ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

নেতাজিই ‘স্বাধীন’ ভারতের ‘প্রথম’ প্রধানমন্ত্রী

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:১৬, ২৩ জানুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নেতাজিই ‘স্বাধীন’ ভারতের ‘প্রথম’ প্রধানমন্ত্রী

শাহ মতিন টিপু : ‘আমাকে রক্ত দাও, আমি স্বাধীনতা দেব’ এই বিখ্যাত উক্তিটি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু’র। বলা হচ্ছে, নেতাজিই ‘স্বাধীন’ ভারতীয় সরকারের ‘প্রথম’ প্রধানমন্ত্রী।

ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের সূর্যসৈনিক সুভাষচন্দ্র বসুর ১২১তম জন্মবার্ষিকী আজ। তার জন্ম ১৮৯৭ সালের ২৩ জানুয়ারি পিতা জানকীনাথ বসুর কর্মস্থল কটকে। মা প্রভাবতী দেবী। চৌদ্দ ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন নবম।

শৈশব থেকেই মেধাবী এই নেতা ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হলেও ইংরেজদের অধীনে কাজ করতে হবে বলে সেই চাকরিতে যোগ দেননি।

তার মূল্যবোধের ভিত্তি গড়ে উঠেছিল একইসাথে জাতীয়তাবাদী ও সমাজতান্ত্রিক চেতনায়। রাজনৈতিক জীবনে নেতাজীর প্রেরণা ছিল দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। স্বামী বিবেকানন্দ এবং শ্রী অরবিন্দের চিন্তাধারায়ও প্রভাবিত ছিলেন তিনি। ১৯২৮ সালে সুভাষচন্দ্র ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সম্পাদক এবং ১৯৩০ সালে কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন।

ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার লক্ষ্যে তিনি ছিলেন আপসহীন। মাহাত্মা গান্ধীর অহিংস নীতিতে সমর্থন ছিল না তার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অক্ষ শক্তির সাহায্যে আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন সুভাষ।

দেশের স্বাধীনতার লক্ষ্যে আজীবন সংগ্রামী সুভাষচন্দ্র বসু একাধিকবার জেল–জুলুম সহ্য করেছেন। তবু তিনি আদর্শ থেকে সরে আসেননি। ১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট এক বিমান দুর্ঘটনায় সুভাষচন্দ্র বসু নিহত হন বলে প্রচারিত।

ভারতীয় বাংলা দৈনিক সংবাদ প্রতিদিনে এক নিবন্ধে বলা হয়, নেতাজিই ছিলেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। ১৯৪৩-এর ২১ অক্টোবর সিঙ্গাপুরের ক্যাথে সিনেমা প্রেক্ষাগৃহে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রথম ‘স্বাধীন’ ভারতীয় সরকার৷

১৯৪১-এর ১৬ জানুয়ারি নেতাজি ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্সের চোখে ধুলো দিয়ে ছদ্মবেশে পালিয়েছিলেন৷ নানা জায়গা ঘুরে, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, ইতালীয় দূতাবাসের সহায়তায় তিনি রাশিয়া হয়ে জার্মানিতে গিয়ে পৌঁছান৷ গঠন করেন যুদ্ধবন্দিদের নিয়ে এক বাহিনী, যারা ইন্ডিয়ান রিজিয়নের সদস্য হলেন৷ কিন্তু ভৌগোলিকভাবে অত দূর থেকে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নিয়োজিত থাকা যে বেশ কঠিন! এটা উপলব্ধি করে নেতাজি পূর্ব-এশিয়ায় চলে আসতে চান৷ রাসবিহারী বসু তখন জাপানে৷ সাবমেরিন করে জাপানে পৌঁছলে রাসবিহারী বসু নেতাজির হাতে তুলে দেন ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’-এর ভার৷
 


জাপান সরকার সর্বতোভাবেই এই স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতকে সাহায্য করে ব্রিটিশ-শাসনমুক্ত করতে প্রস্তুত ছিল৷ কিন্তু একইসঙ্গে তারা বাহিনীকে রাখতে চেয়েছিল আজ্ঞাধীন৷ সুভাষচন্দ্র জাপান কর্তৃপক্ষকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, শুধুমাত্র মিলিটারি কার্যক্রম ভারতের স্বাধীনতার জন্য পর্যাপ্ত নয়৷ চাই আলাদা প্রচার কার্যক্রম৷ এজন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, একটি স্বাধীন সরকারের প্রতিষ্ঠা– যাকে ‘অক্ষশক্তি’ প্রয়োজনীয় স্বীকৃতি প্রদান করবে৷ নেতাজি পূর্ণ উদ্যমে নতুন স্বাধীন সরকার গঠনের উদ্যোগ নিলেন৷

১৯৪৩-এর ২১ অক্টোবর সিঙ্গাপুরের ক্যাথে সিনেমা প্রেক্ষাগৃহে প্রতিষ্ঠিত হয় তথাকথিত প্রথম ‘স্বাধীন’ ভারতীয় সরকার: ‘Provisional Government of Free India’৷ গঠিত হয় পূর্ণ মন্ত্রিসভা৷ আর রাষ্ট্রপ্রধান, প্রধানমন্ত্রী ও বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে প্রথমেই শপথ নেন সুভাষচন্দ্র বসু৷ নিজের হাতে রাখেন পররাষ্ট্র ও যুদ্ধবিষয়ক দফতর৷ অর্থমন্ত্রী এ সি চট্টোপাধ্যায়, নারীবিষয়ক মন্ত্রী লক্ষ্মী সেহগল, প্রচার ও প্রপাগান্ডা দফতরের প্রধান এস এ আইয়ার৷ এ এন সরকার-সহ আরও ১৫ জন ছিলেন মন্ত্রিসভায়৷ রাসবিহারী বসু মনোনীত হন এই সরকারের প্রধান উপদেষ্টা৷

সে রাতেই প্রধানমন্ত্রী সুভাষচন্দ্রের বাসভবনে মন্ত্রিসভার পূর্ণাঙ্গ বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, ইঙ্গ-মার্কিন শক্তির বিরুদ্ধে অবিলম্বে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে৷ রাত বারোটার পর সিঙ্গাপুর রেডিও মারফত প্রধানমন্ত্রী নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ইঙ্গ-মার্কিন শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন৷

একবছর দশ মাস এই স্বাধীন সরকার দেশ শাসন করেছিল৷ আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ ও ভারতের মূল ভূখণ্ডের পূর্ব সীমান্ত ছিল এই সরকারের শাসনাধীন৷ কিন্তু ১৯৪৫-এর ৬ ও ৯ আগস্ট আমেরিকা অ্যাটম বোম নিক্ষেপ করায় আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় জাপান এবং প্রধান সাহায্যকারীর অনুপস্থিতিতে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিকল্পিত পথে পূর্ণতা লাভ করতে ব্যর্থ হয়৷

কিন্তু ২১ অক্টোবর ১৯৪৩-এ যে অন্তর্বর্তীকালীন ‘স্বাধীন’ ভারত সরকার স্থাপিত হয়েছিল তাকে স্বীকৃতি জানিয়েছিল ইউরোপ ও এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশ৷ এসব দেশের স্বীকৃতি লাভ করে প্রধানমন্ত্রী নেতাজি সুভাষের নেতৃত্বে এই সরকার প্রকাশ করেছিল ডাকটিকিট৷ চালু রেখেছিল নিজস্ব ডাকব্যবস্থা, কারেন্সি নোট৷ স্থাপিত হয়েছিল আজাদ হিন্দ ব্যাঙ্ক (রিজার্ভ ব্যাঙ্ক)৷ আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ পরিদর্শন করে নেতাজি এ দু’টি জায়গার নাম বদলে রেখেছিলেন ‘শহিদ’ ও ‘স্বরাজ দ্বীপ’৷ নিয়োগ করেছিলেন প্রশাসক৷ এই সরকার বিদেশে দূতাবাসও স্থাপন করে৷

‘অ্যান ইন্ডিয়ান পিলগ্রিম’ নামে একখানা আত্মজীবনী লিখছিলেন তিনি। সেটি অসমাপ্ত থেকে যায়। তাঁর রচিত গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘তরুণের স্বপ্ন’।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুভাষচন্দ্রকে 'দেশনায়ক' আখ্যা দিয়ে তাসের দেশ নৃত্যনাট্যটি তাকে উৎসর্গ করেন। উৎসর্গপত্রে লেখেন- "স্বদেশের চিত্তে নূতন প্রাণ সঞ্চার করবার পূণ্যব্রত তুমি গ্রহণ করেছ, সেই কথা স্মরণ করে তোমার নামে ‘তাসের দেশ’ নাটিকা উৎসর্গ করলুম।"

নেতাজির জন্মদিন বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে একটি রাষ্ট্রীয় ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়। স্বাধীনতার পর কলকাতার একাধিক রাস্তা তার নামে নামাঙ্কিত করা হয়। বর্তমানে কলকাতার একমাত্র ইন্ডোর স্টেডিয়াম নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়াম তার নামে নামাঙ্কিত। নেতাজির জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে দমদম বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তিত করে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর রাখা হয়।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ জানুয়ারি ২০১৮/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়