ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

তুলনারহিত পথপ্রদর্শক

শাহনেওয়াজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:৪৪, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
তুলনারহিত পথপ্রদর্শক

সৈয়দ শামসুল হক (২৭ ডিসেম্বর ১৯৩৫ - ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬)

খান মো. শাহনেওয়াজ : তার পরিচয়, তিনি সব্যসাচী লেখক। বাংলা সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে উজ্জ্বল তারকার মতই জ্যোতি ছড়িয়েছেন, মেধা, মনন ও সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। তার দৃপ্ত পদচারনায় বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য উচ্চ মাত্রা পেয়েছে। তিনি লিখেছেন কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, গান, কাব্যনাট্য, কথাকাব্য, এমনকি সিনেমার কাহিনী, চিত্রনাট্য ও সংলাপ। শিশু সাহিত্য ও অনুবাদ গ্রন্থও রচনা করেছেন। তার লেখায় উঠে এসেছে এদেশের মধ্যবিত্ত সমাজের চিত্র, তাদের চলাফেরা, আবেগ ও অনুভূতি।

তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল সৈয়দ শামসুল হক। খুব সহজ কথায়, স্বচ্ছ ও সাবলীল ভাষায় তিনি রচনা করেছেন সাহিত্য। উপন্যাস, নাটক, কবিতা, গান, চিত্রনাট্য ও কাব্যনাট্য প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছেন। সাহিত্যে তার সরল ভাষার প্রয়োগ তাকে এক উচ্চ আসনে আসীন করেছে। তার রচনা যেমন বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে তেমনি পরবর্তী প্রজন্মের লেখকদের ওপর প্রভাব ফেলেছে। তিনি সাহিত্যচর্চায় করেছেন শেকড়ের সন্ধান। তার জন্মস্থান, নিজের এলাকা, এই বাংলাদেশ ও দেশের মানুষের কথা তুলে ধরেছেন কর্মের মাঝে। নাড়ির টান ছিড়ে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেননি। লেখায় ফুটিয়ে তুলেছেন সমসাময়িক বাংলাদেশের চিত্র।

তার কাব্যনাট্য 'নুরলদিনের সারাজীবন' এবং 'পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়' তাকে অমর করে দিয়েছে। নুরলদিনের সারাজীবন কাব্যনাট্যে তিনি লিখেছেন -

অতি অকস্মাৎ
স্তব্ধতার দেহ ছিঁড়ে কোন ধ্বনি? কোন শব্দ? কিসের প্রপাত?
গোল হয়ে আসুন সকলে,
ঘন হয়ে আসুন সকলে,
আমার মিনতি আজ স্থির হয়ে বসুন সকলে।
অতীত হঠাৎ হাতে হানা দেয় মরা আঙিনায়।

নূরলদীনের বাড়ি রংপুরে যে ছিল,
রংপুরে নূরলদীন একদিন ডাক দিয়েছিল ...

১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর কুড়িগ্রাম জেলায় জন্মগ্রহণ করেন সৈয়দ শামসুল হক। তার বাবার নাম সৈয়দ সিদ্দিক হুসাইন ও মায়ের নাম হালিমা খাতুন। বাবা ছিলেন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক আর মা ছিলেন গৃহীনি। আট ভাইবোনের মধ্যে সৈয়দ শামসুল হক ছিলেন সবার বড়। তার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়েছিলো কুড়িগ্রামে একটি আপগ্রেড স্কুলে। এই স্কুলে তিনি ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। পরে তার বাবা তাকে কুড়িগ্রাম হাই ইংলিশ স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন।  এই স্কুল থেকে তিনি ১৯৫০ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন এবং গণিত বিষয়ে লেটার মার্কস নিয়ে উত্তীর্ণ হন।

ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার পর তিনি একের পর এক কবিতা লিখতে শুরু করেন। এ সময় তিনি ছোটগল্পও লেখেন। তার লেখা গল্প প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৫১ সালের মে মাসে ‘অগত্যা’ পত্রিকায়। এ বছরই তিনি বোম্বে চলে যান। সেখানে একটি চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠানে সহকারী হিসেবে প্রায় এক বছর কাজ করেন। ১৯৫২ সালে তিনি ঢাকায় আসেন এবং তৎকালীন জগন্নাথ কলেজে (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) আইএ ক্লাসে ভর্তি হন। আইএ পাশ করার পর ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়ে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১৯৫৬ সালে স্নাতক পড়া ছেড়ে দেন এবং সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন। এর কিছুদিন পর ‘দেয়ালের দেশ’ নামে তার লেখা উপন্যাস পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ।

এক পর্যায়ে তিনি সিনেমার চিত্রনাট্য লেখা শুরু করেন। ১৯৫৯ সালে লেখেন ‘মাটির পাহাড়’ সিনেমার চিত্রনাট্য। তিনি বেশকিছু সিনেমার কাহিনী, চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখেছেন। তার চিত্রনাট্যে নির্মিত প্রায় সব ছবিই সুপার হিট হয়েছে। তিনি সেরা চিত্রনাট্যকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পেয়েছেন। ১৯৬৬ সালে পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার। তিনি স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি পুরস্কারও লাভ করেন।

সাহিত্যের সব শাখায় দৃঢ় পদভারে সমানভাবে বিচরণ করেছেন তিনি। তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা দুই শতাধিক। বাংলা সাহিত্যের সব শাখায় বিচরণের জন্য সব্যসাচী লেখক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। কবিতায় তিনি যুক্ত করেছেন নতুন ধারা। ১৯৭০ সালে ‘বৈশাখে রচিত পঙক্তিমালা’ শিরোনামে তার রচিত কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় । এটি দীর্ঘ কবিতা এবং সে সময় এই কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি আদমজী পুরস্কার লাভ করেন। তিনি আঞ্চলিক ভাষাকেও উপস্থাপন করেছেন তার কবিতায়।

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি মনোরোগের চিকিৎসক ও লেখক আনোয়ারা সৈয়দ হকের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। আনোয়ারা সৈয়দ হকও একজন প্রতিথযশা লেখক। এই দম্পতির এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে।

একজন সাহিত্যিক হিসেবে সৈয়দ শামসুল হক পরবর্তী প্রজন্মের লেখকদের জন্য পথ প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন। তার দেখাদেখি পরবর্তী সময়ে অনেকেই তাদের কবিতায় আঞ্চলিক ভাষাকে টেনে এনেছেন যা বাংলা সাহিত্যকে আরো একধাপ সমৃদ্ধ করেছে।

এই সব্যসাচী লেখক ২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর (বাংলা ১২ আশ্বিন ১৪২৩ সন) পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চিরতরে চলে গেছেন। বাংলা সাহিত্যে তিনি যে অবদান রেখে গেছেন তা তুলনারহিত। তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন চিরকাল।





রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়