ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

নিপীড়িত মানুষের মুক্তির অনন্য দলিল

আলী নওশের || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১৫, ৭ মার্চ ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নিপীড়িত মানুষের মুক্তির অনন্য দলিল

বাঙালি জাতির জীবনে এক অবিস্মরণীয় দিন ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। ১৯৭১ সালে আজকের এই দিনে রমনার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে অনন্য ও যুগান্তকারী এক  ভাষণ দেন। তাঁর সেই ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্যে নিহিত ছিল স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের ডাক। সেদিন বজ্রকণ্ঠে তিনি ঘোষণা করেন- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

বঙ্গবন্ধু তাঁর দেওয়া মাত্র ১৯ মিনিটের সেই ভাষণে ইতিহাসের পুরো ক্যানভাসই তুলে ধরেন। তিনি বলেছেন, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো, দেশকে মুক্ত করে ছাড়বো- ইনশাল্লাহ।’ প্রকৃতপক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর ওই ভাষণই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা। এরপরই দেশের মুক্তিকামী মানুষ ঘরে ঘরে চূড়ান্ত লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।

১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পাকিস্তানি শাসক চক্র ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করে। গণরায় বানচালের জন্য ইয়াহিয়া খান পার্লামেন্টের অধিবেশন বাতিল ঘোষণা করেন। আলোচনার আড়ালে সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি নিতে থাকে তারা।

এ প্রেক্ষাপটে ৩ মার্চ পল্টন ময়দানের জনসভা থেকে বঙ্গবন্ধু জানিয়েছেন, ৬ মার্চের মধ্যে যদি ইয়াহিয়া সরকার দাবি না মেনে নেয় তবে ৭ মার্চ তিনি ভবিষ্যত কর্মপন্থা ঘোষণা করবেন। তাই একদিকে সাড়ে সাত কোটি বাঙালি আর অন্যদিকে পাকিস্তানি শাসকসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছিল এটা দেখতে যে, ৭ মার্চ কী ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু ।

এরপর তিনি অবিষ্মরণীয় সেই ভাষণ দেন যা বাঙালির মুক্তির সনদ হিসেবে বিবেচিত। ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান আমলের ২৩ বত্সরের শোষণ-বঞ্চনার ইতিবৃত্ত তুলে ধরেন। ভবিষ্যত করণীয়, মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি, স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত আহ্বান ছিল তাঁর এই ভাষণে। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়াত প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের ‘গেটিসবার্গ অ্যাড্রেস’ এবং যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক অধিকার আন্দোলনের নেতা মার্টিন লুথার কিংয়ের (জুনিয়র) ‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’- এর সঙ্গে তুলনা করা হয়।

অসীম ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অমিত শক্তির উৎস ছিল বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ। তাঁর এই ভাষণ গণতান্ত্রিক চেতনার উজ্জ্বলতা, নিপীড়িত মানুষের স্বাধিকার ও আর্থ-সামাজিক মুক্তির এক অনন্য দলিল। তার ভাষণে উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে পুরো জাতি। স্বাধীনতা সংগ্রামের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। ফলে ২৫ মার্চ কালো রাতে হানাদার বাহিনীর ক্র্যাক ডাউনের পর কী করতে হবে সেজন্য জনগণকে নির্দেশের অপেক্ষা করতে হয়নি।

সেই কালো রাতে পাকিস্তানিদের বর্বর গণহত্যার প্রতিবাদে অস্ত্র হাতে তুলে নেয় বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা। মরণপণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বঙ্গবন্ধুর ডাকে। অবশেষে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয় ১৬ ডিসেম্বর। দীর্ঘ নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এবং ৩০ লাখ প্রাণ আর দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে আসে বহু কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। পৃথিবীর মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের।

বঙ্গবন্ধুর অসাধারণ সেই ভাষণ আমাদের আবেগ ও আকাঙ্ক্ষাকে তুমুলভাবে নাড়া দেয়। বাঙালির আদর্শ ও চেতনার কেন্দ্রবিন্দু এই ভাষণই একমাত্র ভাষণ যা একটি নিরস্ত্র জাতিকে সশস্ত্র জাতিতে পরিণত করে। এটি কেবল বাঙালি জাতির জন্য নয়, পৃথিবীর স্বাধীনতাকামী, নিপীড়িত ও বঞ্চিত জনগণের দিক-নির্দেশক হিসাবে বিবেচিত। যে কোনো আন্দোলনে তাঁর সেই জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বর প্রেরণা জোগায় আজো।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৭ মার্চ ২০১৭/আলী নওশের/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়