ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

থিয়েন আনমেন স্কোয়ার এবং চেয়ারম্যান মাও-এর সমাধিতে

শান্তা মারিয়া || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:২৮, ২ ডিসেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
থিয়েন আনমেন স্কোয়ার এবং চেয়ারম্যান মাও-এর সমাধিতে

(চকবাজার টু চায়না : পর্ব-২৩)

শান্তা মারিয়া : বেইজিংয়ের একটি জায়গায় গেলে একসঙ্গে অনেকগুলো মহান ও অবাক করা স্থান ও স্থাপনা আপনি দেখতে পাবেন। জায়গাটি হলো থিয়েন আনমেন স্কোয়ার। এখানে রয়েছে গ্রেট হল অব পিপল, চীনের জাতীয় জাদুঘর, মনুমেন্ট অব পিপল’স হিরোস, মহান নেতা মাও সে তুং-এর সমাধি ও মমি। এই স্কোয়ারের উল্টো দিকেই রয়েছে ফরবিডেন সিটি বা প্যালেস মিউজিয়ামের প্রবেশ তোরণ। আর থিয়েন আনমেনের সঙ্গের মহাসড়কটিও বিখ্যাত। নাম চাংআন এভিনিউ। এটি কোনো শহরের মধ্যে চলে যাওয়া দীর্ঘতম সড়ক। থিয়েন আনমেন স্কোয়ার হলো বিশ্বের বৃহত্তম দশটি খোলা চত্বরের (শহরের মধ্যে খোলা চত্বর) অন্যতম।

 

এই চত্বর বেইজিংয়ের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে। প্রতিদিন বিকেলবেলা এখানে প্রচুর লোকের সমাগম হয়। পর্যটকই বেশি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন জাতির লোকের পাশাপাশি রয়েছে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা চীনা নাগরিক। সব মিলিয়ে এখানে সবসময়ই বৈশাখি মেলার ভিড়। চত্বরে অনেক স্তম্ভ আর ভাস্কর্য তো রয়েছেই এছাড়াও রয়েছে জাতীয় বীরদের বিশাল এক ভাস্কর্য। আর চত্বরে বিশাল পর্দায় সারাক্ষণ অনুষ্ঠান চলছে। চীনের ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভূ-প্রকৃতি আর বিভিন্ন জাতিসত্তার সাংস্কৃতিক পরিবেশনা চলছে পর্দায়।

 

থিয়েন আনমেন স্কোয়ারে অনেকবার গেছি কিন্তু চেয়ারম্যান মাও সে তুং-এর সমাধিতে যাওয়া হয়নি। তাই গ্রীষ্মের এক সকালে ভাবলাম এই সমাধিতে যেতে হবে। যাবার অবশ্য অনেক ঝক্কি। খুব সকালে গিয়ে দীর্ঘ লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হবে। বেলা এগারোটার পর আর দেখা যাবে না। যাই হোক একদিন খুব সকালে গিয়ে দাঁড়ালাম লাইনে। এখানে কোনো টিকেট কাটার ব্যাপার নেই। মহান নেতার সঙ্গে সব দেশের সব জনগণই দেখা করতে পারে বিনা পয়সায়। তবে সঙ্গে ক্যামেরা, মোবাইল ফোন, ব্যাগ কিচ্ছু নেওয়া চলবে না। একবারে ঝাড়া হাত-পা হয়েই দাঁড়ালাম লাইনে। বেশ ধীরে ধীরে লাইন ধরে সমাধির গেটে পৌঁছে গেলাম। এখানে কয়েক দফা নিরাপত্তা চেকিংয়ের পর ঢুকতে পারলাম মূল সমাধি ভবনে।

 

ভবনের প্রথম কক্ষটিতেই মাও সে তুংয়ের বিশাল ভাস্কর্য। চেয়ারে বসে আছেন মহান নেতা। করুণ সুর বাজছে। ভবনে প্রবেশের পর আর কোনো কথা বলা চলবে না। মাথায় টুপিও রাখা চলবে না। তাই সবাই নীরবে নেতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানিয়ে ঢুকছে প্রধান কক্ষে। এখানে আবছা অন্ধকার। ঘরের মাঝখানে ক্রিস্টাল কফিনে শুয়ে আছেন মাও সে তুং। পুরো কফিনটি বিশাল এক কাঁচের ঘরের ভিতর। উপর থেকে স্পট লাইট পড়েছে নেতার কফিনের ওপর। মাও সে তুংয়ের মমি করা দেহ দেখলে মনে হয় একজন জীবন্ত মানুষ ঘুমিয়ে আছেন বুকের ওপর হাত রেখে। ফর্মাল পোশাক তার পরনে। কাচের ঘরটির সামনে দিয়ে নীরবে হেঁটে যেতে হবে। থামা চলবে না। কোনো কথাও বলা চলবে না। খুবই ভাব গাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশ। নেতাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বেরিয়ে এলাম সমাধিভবন থেকে দিনের আলোয়। মনে হলো যেন মহান বিপ্লবী মাও সে তুংয়ের সঙ্গেই দেখা হলো। নেতার মরদেহের এই মমি সত্যিই খুব বিস্ময়কর। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো মমির চেহারা এমন অবিকৃত কীভাবে রাখা সম্ভব হলো। অবশ্য চীনাদের দ্বারা সবই সম্ভব। কথায় আছে না, হুজুগে বাঙালি আর হেকমতে চীন।

 

 

থিয়েন আনমেন স্কোয়ারে অবশ্য আরও অনেক দেখার বস্তু আছে। চীনের জাতীয় জাদুঘরের কথাই ধরা যাক। এটি আয়তনের দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় জাদুঘর। কোনো টিকেট লাগে না। তবে পাসপোর্ট বা আইডি কার্ড সাথে থাকতে হবে। জাদুঘরেও গেলাম একদিন। সকালে গিয়ে বিকেলে বের হলাম।দশ ভাগের একভাগ জিনিসও দেখে শেষ করতে পারিনি। চীনের পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাস আর ঐতিহ্যের স্মারক রয়েছে এখানে। আরও আছে ত্রিশ লক্ষ বছর আগের আদিম মানব বা পিকিং ম্যানের ফসিল। ইলাহি কারবার যাকে বলে।

 

ইতিহাস আর মিথোলজি আমার প্রিয় বিষয়। চীনের এই জাদুঘর হলো তার হীরক খনি। কত যে স্মারক বস্তু, আর কত যে বিস্ময়কর জিনিসপত্র এখানে রয়েছে তা আর বলে শেষ করা যাবে না। তবে জীবনে একবারের জন্য হলেও বেইজিংয়ের এই জাদুঘরে যাওয়া দরকার।

 

থিয়েন আনমেনে অবস্থিত গ্রেট হল অব পিপলও আরেক বিস্ময়কর স্থাপনা। ১৯৫৯ সালে এই ভবন তৈরি। এখানে চীনের কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। একে বলা হয় দুই অধিবেশন। ১৮ লাখ ৪৯ হাজার ২৩৯ বর্গফিট ফ্লোর স্পেস আছে এই ভবনে। বিশাল এই ভবন তৈরি হয়েছিল মাত্র দশ মাসে, বিপ্লবের দশম বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে। পুরো স্থাপনাটি তৈরি হয়েছে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে। দশমাসে চব্বিশ ঘণ্টা শ্রমিকরা পালা করে কাজ করেছে । এক সেকেন্ডের জন্য কাজ বন্ধ থাকেনি। এই হলের ভেতরে কারুকার্য দেখলে চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়।

 

ডাইনিং হলে দশ হাজার মানুষ একসাথে বসে খেতে পারে। আর প্রধান কংগ্রেস হল অতি বিশাল। পুরো হলের ছাদ যেন আকাশের তারা আর চাঁদ শোভিত।

 

 

থিয়েন আনমেন স্কোয়ারের ইতিহাসও অতি প্রাচীন। ১৪১৫ সালে মিং রাজবংশের সময় প্রথম এখানে স্বর্গীয় তোরণ তৈরি করা হয়। তার পর ধীরে ধীরে রাজপ্রাসাদ মানে ফরবিডেন সিটির সংলগ্ন এই খোলা চত্বরে কুচকাওয়াজ ও জমায়েত অনুষ্ঠিত হতে থাকে। তৈরি হতে থাকে অন্যান্য স্থাপনা স্তম্ভ ভাস্কর্য ইত্যাদি।

 

এখনও পহেলা মে-তে এখানে কুচকাওয়াজ হয়। চীনের জাতীয় দিবসে এখানে নানা রকম অনুষ্ঠান হয়। পশ্চিমা গণমাধ্যমে থিয়েন আনমেনের পরিচিতি অবশ্য আরেকটি কারণে। ১৯৮৯ সালে এখানে ছাত্র বিক্ষোভ হয়েছিল। গণতন্ত্রের দাবিতে প্রচুরসংখ্যক চীনা তরুণ-তরুণী এখানে বিক্ষোভ করে এবং তাদের খুব কঠোরভাবে দমন করা হয়। এ ঘটনায় অনেকে প্রাণ হারান।

 

আমি অনেক বিকেলে চলে যেতাম থিয়েন আনমেন স্কোয়ারে। থিয়েন আনমেন মানে হলো স্বর্গীয় শান্তির দ্বার। এখানে একসময় চীনের তোরণ ছিল। সেটা সরিয়ে ওই জায়গাতেই মাও সে তুংয়ের সামধি ভবন স্থাপন করা হয়েছে। এই চত্বরে আমি বসে থাকতাম। আকাশটাকে অনেক বড় ও উদার বলে মনে হতো। এখানে প্রচুর বিদেশির আনাগোনা। পর্যটক হিসেবে আরকি। তবে এত বিদেশির ভিড়েও কপালে টিপ পরা কাউকে তেমন চোখে পড়তো না। হয়ত সে কারণেই চীনাদের অনেকে আমার সঙ্গে ছবি তুলতো খুব উৎসাহ নিয়ে। আমার খুব ভালো লাগতো ভাঙা ভাঙা চীনা ও ইংরেজি মিশিয়ে ওদের সঙ্গে আালাপ করতে। মনে হতো বেইজিংয়ের সত্যিকার হৃদস্পন্দন অনুভব করা যায থিয়েন আনমেন স্কোয়ারের উদার প্রান্তরে দাঁড়িয়ে।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২ ডিসেম্বর ২০১৬/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়