ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

দুর্গাদেবীর উৎস সন্ধানে || অজয় রায়

অজয় রায় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:২৭, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দুর্গাদেবীর উৎস সন্ধানে || অজয় রায়

বাঙালি হিন্দুদের সবচাইতে বড় উৎসব প্রায় সপ্তাহব্যাপী স্থায়ী শারদীয়া দুর্গোৎসব। কলকাতার বাঙালি হলে বলতাম বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ আনন্দমুখর উৎসব। ওখানে বাঙালি বলতে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষকে বুঝতে হয়। আর অন্য সম্প্রদায় বা ধর্মের বাংলাভাষীদের বোঝাতে বাঙালি শব্দের আগে বিশেষণ জুড়ে দিতে হয়। যেমন মুসলমান বাঙালি, খ্রিস্টান বাঙালি ইত্যাদি। এখানে ঠিক বিপরীত, মুসলমান ছাড়া অন্য বাঙালি বুঝাতে ব্যবহার করি হিন্দু বাঙালি ইত্যাদি। এত দীর্ঘদিন বাঙালি বাঙালি করেও, সেক্যুলারিজম চর্চা করেও আমরা বাঙালি হতে পারলাম না। রয়েই গেলাম হিন্দু বাঙালি, বৌদ্ধ বাঙালি, মুসলমান বাঙালি আর খ্রিস্টান বাঙালি। এই মানসিকতার কারণেই স্বতঃস্ফূর্ত বাঙলা বলতে পারলেও এবং শত শত বছর ধরে বাঙলা ভাষাভাষীদের সাথে বাস করেও তথাকথিত আদিবাসীরা বাঙালি হয়ে উঠতে পারল না। আলাদা জাতিসত্তা নিয়ে সমাজ প্রগতির পেছনে থেকে বৃহত্তর সমাজে অচ্ছুৎ সম্প্রদায় হিসেবে কোনক্রমে টিকে রইল। বৃহত্তর বাঙালি সমাজে আত্মীকৃত হতে পারল না।

পুরাণে, তন্ত্রে এবং ধর্মশাস্ত্রে দুর্গার যে মূর্তিই কল্পনা করা হোক না কেন, বাঙালির চোখে আর হৃদয়ে তিনি কন্যারূপে আদৃতা। প্রতি বছরান্তে শরৎকালে কন্যা উমা কৈলাস থেকে বাংলায় আসেন পিতৃগৃহে। সাথে নিয়ে আসেন তার পুত্রকন্যাদের।
উগ্রচণ্ডা, ভগবতীর মূর্তি বিশেষ। এর অষ্টাদশ হস্ত। আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা নবমীতে কোটি-যোগিনীর সঙ্গে অষ্টাদশ-ভূজসমন্বিত দেবী প্রথমে আবির্ভূত হয়ে মহিষাসুরের প্রথম মূর্তি বিনষ্ট করেন। এই মূর্তি ধারণ করে সতী নিজের পিতা দক্ষের যজ্ঞ ধ্বংস করেছিলেন। দক্ষ-যজ্ঞে যখন পতিনিন্দা সহ্য করতে না পেরে সতী রাগে ও অপমানে দেহত্যাগ করেন, তখন শিব তাঁর সমস্ত অনুচরসহ দক্ষযজ্ঞ পূরণ করতে আসেন। দেহত্যাগ করে সতী উগ্রচণ্ডার রূপ নিয়ে কোটি যোগিনীসহ শিবের সঙ্গে মিলিত হন ও দক্ষযজ্ঞ নষ্ট করেন। (কালিকাপুরাণ)

উগ্রতারা, ভগবতীর মূর্তি ভেদ। অন্য নাম মাতঙ্গী। শুম্ভ নিশুম্ভ নামে দৈত্যদ্বয়ের উৎপাতে দেবতারা ব্যতিব্যস্ত হয়ে হিমালয়ের পাদদেশে মাতঙ্গমুনির আশ্রমে এসে ভগবতীর আরাধনা আরম্ভ করেন। আরাধনায় তুষ্ট হয়ে দেবী মাতঙ্গমুনির স্ত্রী মাতঙ্গীর রূপ ধারণ করে দেবতাদের কাছে এলেন এবং তাঁদের সরবে তুষ্ট হয়ে মুনিপত্মীর শরীর হতে এক দিব্য মূর্তি পরিগ্রহ করলেন। এই মূর্তির চার হাত ও গলায় মুক্তমালা। এই মূর্তিই উগ্রতারা। মাতঙ্গীর শরীর হতে উৎপন্ন বলে ভগবতীর এই উগ্রতারা মূর্তিকে মাতঙ্গী বলা হয়।

দুর্গা, পরমাপ্রকৃতি, বিশ্বের আদি কারণ ও শিবপত্নী। মহিষাসুর দেবতাদের স্বর্গ হতে বিতাড়িত করে স্বর্গরাজ্য লাভ করেন। দেবতারা বিপন্ন হয়ে ব্রহ্মার শরণাপন্ন হন। ব্রহ্মা শিব ও দেবতাদের সঙ্গে নিয়ে বিষ্ণুর কাছে গিয়ে তাঁদের দুর্দশার কথা বর্ণনা করেন ও তাঁদের বিপদ হতে রক্ষা করতে অনুরোধ করেন। কারণ, ব্রহ্মার বরে মহিষাসুর পুরুষের অবাধ্য হয়েছে। বিষ্ণু তখন বলেন যে, এই অসুরকে বধ করতে হলে নিজ নিজ স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হয়ে, স্ব স্ব তেজের কাছে এই প্রার্থনা করতে হবে যে, এই সমবেতভাবে উৎপন্ন তেজ হতে যেন এক নারীমূর্তি আবির্ভূত হন। এই নারীই অসুরকে বিনাশ করবেন। শুনে ব্রহ্মা, শিব, বিষ্ণু, ইন্দ্র ও অন্যান্য দেবতাদের দেহ হতে তেজ নির্গত হয় এবং এই সমবেত তেজরাশি হতে এক নারীমূর্তি আবির্ভূত হন। সকল দেবতা তাঁদের নিজ নিজ অস্ত্রসমূহ এঁকে দান করেন। এই দেবী মহিষাসুরকে তিনবার বধ করেন। প্রথম বার অষ্টাদশভুজা উগ্রচণ্ডা রূপে, দ্বিতীয়বার ও তৃতীয়বার দশভুজা দুর্গারূপে। রাত্রে ভদ্রকালীর মূর্তি স্বপ্নে দেখে মহিষাসুর এই মূর্তির আরাধনা করেছিলেন। দেবী মহিষাসুরের কাছে এলে মহিষাসুর বলেন, ‘আপনার হাতে মৃত্যুর জন্য কোন দুঃখ নেই; কিন্তু আপনার সঙ্গে আমিও যাতে সকলের পূজিত হই, তারই ব্যবস্থা করুন।” দেবী তখন বললেন, “উগ্রচণ্ডা, ভদ্রকালী ও দুর্গা.. এই তিন মূর্তিতে তুমি সব সময় আমার পদলগ্ন হয়ে দেবতা, মানুষ ও রাক্ষসদের পূজা পাবে।”  দেবী ভাগবত, মার্কণ্ডেয় চণ্ডী ও কালিকাপুরাণ)

সত্যযুগে সুরথ রাজা ও সমাধি বৈশ্য দুর্গামূর্তি প্রস্তুত করে তিন বৎসর পূজার্চনা করেছিলেন। ত্রেতাযুগে রাবণ চৈত্রমাসে বসন্তকালে এঁর পূজা করতেন। সেজন্য এই পূজা বাসন্তীপূজা নামে বিখ্যাত। রামচন্দ্র অকালে বোধন করে রাবণবধের জন্য এই পূজা করেছিলেন।
ভগবতী, মহিষমর্দিনী দুর্গার এক নাম। ইনি ব্রহ্মা, শিব, ইন্দ্র, যম, বরণ্ডণ, পৃথিবী, সূর্য, বসুগণ, কুবের, অগ্নি, বিশ্বকর্মা প্রভৃতি দেবদেবীগণের তেজসম্ভূতা। এই সব দেবদেবী অসুরবিনাশের জন্য এঁকে বিবিধ অস্ত্রশস্ত্রাদি প্রদান করেন। ভগবতী ঐ দেবদেবীগণের তেজ ধারণ করে তাঁদের অস্ত্রের সাহায্যে মহিষাসুরকে বধ করেন। ইনি প্রকৃতিস্বরূপিণী মহামায়া দেবী। লঙ্কার যুদ্ধে জয়ী হবার জন্য রাম ভগবতীর পূজা করেছিলেন। ইনি মহিষাসুর, রক্তবীজ, চণ্ডাসুর, শুম্ভ-প্রভৃতি দানবদের নিহত করেন।

ভগসূর্য, দ্বাদশ সূর্যের অন্যতম। দক্ষযজ্ঞ ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে মহাদেব যখন যাত্রা করেন তখন প্রথমে ইনি বাধা দিতে এলে মহাদেবের অঙ্গুলীর অগ্রভাগ প্রহারে এঁর নয়নযুগল বিনষ্ট হয়। (কালিকাপুরাণ)

ভাগবৎ পুরাণ, ইহা অষ্টাদশ পূরাণের অন্তর্গত। ভগবতে অধ্যায় শেষে মহাপুরাণ বলে এর উল্লেখ আছে। এই পুরাণ ব্যস-রচিত। শুকদেব ইহা পিতার নিকট শ্রবণ করেন এবং গঙ্গাতীরে ব্রহ্মশাপগ্রস্ত পরীক্ষিতের প্রার্থনায় এই ভগবত-কথা কীর্তন করেন। এই পুরাণে অসুরের পরাজয় ও মৃত্যুর বিবরণ আছে। এই পূরাণের দশম ভাগ বিশেষ মূল্যবান। এই অংশে শ্রীকৃষ্ণের বিস্তৃত ইতিহাস পাওয়া যায়।

ভগীরথ, ইনি ইক্ষাকুবংশীয় সগর-রাজার অধস্তন পঞ্চম পুরুষ। সগরের পৌত্র অংশুমান, অংশুমানের পুত্র দিলীপ, দিলীপের পুত্র ভগীরথ। দিলীপ ভগীরথের হস্তে রাজ্যশাসনের ভার দিয়ে তপস্যার জন্য হিমালয়ে গমন করেন ও দীর্ঘকাল তপস্যার পর দেহত্যাগ করেন। ভগীরথ বাল্যকালে মাংসপিণ্ড মাত্র ছিলেন। এঁর দেহাস্থি দৃঢ় না থাকায় ইতি সরলভাবে দণ্ডায়মান হতে পারতেন না। একদিন অষ্টাবক্র মুনিকে সম্মান দেখাতে গিয়ে ইনি দাঁড়াবার জন্য বৃথা চেষ্টা করেন। এঁর এই বক্র অবস্থা দেখে মুনি ভাবলেন যে, তাঁর প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শনের জন্যই ভগীরথ এরূপ ব্যবহার করেছেন। তখন অষ্টাবক্র এঁকে শাপ দিলেন, “আমাকে বিদ্রুপ করে থাকলে তুমি বিকলাঙ্গ হবে, আর তা না হলে তুমি উত্তমাঙ্গ হবে।” সেই হতে ভগীরথ সুস্থ ও উত্তমাঙ্গ হলেন। কপিলের শাপে ভস্মীভূত পিতৃপুরুষদের উদ্ধারার্থে ইনি গোকর্ণ-তীর্থে বহু বর্ষ ধরে উগ্র তপস্যা করেন। তখন ব্রহ্মা প্রীত হয়ে ভগীরথকে বর দিতে চাইলে তিনি দুটি বর প্রার্থনা করেন... (১) সন্তানের অভাবে যেন তাঁর বংশলোপ না হয়। (২) কপিলের শাপে ভস্মীভূত সগররাজের ৬০,০০০ পুত্র (ভগীরথের পিতৃপুরুষগণ) যেন গঙ্গাসলিলে সিক্ত হয়ে স্বর্গলাভ করেন। ব্রহ্মা প্রথম বর দিলেন; কিন্তু দ্বিতীয় বর সম্বন্ধে তিনি বললেন যে, হিমালয়ের কন্যা গঙ্গার পতনবেগ পৃথিবী সহ্য করতে পারবে না। একমাত্র মহাদেবই গঙ্গার পতনবেগ ধারণ করতে সক্ষম। তখন ভগীরথ পুনরায় তপস্যারত হয়ে মহাদেবকে সন্তুষ্ট করে তাঁকে গঙ্গাধারণের জন্য নিয়োজিত করেন। ভগীরথের কঠোর তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে মহাদেব গঙ্গাকে ধারণ করতে সম্মত হন। গঙ্গা অতিবেগে মহাদেবের মস্তকের ওপর পতিত হয়ে স্রোতে ভাসিয়ে তাঁকে রসাতলে নিয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু মহাদেব গঙ্গার এই অভিপ্রায় বুঝতে পেরে সহস্র বৎসর গঙ্গাকে নিজের জটার মধ্যে আবদ্ধ করে রাখলেন। গঙ্গার এই অবস্থা দেখে ভগীরথ পুনরায় মহাদেবের তপস্যা আরম্ভ করেন। তাঁর স্তবে তুষ্ট হয়ে মহাদেব গঙ্গাকে জটামণ্ডল হতে নির্গত করে দেন। তখন সপ্ত ধারায় গঙ্গা ভূতলে অবতরণ করেন। গঙ্গার তিনটি প্রবাহ পূর্ব দিকে ও তিনটি প্রবাহ পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়, আর একটি প্রবাহ ভগীরথকে অনুসরণ করে চলে। ভগীরথ এই স্রোতের পথ নির্দেশ করে দিয়েছিলেন বলে এই প্রবাহের নাম হয় ভাগীরথী। ভগীরথ দিব্যরথে আরোহন করে গঙ্গার সঙ্গে রসাতলে যান। সেখানে গঙ্গা সগর সন্তানদের ভস্মরাশির ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলে তাঁরা মুক্তি লাভ করে স্বর্গারোহণ করেন। (রামায়ণ মৎস্যপুরাণ)

ভঙ্গাস্বন নামে এক ধার্মিক রাজা পুত্র-কামনায় অগ্নিষ্টুত যজ্ঞ করে শত পুত্র লাভ করেন। এই যজ্ঞে কেবল অগ্নিকেই স্তুতি করা হয় বলে ইন্দ্র ক্রুদ্ধ হন এবং মায়াজাল বিস্তার করে এঁকে বিমোহিত করেন। রাজা বিগভ্রান্ত ও পিপাসার্ত হয়ে ঘুরতে ঘুরতে একটি সরোবর দেখতে পান। সেই সরোবরে স্নান করলে তিনি তৎক্ষণাৎ স্ত্রীরূপে রূপান্তরিত হন। তখন তিনি সেই অবস্থাতেই রাজপুরীতে ফিরে গিয়ে এর কারণ জানান ও পুত্রদের হাতে রাজ্যভার দিয়ে বনগমন করেন। স্ত্রীরূপী ভঙ্গাস্বন এক ঋষির আশ্রমে এসে বাস করতে থাকেন। সেই ঋষির ঔরসে স্ত্রীরূপী রাজার গর্ভে আবার একশত পুত্র হয়। তিনি এই একশত পুত্র নিয়ে পূর্বের একশত পুত্রের কাছে গিয়ে বললেন, “এই ভ্রাতাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে তোমরা রাজ্য ভোগ কর।” ইন্দ্র দেখলেন যে, অপকার করতে গিয়ে তিনি রাজার উপকারই করেছেন। তখন ভ্রাতাদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করবার জন্য তিনি সেই দুইশত পুত্রকে বললেন, ‘তোমরা একদল রাজণ ভঙ্গাস্বনের পুত্র, আর একদল ঋষির পুত্র, অতএব সকলের একত্রে রাজ্যভোগ অসম্ভব।” ইন্দ্রের এই কথা শুনে রাজপুত্রদের মধ্যে ভেদবুদ্ধি জন্মালো এবং তারা যুদ্ধ করে পরস্পরকে বিনষ্ট করলো। পুত্রদের মৃত্যু সংবাদে রাজা রোদন করতে আরম্ভ করলে ইন্দ্র এসে বললেন, “আমাকে আহ্বান না করে অগ্নিতুষ্ট যজ্ঞ করেছিলে বলে তোমার এইরূপ ফল হয়েছে।” তখন ইন্দ্রের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। এতে ইন্দ্র তুষ্ট হয়ে বললেন, “তুমি কোন পুত্রদের জীবন কামনা করো ... তোমার ঔরসজাত পুত্রদের, না তোমার গর্ভজাত পুত্রদের?” তখন রাজা জানালেন, তিনি স্ত্রী হয়ে যে পুত্রদের জন্ম দিয়েছেন, সেই পুত্রদেরই জীবন-কামনা করেন। এতে ইন্দ্র আশ্চর্য হলে রাজা বলেন, পুরুষ অপেক্ষা স্ত্রীর স্নেহই বেশি। এতে ইন্দ্র সন্তুষ্ট হয়ে সেই বরই দান করেন। তারপর রাজা অন্য বর প্রার্থনা করেন... তিনি স্ত্রী হয়েই থাকতে চান। কারণ, স্ত্রী-পুরুষের সঙ্গমে স্ত্রীরাই অধিক সুখী হয়। ইন্দ্র এই বরও তাঁকে দান করেন। (মহাভারত... অনুশাসন)

মহাকালী, শিব ও শক্তির সমন্বয়ে মহাশক্তির উৎপত্তি। যে শক্তির সঙ্গে মহাদেব সমদ্বিত হয়ে মহাশক্তি সৃষ্টি করেন তিনিই হচ্ছেন মহাকালী। তন্ত্রসাধকের মতে এই দেবীর পাঁচটি মুখ। প্রতি মুখে তিনটি করে নেত্র। ইনি অতীব রৌদ্রমূর্তি, দক্ষিণ ও বাম করে শক্তিশূল ধনু বাণ খড়গ খোটক বরমুদ্রা ও অভয়মুদ্রাধারিণী। ইনি সর্বালঙ্কারভূষিতা।

মহামায়া, ব্রহ্মসার দেহ হতে অর্ধ নারী মূর্তি প্রকাশ হয়। এই অর্ধ নারী মূর্তি ব্রহ্মার আদেশে নিজের দেহ ভাগ করে স্বাহা, স্বধা, মহামায়া প্রভৃতি নামে খ্যাতা হন (ব্রহ্মাণ্ডপুরান)। মহামায়া ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবের জননী। ইনি সর্বদা বিশ্বের সৃষ্টি, পালন ও সংহার করেন। ইনি জীবগণের কামনা পূরণ করেন। এই জগৎ তাতেই ও তাঁরই প্রতিষ্ঠিত ও তাতেই লয়প্রাপ্ত হয়। (দেবী ভাগবত)

মহিষমর্দিনী, দেবী দুর্গা মহিষাসুর দৈত্যকে বিনাশ করেছিলেন বলে মহিষমর্দিনী নামে খ্যাত হন। মহিষাসুরের অত্যাচারে অত্যন্ত সন্ত্রস্ত হয়ে দেবতারা বিষ্ণুর শরণাপন্ন হলে বিষ্ণু বললেন, ব্রহ্মার বরে মহিষাসুর পুরুষজাতীয় জীবের হস্তে অবধ্য। তবে দেবতাদের তেজ হতে যদি এক পরম রূপবতী নারী সৃষ্ট হয়, তবেই তিনি মহিষাসুর বধ করতে সমর্থ হবেন। দেবতাদের মিলিত প্রার্থনায় এক অপূর্ব লাবণ্যময়ী অষ্টাদশ-হস্তা নারী সৃষ্ট হলো। বিভিন্ন দেবতার তেজ হতে তাঁর বিভিন্ন অঙ্গ সৃষ্ট হলো। মহাদেব ত্রিশূল, বরণ্ডণ শঙ্খ, অগ্নি শীতগ্রীশক্তি, পবন থূণীর ও ধনু, ইন্দ্র বজ্র, যম দণ্ড, ব্রহ্মা কমস্তলু ও দেবতারা অন্যান্য অস্ত্র তাঁকে দান করলেন। মহিষাসুর এই মহাশক্তি-সম্পন্না নারীর সংবাদ পেয়ে তাঁকে তার সম্মুখে আনবার জন্যে দূত প্রেরণ করে।

অকৃতকার্য হলে সেনাপতিদের পাঠানো হলো। তারা দেবীর হস্তে নিহত হলে মহিষাসুর নিজেই দেবীর কাছে গেল। তখন দুই জনের মধ্যে ভীষণ যুদ্ধ আরম্ভ হয়। কিছুদিন যুদ্ধের পর দেবী চক্র দ্বারা মহিষাসুরের মস্তক বিচ্ছিন্ন করে তাকে নিহত করলেন। সেই থেকে দুর্গা মহিষমর্দিনী নামে খ্যাতা।  (দেবী ভাগবত)

মহিষাসুর অসুর বিশেষ। রম্ভ নামে এক অসুর মহাদেবকে তপস্যায় প্রীত করে তাঁর কাছে পুত্র প্রার্থনা করায় মহাদেব সেই বর প্রদান করেন। এই বরের প্রভাবে মহিষাসুর জন্মগ্রহণ করে। কালক্রমে এই অসুর অতি দুর্দান্ত হয়। এবং দেবতাদের বিতাড়িত করে স্বর্গরাজ্য অধিকার করে। বিতাড়িত দেবতারা বিষ্ণুর নিকট প্রতিকার প্রার্থনা করলে বিষ্ণু বলেন, ব্রহ্মার বরে মহিষাসুর পুরুষজাতীয় যেকোনো জীবের অবধ্য। সমস্ত দেবতার তেজ হতে যদি কোন পরমাসুন্দরী নারী সৃষ্ট হয় তবে তিনি মহিষাসুরকে বধ করতে সমর্থ হবেন। তখন দেবতাদের মিলিত প্রার্থনার ফলে দেবতাদের তেজ হতে এক অপূর্ব লাবণ্যময়ী অষ্টাদশ-হস্তা নারীর আবির্ভাব হয়। দেবগণ তাঁকে বিবিধ অস্ত্র দান করেন। মহিষাসুর এই দেবীকে বিবাহ করবার জন্য দূত পাঠায়। দূতকে তিরস্কৃত করে বিদায় দিলে মহিষাসুর দেবীকে শাস্তি দেবোর জন্যে সসৈন্যে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযান করেন। দেবীর সঙ্গে দীর্ঘকালব্যাপী ঘোর যুদ্ধের পর দেবীর হস্তে মহিষাসুরের নিধন ঘটে।  (দেবী ভাগবত)

মহিষাসুর তিনবার জন্মগ্রহণ করে। তিনবারই দেবী ত্রিবিধরূপ ধারণ করে তাকে বিদায় করেন। মহিষাসুরকে বধ করবার জন্য ভগবতী প্রথমে উগ্রচণ্ডী, দ্বিতীয়বারে ভদ্রকালী, তৃতীয়বারে দুর্গারূপ ধারণ করেছিলেন। বরাহপুরাণে, মার্কণ্ডেয়পুরাণে ও কালিকাপুরাণে মহিষাসুর সম্বন্ধে বিভিন্ন বিবরণ পাওয়া যায়।
রম্ভ নামে এক অসুর মহাদেবকে আরাধনায় সন্তুষ্ট করে তাঁর নিকট বর প্রার্থনা করে। মহাদেব বর দিতে চাইলে, সে বর চায়, মহাদেব যেন অজেয়, চিরায়ু এবং যশস্বী হয়ে তার পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করে। মহাদেব তা স্বীকার করে প্রস্থান করলেন। বর লাভ করে আনন্দিত মনে পথে যেতে যেতে রম্ভাসুর একটি অল্পবয়স্কা ঋতুমতী নারীকে দেখতে পেয়ে কামাতুর হয়ে তার সঙ্গে সঙ্গম করলে মহিষাসুরের জন্ম হলো। এই মহিষাসুর ঘোর মায়াবী ছিল। সে একদিন স্ত্রীরূপ ধারণ করে কাত্যায়ন মুনির শিষ্যদের তপোবিঘ্নের চেষ্টা করায় কাত্যায়ন একে অভিশাপ দেন, নারীর হস্তে সে নিহত হবে। এই মহিষাসুর দেবতা ও দানবের ওপর পূর্ণ প্রভুত্ব স্থাপন করেছিল। এই সময় সে একদিন স্বপ্ন দেখে যে ভগবতী ভদ্রকালী রূপ ধরে তার শিরচ্ছেদ করতে এসেছেন। সেই হতে মহিষাসুর দেবীর পূজা করতে আরম্ভ করে। একদিন দেবী তার কাছে আবির্ভূত হলে সে দেবীকে বলে সে যেন দেবীর সহিত সর্ব যজ্ঞে পূজিত হয় ও দেবীর পদসেবা করতে পায়। তা শুনে দেবী উত্তর করলেন, সমস্ত যজ্ঞ ভাগ দেবতাদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। তবে তুমি আমার পদসেবায় সর্বদা নিযুক্ত থাকবে এবং যেখানে আমার পূজা হবে, সেইখানেই তুমিও পূজা পাবে। (কালিকাপুরাণ)



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২২ সেপ্টেম্বর ২০১৭/সাইফ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়