ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

তবুও ওঠে চাঁদ, আসে ঈদ

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৪৯, ৫ জুন ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
তবুও ওঠে চাঁদ, আসে ঈদ

রফিকুল ইসলাম মন্টু: শখ ষোলো আনা, বাজেট মাত্র চার আনা! সবদিকেই টানাটানি। সবার সব আবদার হয়তো পূরণ হয় না। ছেলের জিন্সের প্যান্ট কেনা হলে মেয়ের ফ্রক কেনার টাকায় টান পড়ে। কোনোমতে ধারদেনা করে বউয়ের শাড়ির আবদার পূরণ করা গেলেও নিজের ছেঁড়া জামা বদলানোর চিন্তাটা রাখতে হয় তালিকায় সবার শেষে। ঈদের দিনের জন্য সেমাই, গুঁড়ো চাল, চিনি, গোশত- এসব তো লাগবেই! ধারদেনা করে সেগুলো যোগাড় হয়ে যায়। এতসব টানাটানি, অনটনের ভেতর দিয়েও চাঁদরাতে উপকূলের কুড়েঘরের চৌকাঠ পেরোয় ঈদ আনন্দ। গোটা বছর যে ঘরটা অন্ধকারে ডুবে থাকে, সে ঘরটাও যেন একদিনের জন্য আলোকিত হয়ে ওঠে। নতুন জামা পাওয়ার আনন্দে ঘরের শিশুটিরও ঘুম হারিয়ে যায়। কখন ভোর হবে? কখন গোসল করে নতুন জামা পরবে? কখন বন্ধুদের সঙ্গে জমবে মিলনমেলা!

যে জনপদে বছরজুড়ে কষ্টের বোঝা, সংসারের ঘানি টানার কঠিন লড়াই- ঈদ এলে সেই সমুদ্র উপকূল জেগে ওঠে চাঁদরাতে। ঘরের সকলের কাছে ঈদের খুশি পৌঁছে দেয়ার শেষ চেষ্টা। ঈদের একদিন আগে নয়, তার আগের দিনও নয়, কিংবা সপ্তাহখানেক আগেও নয়- চাঁদরাতেই যেন মুখর হয়ে ওঠে উপকূলীয় জনপদ। গোলাখালী থেকে গোলাপাড়া, ডাংগরপাড়া থেকে আঙ্গারিয়া, ঢালচর থেকে কলাতলীর চর, সোনাতলা থেকে সোনাইমুড়ি কিংবা গজারিয়া থেকে গরুভাঙ্গা- সবখানেই ঈদের আনন্দ ছুঁয়ে যায় চাঁদরাত। কেউ ঘরে জমানো সঞ্চয় ভেঙে, কেউবা ধারদেনা করে, আবার কেউবা আগাম শ্রম বিক্রি করে ঈদের আনন্দে সামিল হতে চান।

নুরুদ্দিন মাঝি। বয়স কতোই বা- চল্লিশ। চার ছেলেমেয়ের বাপ। মাছ ধরেই জীবিকা। বছরজুড়ে কোনো না কোনোভাবে মাছের সঙ্গে সম্পৃক্ততা। কখনো মাছ ধরা, কখনো মাছের ব্যবসা। নিজের ছোট একটা ট্রলারও আছে। সুযোগ হলে আরও কয়েকজন নিয়ে ছুটে যান সমুদ্র-নদীতে মাছ ধরতে। কিন্তু এবার তো মাছ ধরা নেই! পঁয়ষট্টি দিনের নিষেধাজ্ঞার আওতায় উপকূলের জেলেরা। তাহলে এবারের রমজান আর ঈদ কীভাবে কাটছে তাদের? জিজ্ঞেস করেছিলাম ভোলার চরফ্যাসনের ঢালচরের এই নুরুদ্দিন মাঝির কাছে।
এবার আমরা ভালো নেই- জবাব দেন নুরুদ্দিন মাঝি।

কেন? পাল্টা প্রশ্ন করি।

: গত বছর এই সময় আমাদের হাতে কাজ ছিল। সমুদ্রে ট্রলার নিয়ে গেছি। মাছ পেয়েছি। ইলিশের টাকা দিয়েই ঈদ করেছি।

: এবার?

: এবার তো এই দ্বীপের ৮০ শতাংশ মানুষের হাতে টাকা নেই। তবুও তারা ঈদ করবে ধারদেনা করে। কেউ দাদন নিবে। কেউ আবার বাকিতে জিনিসপত্র কিনবে। বছরের একটা দিনই তো আমাদের ঘরে আনন্দ আসে! যে ঘরগুলো সারাবছর ঝিমিয়ে থাকে; সে ঘরে ঈদের দিন আনন্দ আসে। গরিব হলেও ছেলেমেয়ের শখ তো মেটানোর চেষ্টা করি।

নুরুদ্দিন মাঝির কথায় সুর মেলান লক্ষ্মীপুরের রামগতির চর গজারিয়ার কৃষক আবদুল হক। তিনি জানালেন, ঈদ তাদের ঘরে আসে শেষরাতে, অর্থাৎ চাঁদরাতে। এর আগে কোনোভাবেই তারা অর্থকড়ি যোগাড় করতে পারেন না। এবার ঈদের বেশ কয়েকদিন আগে থেকে সমুদ্রে মাছ ধরা বন্ধ থাকায় উপকূলের দ্বীপচরগুলো প্রায় ঝিমিয়েই রয়েছে। সে তো মাছধরা বন্ধ! কৃষকদের সমস্যা কেন? প্রশ্ন করতেই আবদুল হক বলেন, সবকিছুই নির্ভর করে মাছ ধরার ওপর। কারণ কৃষকেরাও কোনো না কোনোভাবে মাছ ধরার ওপরই নির্ভরশীল। আবার ঢালচরের আলমগীর হোসেন, লঞ্চের মাসিক বেতনের কাজ হারিয়ে যিনি এখন দিনমজুর, তার ঘরেও আলো ফুটবে ঈদের দিন। কীভাবে? প্রশ্ন করতেই আলমগীরের জবাব, আমরা গরিব মানুষ। দিন আনি দিন খাই। কিন্তু আমাদেরও সন্তান আছে। নিজেদের শখ পূরণ করতে না পারলেও আবদার তো যতটা সম্ভব মেটাতেই হয়।

কোথায় টাকা পাবেন? জানতে চাই তার কাছে।

: একটি গেরস্থ ঘর স্থানান্তরের কাজ করছি। ওখান থেকে কিছু টাকা পেলে বাচ্চাদের জন্য নতুন কাপড় কিনবো। না পেলে দোকান থেকে বাকিতে নিব।

: কয় ছেলেমেয়ে?

: তিন মেয়ে। নুপুর (৯), অন্তর (৬), চম্পা (২)।

: কী চেয়েছে ওরা?

: একজন তো ছোট। আর দুজন জামা-পাজামা, চুড়ি, ফিতা, লিপস্টিক চেয়েছে।

: ঈদের দিন আর কী করেন?

: সেমাই কিনি, গুঁড়া চাল কিনি। নাস্তা করি। পারলে গোশত কিনি। এবারও কেনার ইচ্ছা আছে।

: বউ কী চেয়েছে?

: তাকে তো শাড়ি দেই। এবার পারবো কিনা জানি না।

: নিজের জন্য কিছু কিনবেন না?

: নিজের কোনো চাহিদা নেই। গতবারের পুরানো পাঞ্জাবি দিয়েই চালিয়ে দেব। 

আবার ফিরি নুরুদ্দিন মাঝির কথায়। যত কষ্টই হোক, নিয়ম করে চার ছেলেমেয়ের জন্য প্রতি ঈদেই নতুন কাপড় কেনেন তিনি। অন্যরা ধারদেনা করলেও নুরুদ্দিন মাঝিকে ধারদেনা করতে হয়নি। ঘরের জমানো সঞ্চয় ভেঙ্গে ঈদ করবেন এবার। পাঁচ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে তার। কী কিনলেন এবারের ঈদে? প্রশ্ন করতেই নুরুদ্দিন মাঝির জবাব, চার ছেলেমেয়ের মধ্যে তিনজনের জন্য নতুন কাপড় কিনেছি। ছোটটির বয়স চারমাস বলে তাকে একটি লাল রঙের ঝুমঝুমি দিয়েই এবারের মত পার পাওয়া গেছে।

: বড় ছেলেকে কী দিলেন?

: পাঞ্জাবি, পাজামা।

: পরের মেয়েকে কী দিলেন?

: থ্রিপিস।

: পরের মেয়ের জন্য?

: তার জন্যও থ্রিপিস।

: বউয়ের কী আবদার ছিল?

: ঠিক আবদার নয়, বছরে তো শাড়ি কিনতেই হয়। সেজন্য ঈদ উপলক্ষ্যে বেগুনি-কালো রঙের একটি দেশি শাড়ি কিনে দিয়েছি।

: নিজে কী নিলেন?

: নিজের কথা তো চিন্তাই করতে পারি না। একবার পাঞ্জাবি নিলে দু’তিন বছরে আর নেয়া হয় না। গত বছর ঈদে একটি লুঙ্গি আর একটি পাঞ্জাবি নিয়েছিলাম। এবারের ঈদে আমি কিছুই নিতে পারছি না।
 


উপকূলীয় দ্বীপ-চরের এইসব মানুষেরা খুবই বিপন্ন। সারা বছরই টানাটানির সংসার। তবুও বছরের একটি দিন সাধ্যমত ঘর আলোকিত করার চেষ্টা করেন তারা। কলকারখানার চাকার শব্দ তাদের নেই। নেই শহুরে কোলাহল, মুখরতা। নেই ব্যাংক একাউন্ট। জমানো টাকা থাকে স্ত্রীর স্যুটকেসের নিচে কাগজের তলায়, কিংবা মহাজনের সিন্দুকে। বিলাসবহুল শপিং মল, বিউটি পার্লার এদের নেই। সৌর বাতির টিপটিপে আলোর নিচে টেইলারিং মেশিনের ঘটর ঘটর শব্দে তৈরি হয় এদের অতি শখের নতুন কাপড়। কেউবা কিনে নেন অতি সাদামাটা গার্মেন্টস দোকান থেকে। নতুন জামা কাপড়ের চেয়েও আলতা, স্নো, লিপস্টিক, মেহেদি, সুবাসিত তেল, সাবান- এইসব ঘরের শিশুদের কাছে ঈদের দিন নিয়ে আসে অন্যরকম আনন্দ অনুভূতি। পাড়ার যে বড় আপু একটু ভালো মেহেদি আঁকতে জানে, তার কাছে সব ছোট ছোট মেয়েশিশুদের ভিড় পড়ে ঈদের এক-দুদিন আগে থেকেই। প্রান্তিক জনপদের এই মানুষদের আছে মাটির গন্ধ। নতুন জামা কাপড় পরে এবাড়ি থেকে ওবাড়ি যাওয়া, গ্রামের ঈদগাহে নামাজ পড়তে যাওয়া, নামাজ শেষে কোলাকুলি- এর রেশ যেন আর কাটে না। কিন্তু দিন শেষে রাত এবং পরের দিন আরেকটি অন্যরকম দিন- তারপর ক্রমে ম্লান হয়ে পড়ে ঈদের আনন্দ।

যে মানুষেরা নদীর কিনারে বসবাস করেন। ভাঙনের সঙ্গে ঘর বদলান। আবার ঘর ভাঙে, আবার বদলান। জীবিকার প্রয়োজনে নদীর কিনারেই থেকে যান তারা। তাদের ঘরখানা ‘ঘর’ নয়, ‘ঝুপড়ি’ হিসাবেই চেনা সবার কাছে। তাদের কাছেও চাঁদরাত আসে অন্য বার্তা নিয়ে। পটুয়াখালীর দ্বীপ ইউনিয়ন চর মোন্তাজের একজন নাসিমা বেগমকে আমি চিনি। নুন আনতে যার পান্তা ফুরায়, তিন বেলা খাবার যোগাড়ে যিনি হিমশিম খান। তারও আছে ঈদের আয়োজন। ঈদের সকালে রান্না হবে সেমাই। চিনিগুড়া চাল, যেটাকে এই এলাকার মানুষেরা গুঁড়া চাল বলে, সেই চালও আনা হয়েছে এক কেজি, সঙ্গে চিনি, দুধ। রান্না হবে নাশতা। ঈদের নামাজে যাওয়ার আগে সারাবছর খেটে খাওয়া স্বামী আর সন্তানের সামনে নাশতার প্লেট দেয়ার ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রাখতে পারেন না নাসিমা বেগমও।

উপকূলের একজন সংগ্রামী নারী ফিরোজা বেগমকে চিনি আমি। পশ্চিম-উপকূলের সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগরের সুন্দরবন লাগোয়া কালিঞ্চি গ্রামে তার বাড়ি। স্বামী মতিয়ার গাজী পক্ষাঘাতগ্রস্থ বলে ফিরোজাকেই সারাবছর খেয়া নৌকা চালিয়ে সংসারের ভার বইতে হয়। সেই ফিরোজার ঘরেও আসবে ঈদ। চাঁদরাতে কিনেছেন সেমাই, গুড়াচাল, চিনি, প্যাকেট দুধ আর অতি প্রয়োজনীয় যা কিছু। ফিরোজা বেগমের মত উপকূলের প্রান্তিকে বসবাস করেন বহু বিপন্ন মানুষ। সারাবছর নানান উপায়ে জীবিকা চালিয়ে গেলেও ঈদটা যেন তাদের কাছে একটু বাড়তি বোঝা হয়েই আসে। তবুও অন্যদের সঙ্গে তারাও সামিল হন ঈদের আনন্দে। উপকূলের একদল ভাসমান মানুষদের আমি চিনি। সারা বছর যাদের নৌকায় বসবাস।

ঈদের দিন আপনারা কী করেন? প্রশ্ন রাখি ভাসমান জনগোষ্ঠীর মানুষদের কাছে।

: কিনারেই থাকি। নদীতে মাছ ধরতে যাই না। বাচ্চারা নদীর পাড়ের রাস্তায় উঠে খেলাধুলায় মেতে ওঠে। ওদেরও সেদিন আর কোনো কাজ থাকে না।

: নৌকায় কী রান্না হয়?

: সবাই ঈদের দিন যা করে, আমরাও সাধ্যমত করি। সেমাই, পারলে বাজার থেকে গোশত কিনি। সকলে মিলে একদিন ভালো খাই।

: বাচ্চাদের নতুন কাপড় দেন?

: যতটা সম্ভব চেষ্টা করি। বাইরের লোকজনও কিছু দেয়। এই দিয়ে চলে যায়।      

বিপন্ন মানুষের ঘরে ঈদের আনন্দ ফেরাতে চাঁদরাতে জেগে রয় উপকূলের হাটবাজার। উপজেলা সদরের প্রধান হাট, দ্বীপের ছোট্ট বাজার, গঞ্জের দোকানপাট- সবার ব্যস্ততা যেন বেড়ে যায় এক রাতের জন্য। সৌর বাতির আলো মিলায় ভোরের আলোয়। প্রয়োজনীয় সবটুকু নিয়ে অবশেষে বাড়ি পথে হাঁটা দেন হাঁটুরেরা। টেইলারিং দোকানে শেষ সেলাইয়ের শব্দ, কসমেটিকসের দোকানে ভিড় ঠেলে ঢোকার চেষ্টায় আরও কয়েকজন। লুঙ্গি, শাড়ি, পাঞ্চাবির দোকানেও ঠাসা ভির। চিনি, সেমাই, দুধ, গুড়াচালের দোকানের ভিড়ও কমে না। ভোলার মদনপুর চরের পাটোয়ারি বাজার, মনুপরার হাজীরহাট বাজার, ঢালচরের সালাম হাওলাদার বাজার, হাতিয়ার ওছখালী বাজার, সুবর্ণচরের খাসেরহাট বাজার, উড়িরচরের কলোনীবাজারসহ আরও বহু গঞ্জের ব্যস্ততা মিলিত হয় ঈদ আনন্দে। কিন্তু সেই আনন্দ মিলিয়ে যেতে সময় লাগে না। কারণ বাস্তবতা বড় নির্মম।





রাইজিংবিডি/ঢাকা/৫ জুন ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়