ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

নায়ক

সাইফুল্লাহ সাইফ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১৩, ১১ ডিসেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নায়ক

।। সাইফুল্লাহ সাইফ ।।

লোকটি নিরীহ আবার একরোখাও। এমন পরস্পরবিরোধী দ্বৈতসত্তা যেন একটি উদাসীন শিকারী বাঘ শিকার না করে ক্ষুধার্ত থেকে থেকে কষ্টের উপলব্ধি বাড়াচ্ছে-এটিই তার নৈতিকতা। অথচ এই নির্লিপ্ততার সুযোগে বনের তৃণমূল প্রাণীরাও তাকে শাসন করতে ছাড় দেয় না। এমনকি নকল বাঘের গর্জনের অনুরণন শোনায় তাকে। যেন এসবে সে চিরকাল অভ্যস্ত। প্রকৃত অর্থেই সে একজন সাধারণ দর্শক হয়ে থাকতে চেয়েছে নিজের মতো করে।  

 

লোকটি কৃষক। মহাজনদের জমিতে বর্গা চাষি। একটুখানি জমিতে আউশ, আমন, ইরি ধান চাষ করে ফলনের অর্ধেক মালিকের গোলায় তুলে দিয়ে বাকি অংশ নিয়ে ঘরে ফেরে। ধান বেচে সারা বছরের পাওনাদারদের সব ঋণ শোধ দিয়ে বাকি টাকায় তেল নুন সদাই করে। বাকিটা সময় মুসলিমের চায়ের দোকানে বসে পান বিড়ি খায় আয়েশ করে। একা সংসারে একজনের আর কী চাই?

 

পরিবার তাকে ছেড়ে গেছে। তার বিরুদ্ধে ওদের অভিযোগের পারদ জমতে জমতে যখন সব সীমা ছাড়াল তখন থেকেই সে একা। স্ত্রী গত হয়েছে সেই একাত্তরে বাচ্চা বিয়োতে গিয়ে। যুদ্ধ থেকে ফিরে এলে প্রিয়তমার পরিবর্তে একটা ফুটফুটে বাচ্চা হাতে পায় সে। সেই ছেলেও এখন ছেলের বাপ হয়ে বউ নিয়ে শহরে থাকে। আর বড় ছেলেটা থাকে শ্বশুরবাড়ি- ঘরজামাই। আগে তার সাথেই থাকত বউ-বাচ্চা নিয়ে। কিন্তু বাবার গোয়ার্তুমির উপর ক্ষেপে গিয়ে একপর্যায়ে বাবাকে শাস্তি দিতেই স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ওখানে থাকা শুরু করে সে।

 

বাবাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছিল নিজের অধিকার আদায় নিয়ে। দেশের জন্য যুদ্ধ করেছিলেন তিনি। দেশকে দিয়েছেন, দেশও তো তাকে কিছু না কিছু দেবে। মুক্তিযোদ্ধারা সবাই সব ধরণের সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছে; এমনকি ভুয়া কাগজপত্র করেও অনেকে মুক্তিযোদ্ধা সেজে সুবিধা নিচ্ছে। তাহলে তিনি কেন নয়? তার একা সংসার চালাতে কষ্ট হয়, বাবার এই সহায়তাটুকু পেলে সে একটু দাঁড়াতে পারে। কিন্তু লোকটি কানে তোলেনি কিছুই।  তিনি মুক্তিযোদ্ধা; যুদ্ধজয়ে দেশ শত্রুমুক্ত করেছেন। এখন যদি সামান্য কয়টা টাকার কাছে বিক্রি হয়ে যান তবে কি তাঁর সেই গৌরবের কীর্তি টিকে থাকে? এ তো একরকম বিনিময় হয়ে গেল। বীরযোদ্ধারা কোথাও পরাজিত হন না। মৃত্যু যাকে পরাজিত করতে পারে না, তিনি কি সামান্য একটু সুযোগ নিতে গিয়ে নিজের আত্মমর্যাদা ক্ষুন্ন করবেন? তিনি কখনোই তা করতে পারেন না। এসব নিয়ে দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি হলে ছেলে উল্টো প্রশ্ন তোলে, আসলেই কি তিনি একাত্তরে যুদ্ধ করেছিলেন, নাকি পুরোটাই বানানো গল্প?

 

ছেলের কথার উত্তরে ক্ষেপে গিয়ে জানিয়ে দেন, তিনি মুক্তিযোদ্ধা কিনা ছেলেকে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজি নন। যে ছেলে বাবার মহান বীরত্বকে অস্বীকার করতে পারে, সে ছেলেকে তিনি স্বীকার করবেন কীভাবে? বাপ-ছেলের বাড়াবাড়ির একপর্যায়ে ছেলে বউকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে যায়। সেখানেই ঘরজামাই থাকতে শুরু করে সে। সেই থেকে লোকটি একা, একার সংসার। নিজে রোজগার করেন, নিজের মত করে খরচ করেন। কোন ঝুট-ঝামেলা নেই। ইচ্ছে হলেই অবসরে ছুটে যেতে পারেন মুসলিমের চায়ের দোকানে। টেলিভিশন দেখেন, দোকানে মানুষের দেশ ও জাতি নিয়ে বিস্তর আলোচনা শোনেন। আজকালকার মানুষগুলোকে খুব দেশ সচেতন মনে হয় তার।

 

টেলিভিশনে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ক্রিকেট ম্যাচে বাংলাদেশের দুর্দান্ত জয় দেখে তারও অসম্ভব আনন্দ হয়। মুসলিমের চায়ের দোকানে কী ভিড়টাই না জমে ওঠে তখন! লোকজন সামলানো বিরাট মুশকিল হয়ে পড়ে মুসলিমের জন্য। বাংলাদেশ যখন জয়ের বন্দরে পৌঁছে যায়, তখন প্রতিটি লোকের চোখে-মুখে জ্বলজ্বলে গর্বের আভা। সে যে কি আনন্দ! পরদিন পত্রপত্রিকা থেকে শুরু করে রেডিও, টিভি এমনকি মানুষও হয়ে ওঠে বহুল প্রচার সংবাদ মাধ্যম। সবার মুখে মুখে জয়ের স্তুতি। এই উচ্ছ্বাস, এই বাঁধভাঙ্গা আবেগ ভীষণ ভালো লাগে তার। কেউ কেউ জয়ের আনন্দে দিশেহারা হয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে গিয়ে বলে, ‘এই জয় একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের পুনোরাবৃত্তি’ বলে ফেলে।

 

তারা মাশরাফি, সাকিব, তামিমদের বীরের মর্যাদা দেওয়ার দাবি জানায়। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে যখন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলপতি মাশরাফি বলেন, ‘বীর হলেন মুক্তিযোদ্ধারা। তাঁরা জীবন দিয়েছেন। জীবন যেতে পারে জেনেও যুদ্ধে গেছেন দেশের জন্য। আমরা কী করি? পারফর্ম করি; একজন অভিনেতা, গায়কের মতোই-এর চেয়ে বেশি কিছু নয়। মুক্তিযোদ্ধারা গুলির সামনে এজন্য দাঁড়ান নাই যে জিতলে টাকা পাবেন। কার সঙ্গে কার তুলনা করি আমরা?’

 

একজন প্রকৃত নেতার এমন বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর ভালো লাগে তার ।  

 

দুই.

এলাকার সবাই তাকে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ নামে চেনে। তাদের কাছে মুক্তিযোদ্ধা মানেই মুক্তিযোদ্ধা না। কারণ তাদের চোখের সামনে এমন অনেক নাম আছে, যা প্রকৃত চরিত্রের সঙ্গে খাপ খায় না। আর এদের প্রত্যেকেই এলাকার মানুষের কাছে একেকজন হাস্যকর চরিত্র। তাদের মধ্যে একজন আছেন, যিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রচণ্ড ভক্ত বলে প্রিয় নেতার প্রতি ভালোবাসার প্রদর্শন করতে গিয়ে এমন কিছু ঘটনা ঘটিয়েছেন, যার পরিপ্রেক্ষিতে এলাকার মানুষ তাকেই ‘বঙ্গবন্ধু’ বলে ডাকতে শুরু করে দিল। এভাবে তার এই নতুন নামে ঝাপসা হয়ে একেবারে হারিয়ে গেল প্রকৃত নাম। আবার একজন দিনমুজুর, যিনি নিজের নামের দস্তখত পর্যন্ত করতে পারেন না, তার নাম কিনা মাষ্টার! বাবা-মা শখ করে ছেলের এই নাম রেখেছিলেন এককালে। এসব নতুন কিছু নয়, তাই যে লোকটিকে মুক্তিযোদ্ধা নামে সবাই চেনে, এলাকাবাসীর দৃষ্টিতে তিনি মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার কোনো কারণ নেই। যেভাবেই হোক নাম উঠে গেছে। তিনি সত্যি সত্যি মুক্তিযোদ্ধা কিনা এসব নিয়ে পাড়া প্রতিবেশীরা তার সাথে প্রায়ই ঠাট্টা করে। তিনিও ওদের সাথে ঠাট্টার ছলেই প্রতিক্রিয়া জানান। প্রয়োজন মনে করেননি কখনো যে, তিনি সত্যি সত্যি মুক্তিযোদ্ধা বিষয়টি তাকে প্রমাণ করতে হবে। যেন কিছুই আসে যায় না-এমন প্রতিক্রিয়া তার।

 

মুক্তিযোদ্ধা নামটিই তাকে সবার কাছে হাস্যকর করে তুলেছে। মানুষের নাম আবার ‘মুক্তিযোদ্ধা’ হয় নাকি? মুক্তিযোদ্ধা তো পদবি। কিন্তু লোকটি সত্যি জানেন না, কে কীভাবে তার নাম আজিজুল হক থেকে মুক্তিযোদ্ধা বলে প্রচার করে দিয়েছে। এই নামের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসা আছে বলে তিনি নিজেও কোনো আপত্তি করেননি কখনো। কিন্তু যারা তাকে মুক্তিযোদ্ধা নামে ডাকে তাদেরই বরং ঘোর আপত্তি ছিল তার এই নাম নিয়ে। তাই কারণে-অকারণে নাম নিয়ে ধারাবাহিক কৌতুক চলতে থাকল।

‘ও মুক্তিযোদ্ধা! বল তো একাত্তরের যুদ্ধের সময় দেশকে কয়টা সেক্টরে ভাগ করা হইছিল? আচ্ছা, ভালো কথা, তুমি কোন সেক্টরে জানি যুদ্ধ করছিলা?’

‘ও মুক্তিযোদ্ধা! তুমি কি নিয়া যুদ্ধ করছো, ধান কাঁটার কাঁচি নিয়া? হা হা হা!’

‘মুক্তিযোদ্ধা! তোমারে এই নামটা কে দিছে কও তো?’

 

এসব ঠাট্টায় তিনি মোটেও রাগেন না, শুধু অল্প অল্প হাসেন। তার এই হাসি দেখলে ওদের আনন্দ আরও বেড়ে যায়। প্রতিপক্ষকে হারিয়ে জিতে যাওয়ার মতো আত্মবিশ্বাসে আনন্দ করে তারা।

 

তিন

কিছুদিন আগে মুক্তিযোদ্ধা অসুখে পড়ে মারা গেলে একটা বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে গেল গ্রামে। পুরো গ্রামে একটা উত্তেজনার আগুন জ্বলতে থাকে। রাজনীতি কিংবা ক্রিকেটেও এমন উত্তেজনা দেখা যায়নি আগে কখনো। প্রতিবেশীরা একটা ঘোর সামলে উঠতে না উঠতেই অন্য ঘোরের মুখোমুখি হয়। তারা বিশ্বাস করবে না করবে না করেও যেন বিশ্বাস করতে বাধ্য হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে এতোসব আলোচনা ও আয়োজন দেখে।

 

মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুর পর জেলা প্রশাসকসহ বড় বড় কর্তা ব্যক্তিরা এলেন তাকে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মান গার্ড অফ অনার জানাতে। পত্রিকায় তার বীরত্ব নিয়ে বিশেষ ফিচার ছাপা হয়। তার ব্যক্তিগত সাদাসিধে জীবনের গল্প, তার মহান আদর্শ নিয়ে সংবাদ হয়। টেলিভিশনে তাকে নিয়ে ডকুমেন্টারি দেখানো হয়। এমন একটি প্রত্যন্ত গ্রামের জনসাধারণের জন্য যা যুগান্তকারী ঘটনা।

 

দু’দিন আগেও যে লোকটি সবার কাছে শুধু একজন কৌতুক অভিনেতা ছিলেন, দু’দিন যেতে না যেতেই সেই একই লোক হয়ে উঠলেন সবার নায়ক। মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে এলাকার মানুষের বক্তব্য মুখে মুখে পাল্টে যেতে শুরু করলো, যেন লোকটি সারাজীবন তাদের কাছে অসামান্য মানুষ হিসেবেই ছিলেন ।

এলাকার চেয়ারম্যান তাকে ঘোষণা দিলেন, ‘আমাদের গ্রামের সোনার মানুষ ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা! তার মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত।’

যে লোকটি তার বাড়ির পাশে থাকত, এটা-ওটা নিয়ে তাকে প্রতিদিন শাসাতো, তিনি নিজের পরিচয় দেরয়া শুরু করলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধার পাশের বাড়িতে থাকি।’

যে লোকের জমি চাষ করতেন মুক্তিযোদ্ধা, তিনি গর্বের সাথে বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা আমার জমি চাষ করতেন।’

এমনকি যে লোকটি মুক্তিযোদ্ধার চুল কাটতেন, তিনিও নিজের মর্যাদা বাড়াতে বলতে শুরু করলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা আমার কাছে চুল কাটতে আসত!’    

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১১ ডিসেম্বর ২০১৬/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়