ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

দীপনের স্বপ্ন নিয়ে দীপনপুর

ছাইফুল ইসলাম মাছুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৪৬, ২০ জুলাই ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দীপনের স্বপ্ন নিয়ে দীপনপুর

ছাইফুল ইসলাম মাছুম: কত রাজ্য আছে দুনিয়াজুড়ে। একটি রাজ্যের নাম দীপনপুর। কি আছে দীপনপুরে? প্রায় পুরোটা জুড়েই বই। বইয়ের রাজ্য দীপনপুর।

বাংলাদেশের সব স্বনামধন্য প্রকাশনীর উল্লেখযোগ্য বইয়ের সমাহার থেকে আপনার পছন্দের বইটি কিনতে পারবেন এখান থেকে। এক পেয়ালা চা বা কফির সাথে বইটি বসে পড়তেও পারবেন এখানে। প্রয়োজনীয় বইটি খুঁজে না পেলে অর্ডার দিয়ে যাবেন, যথা সময়ে আপানার ঠিকানায় পৌঁছে দেবে দীপনপুরের কর্মীরা। অনলাইনেও অর্ডারের সুবিধা আছে। নতুন বইয়ের পাশাপাশি পুরনো বইয়ের মজুদও আছে দীপনপুরে। পাবেন নতুন চিত্রশিল্পীদের আঁকা ক্যানভাস। সব মিলিয়ে এটি হয়ে উঠতে পারে স্বপ্নময় এক বুকশপ।

 


‘মানুষ এখানে এসে যেমন আড্ডা দিতে পারবে, তেমন কফি পান করতে করতে বইও পড়তে পারবে। পাশাপাশি জানতে পারবে দীপন সম্পর্কেও।’ জানালেন দীপনপুরের প্রধান সমন্বয়ক ফয়সল আরেফিন দীপনের স্ত্রী রাজিয়া রহমান জলি। তিনি বলেন, ‘দীপনের কয়েকজন বন্ধু এবং আমার কয়েকজন বন্ধু মিলে দীপনের স্বপ্নটাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছি। তারই একটি উদ্যোগ হচ্ছে দীপনপুর।’

রাজধানীর কাটাবনে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রায় ২,৮০০ বর্গফুটের দীপনপুরে গ্রাহকের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে পুরোটা সিসি ক্যামেরার আওতায় রাখা হয়েছে। গ্রাহকের জন্য রাখা হয়েছে ওয়াই-ফাই সুবিধা।

শিশু কর্ণার দীপান্তর: বইয়ের রাজ্যে এ কর্ণারজুড়ে থাকবে শিশুতোষ বই। তেপান্তরের মাঠের মতো সবুজ ঘাসে ছাওয়া এই কর্ণারে শিশুরা বসে বই পড়বে, ইচ্ছে হলে বইয়ের পাতায় রং করবে। হৈ হুল্লোড় করে বই পড়ার আনন্দ নেবে। দীপনপুরের এ কর্ণারের নাম ‘দীপান্তর’। অন্তরে দীপনপুরের সুখস্মৃতি নিয়ে শিশুরা বড় হবে, আলোকিত মানুষ হবে- এ ভাবনা থেকেই এই উদ্যোগ।

 


এক টুকরো মঞ্চ দীপনতলা: দীপনপুরে ছোট একটি মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘দীপনতলা’। ছোট পরিসরে জনা তিরিশেক মানুষের উপস্থিতি নিয়ে এখানে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যাবে। যে কেউ চাইলে ভাড়া নিতে পারবে দীপনতলা। সাহিত্য আড্ডা, প্রকাশনা উৎসব, আলোচনা সভা, কবিতা পাঠের আসরের জন্য এই ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
সাপ্তাহে শুক্র, শনি দুই দিন এখানে বসবে শিশুদের জন্য ছবি আঁকার স্কুল। আয়োজন হতে পারে শিশুদের জন্য গল্প বলার আসর এবং বরেণ্য ব্যক্তিদের সাথে শিশুদের মতবিনিময় সভা।

আড্ডায় জমে উঠুক ক্যাফে দীপাঞ্জলি: বই পড়ার আনন্দের সাথে রসনাবিলাসজুড়ে দিতে দীপনপুরের অন্যতম অংশ ক্যাফে দীপাঞ্জলি। বই পড়া, গল্প-আড্ডা সাথে থাকবে চা-কফি, জুস কিংবা হালকা খাবার। থাকবে ছোটদের জন্য বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা। রাজিয়া রহমান জলি বলেন, ‘আমি নিজে চিকিৎসক, ক্যাফেতে স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে। আমাদের সাথে যুক্ত রয়েছে বিগ-ব্যাং এগ্রো ফার্ম এবং মিট-মনস্টার গ্রুপ। সুতরাং দীপনপুরে এলে আপনি পাবেন নিজস্ব ফার্মে উৎপাদিত মানসম্পন্ন দুধ-ঘি-মধুসহ আরো বিভিন্ন প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী।

সিনিয়র সিটিজেন কর্ণার: শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পুরো জায়গাটিতে বয়স্ক ব্যক্তিরা একটু নিরিবিলি পড়তে চাইলে তাদের জন্য আছে সিনিয়র সিটিজেন কর্ণার। সাথে রয়েছে দুটি প্রার্থনা কক্ষ। রাজিয়া রহমান জলি রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘যেভাবে দীপনকে হত্যা করা হয়েছিল, সেভাবে তো দীপনের জন্য কেউ কিছু করে দেবে না। দীপনের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে দীপন স্মৃতি সংসদ থেকে আমরা দাবি করেছিলাম শাহবাগ থেকে কাঁটাবন পর্যন্ত সড়কের নাম ‘দীপন স্মরণী’ করা হোক এবং ২১ অক্টোবর জাতীয় প্রকাশনা দিবস করা হোক। দাবি বাস্তবায়নে আমরা কারো সাড়া পাইনি। আমার সন্তানেরা হয়তো তাদের বাবার হত্যার বিচার পাবে না। দীপনপুরের মধ্য দিয়ে আমরা দীপনের স্বপ্নটা বাঁচিয়ে রাখতে চেষ্টা করব। আগামী প্রজন্ম যেন জানতে পারে তার কথা, তার আত্মত্যাগের কথা।’


 

আলোর পথযাত্রী দীপন: প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন। জন্ম ১২ জুলাই ১৯৭২ সালে। তিনি ছিলেন আলোকিত মানুষ, আলোর পথযাত্রী। দেশকে ভালোবাসতেন, ভালোবাসতেন বই। মানুষের মেধা ও মননের ভিত্তি তৈরিতে ভালো বইয়ের বিকল্প নেই। সেই চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে তিনি ছাত্র জীবনেই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সৃজনশীল ও মননশীল বই প্রকাশনার প্রতিষ্ঠান জাগৃতি। গত ২৫ বছর ধরে জাগৃতি সুনামের সাথে প্রায় দুই হাজার বই প্রকাশ করেছে। ৩১ অক্টোবর ২০১৫ সালে জাগৃতির কার্যালয়ে দীপনকে নৃশংসভাবে হত্যা করে অন্ধকারের অপশক্তি। দীপন বলতেন- যুক্তি খণ্ডনের চেয়ে খুন করা সহজ।

দীপনের স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতে বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ীদের সম্মলিত প্রচেষ্টা এই প্রতিষ্ঠান। গত ১২ জুলাই দীপনের ৪৫তম জন্মদিনে যাত্রা শুরু করেছে এই স্বপ্নময় বুকশপ ক্যাফে।  উদ্যোক্তারা বলছেন- আমরা চেয়েছি দীপনের স্মৃতিটুকু আমাদের মাঝে অমলিন থাকুক। দীপনপুরে আড্ডায় দীপনকে নিয়ে গল্প হোক, দীপনের প্রকাশ করা বই দীপনপুরে আলো ছড়াক। দীপনপুরে এসে শত ব্যস্ততা আর শত জটিলতা থেকে বেরিয়ে কিছুটা আনন্দময় সময় কাটুক শহরবাসীর।

গল্পকার আসমার ওসমানের ১০টি বই প্রকাশ করেছিল জাগৃতি প্রকাশনী। আসমার ওসমান রাইজিংবিডিকে বলেন, দীপন ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন। তিনি ব্যাংকার হতে পারতেন, কিন্তু ভালোবাসার জায়গা থেকে তিনি বইয়ের জগতে এসেছিলেন। তিনি তরুণদের সব সময় প্রাধান্য দিতেন। জাগৃতি প্রকাশনার জন্যই অনেকে লেখক হয়েছেন। দীপন ভাইয়ের আগ্রহ না থাকলে আমার প্রথম বই প্রকাশিত হতো না, আমি নিজেই হয়তো লেখক হয়ে উঠতে পারতাম না।

তরুণ লেখক সাজেদুল ইসলাম শুভ্র। তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, দীপন ভাইকে আমি খুব কম সময় কাছ থেকে দেখেছি। জাগৃতির এক সংকলনে আমার লেখা প্রকাশ হয়েছিল, সেই সূত্রে পরিচয়। নবীন লেখকদেরকেও তিনি যে প্রশ্রয় দিয়েছেন, সেটা অনেকেই দেন না। তার সাথে যত আবদার নিয়ে কথা বলতে পারতাম, সেই শূন্যতা পূরণ হবার নয়।

ছবি: লেখক

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২০ জুলাই ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়