনা ফ্রাংক মিউজিয়াম দেখা অবশ্য কর্তব্য। আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি সে সময় আনা ফ্রাংকের ডায়েরি পড়েছিলাম। সেদিন থেকে হল্যান্ডের একটা ছবি মনের ভিতর আঁকা হয়ে গিয়েছিল। পরে বিখ্যাত চলচ্চিত্রটিও দেখেছি। তাতে আনা ফ্রাংকের ভূমিকায় অনবদ্য অভিনয় করেছিলেন মেলিসা গিলবার্ট। ঘটনাটি তো সকলেরই জানা। তবু একটু মনে করিয়ে দিচ্ছি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান থেকে হল্যান্ডে পালিয়ে আসেন ইহুদি কিশোরী আনা ফ্রাংক। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আমস্টারডামের একটি অফিস বাড়ির এক গুপ্ত প্রকোষ্ঠে তারা লুকিয়ে ছিলেন। এই বাড়িতে থাকার সময় আনা লেখেন তার বিখ্যাত ডায়েরি। সেখানে  কিশোর মনের আবেগ, অনুভূতি প্রকাশিত হয়েছে। এই লেখাই ‘ডায়েরি অফ আনা ফ্রাংক’ নামে বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের দুঃখের দলিল হয়ে ওঠে। পরবর্তিতে নাৎসি বাহিনী এই বাড়ি থেকে সবাইকে বন্দী করে নিয়ে যায়। আনা এবং তার পরিবারের সবাই বন্দীশিবিরে অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করে মৃত্যুবরণ করে। যুদ্ধশেষে একমাত্র জীবিত মুক্তি পান আনার বাবা। তিনি যুদ্ধের পর এই বাড়ির মেঝেতে আনার ডায়েরিটি খুঁজে পান। আনাদের সেই বাড়ি মিউজিয়ামে রূপান্তরিত করা হয়। এই মিউজিয়ামটি যুদ্ধবিরোধী জাদুঘর হিসেবে বিশ্বে বিখ্যাত।

 


ইউরোপের বড় শহর হিসেবে আমস্টারডামে শপিং মলের ছড়াছড়ি। আমি যখন সেদেশে যাই তখন এক ইউরো মানে একশ টাকা। তাই বেশ বুঝেশুনেই কেনাকাটা করতে হয়েছে। ব্র্যান্ড শপগুলোর দিকে তাকানো এবং ঘুরে দেখা ছাড়া কিছু কেনার প্রশ্ন অন্তত আমার পক্ষে ওঠে না। কসমেটিকস কেনা চলে। তবে আপনারা যদি কেউ যান তাহলে আর কিছু কিনুন না কিনুন অপূর্ব স্বাদের ডাচ চকলেট না কিনে ফেরা ঠিক হবে না। হ্যান্ডমেড ডাচ চকলেটও অসাধারণ স্বাদের এবং অবশ্যই খাওয়া উচিত। আমি এখনও সেই স্বর্গীয় স্বাদের চকলেটের কথা ভুলতে পারিনি।

আমস্টারডামের মেরিন মিউজিয়ামও বিখ্যাত। আর সারা শহরেই রয়েছে প্রচুর পার্ক ও খোলা চত্বর বা স্কোয়্যার। ডাচ ভাষায় বলে প্লেইন বা চত্বর। এখানে দেখা পাওয়া যায় পায়রার ঝাঁকের। বসে বসে ওদের বাকবাকুম শুনতেও মজা। পার্কের মধ্যে সবচেয়ে বড় ও বিখ্যাত হলো ফন্ডেল পার্ক। বিশাল পার্কটির একদিকে রয়েছে ওপেন এয়ার থিয়েটারের জন্য মঞ্চ। লেট অটামে পার্কের প্রাকৃতিক শোভা অপূর্ব। মনে হয় ডাচ শিল্পীর আঁকা ছবি।

আমস্টারডামের অনেকগুলো ভবন ইউনেসকোর বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার তালিকায় রয়েছে। শহরের প্রাচীন চেহারাটি যেন অমলিন থাকে সেজন্য আমস্টারডামের অনেক এলাকা সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়েছে। এই শহরে এমন কোনো স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না যা প্রাচীন চেহারাকে পাল্টে দেয়। আমস্টারডামের রেল স্টেশনটি দেখলেই একথা কতদূর সত্যি তা বোঝা যায়। দূর থেকে দেখলে স্টেশনটিকে মধ্যযুগীয় প্রাসাদ বলে মনে হয় অথচ ভিতরে চলছে আধুনিক ট্রেন। মেট্রো যেমন রয়েছে তেমনি আবার সাইকেলেও চড়ছে নগরবাসী। ঐতিহ্য আর আধুনিকতাই আমস্টারডামের মূল সুর। পাতাঝরা শরতে সেই সুরই যেন ভেসে বেড়াচ্ছিল মহানগরজুড়ে।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২০ মার্চ ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়